বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পৃথিবী বদলে দেওয়া আবিষ্কার

তানভীর আহমেদ

পৃথিবী বদলে দেওয়া আবিষ্কার

মানব সভ্যতার বিকাশে যুগে যুগে মানুষ করেছে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার বদলে দিয়েছে আমাদের চিরচেনা দুনিয়াটাকেই। শুধু জীবনযাত্রা সহজ করতেই নয়, কিছু কিছু আবিষ্কার সম্ভাবনার অপার দ্বার খুলে দিয়েছে ভবিষ্যতের জন্য। বিভিন্ন আঙ্গিকে আবিষ্কারগুলো ছিল অনন্য। আজ রইল তেমনি কিছু আবিষ্কারের গল্প...

 

মানব সভ্যতার বিকাশে সেরা আবিষ্কার বিদ্যুৎ

আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে সহজ হয়েছে মানুষের জীবনযাপন। আর এর অধিকাংশই নির্ভরশীল বিদ্যুতের ওপর। তাই শুধু শত সহস্র বছরেরই নয়, বিদ্যুৎ নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা আবিষ্কার। বিদ্যুতের মাধ্যমে পরবর্তীতে যেসব যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়, তার সব কটিই ইতিহাস সেরা আবিষ্কার। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাস পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্টকে বলা হয় বিদ্যুতের আবিষ্কারক। তিনি ১৫৭০ সালে প্রথম বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও বেশ কিছু বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম- আলেসান্দ্রো ভোল্টা, লইগি গ্যালভানি, মাইকেল ফ্যারাডে ও থমাস আলভা এডিসন। তারা প্রত্যেকেই বিদ্যুতের বিভিন্ন দিক উদ্ভাবন করেছেন। তবে বিদ্যুৎ আবিষ্কারে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন থমাস আলভা এডিসন। তার বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় বিদ্যুতের আবিষ্কার। ১৮৮২ সালে এডিসনই প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিদ্যুতের ওপর গবেষণা শুরু হয় ১৬ শতকের দিকে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি আমেরিকান বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রথম বিদ্যুতের ওপর ব্যবহারিক গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু এ সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যেত না। শুধু সাময়িক সময়ের জন্যই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যেত। ১৮৪০ সালে আবিষ্কৃত টেলিগ্রাফও ব্যাটারির মাধ্যমে চালানো হতো। এরই মাঝে ফ্যারাডের একটি আবিষ্কারের সূত্র ধরেই ১৮৩১ সালে ডায়নামো আবিষ্কার করা হয়। তবে এই যাত্রার শেষ হয় জোসেফ সোয়ান ও থমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে। জোসেফ সোয়ান ১৮৫০ সালের দিকে ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর ফিলামেন্ট রেখে বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। ফিলামেন্ট হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন কার্বনযুক্ত কাগজ। তবে সে সময়ে এই ভ্যাকুয়াম টিউবের পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। ফলে তার এ পদ্ধতি শুধু আবিষ্কার হিসেবেই অসাধারণ ছিল; দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য নয়। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার সব সরঞ্জাম হাতের নাগালে পায়। পৃথিবীর সব প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পেছনেই এক নম্বর অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ। তাই এই বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার।

 

হিসাব-নিকাশের অবাক যন্ত্র

এক সময় মানুষ হাতের আঙুল গুণে হিসাবের কাজ চালাত। বণিকরা ছোট পাথরের টুকরো বা ফলের বীজ দিয়ে চালাত তাদের গণনার কাজ এবং হিসাব-নিকাশ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ব্যাবিলনীয় বণিকগণ ক্লে ট্যাবলেটে তাদের উপাত্ত সংরক্ষণ করতেন। প্রাচীন চীনের অধিবাসীরা রড নিউমেরালস (Rod Numerals) নামক পদ্ধতি ব্যবহার করত গণনার জন্য। সময় তখন খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ। চীনাদের অ্যাবাকাস ছিল একটি হস্তচালিত আদি গণনাকারী যন্ত্র। আবিষ্কারের পর থেকে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের ধারাবাহিকতায় নিরীক্ষা (গ্রিকরা) এবং বাজেট (রোমানরা) সংরক্ষণের নবধারা হিসেবে রেকর্ড-কিপিং কৌশলের উন্নয়ন অব্যাহত থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ইতিহাস থেকে যা জানা গেছে তা হলো- প্রায় ৪ হাজার বছর আগে চীনারা গণনা করার জন্য একটি যন্ত্র তৈরি করে। যার নাম ছিল অ্যাবাকাস। এটিই হলো পৃথিবীর প্রথম গণনাকারী যন্ত্র। আর এটিই হলো বর্তমান কম্পিউটারের পূর্বপূরুষ। প্রাচীন জাপান, ভারত, চীন এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। ১৬৪২ সালে ব্লেইজ প্যাসকেল নামে একজন ফরাসি যুবক প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর যন্ত্রের উন্নয়ন করেছিলেন। এর ৩০ বছর পর ভিলহেলম লিবনিজ নামের এক জার্মান গণিতবিদ প্যাসকেলের উদ্ভাবিত যন্ত্রের উন্নয়ন করে একটি যন্ত্র উপস্থাপন করেন যার মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং সংখ্যামূল বের করা যেত।

 

সভ্যতার গতি বাড়িয়েছে চাকা

চাকাকে বলা হয় সভ্যতার গতি। চাকা আবিষ্কার হওয়ার আগে মানুষ নিজেই বহন করত তার যাবতীয় ভারের বোঝা। এক সময় বনের পশুকে পোষ মানাতে শেখে আদিম মানুষ। এসব প্রাণীর পিঠে বোঝা চাপিয়ে শুরু হয় পণ্য বহন। সভ্যতার ক্রমবিকাশ হতে থাকে এভাবে। মানুষ যে আদিকাল থেকে গতি পছন্দ করত, তা প্রকাশ পেতে থাকে ধীরে ধীরে। একপর্যায়ে গাছের গুঁড়ির চাকতি কেটে তার মাঝ বরাবর ছিদ্র করা হয়। এটাই সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম চাকা। এটি এতটাই পুরনো এক আবিষ্কার যে, ঠিক কবে এই চাকার আবিষ্কার হয়েছিল তা কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে পুরনো চাকাটি পাওয়া গিয়েছিল স্লোভেনিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে। ধারণা করা হয়, চাকার আবিষ্কার হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে। আবার ইতিহাস বলে ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় চাকা আবিষ্কার হয়। ককেশাসের উত্তরে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন। চাকা ব্যবহার করে জলচক্র পানি তোলার এবং পানি থেকে শক্তি আহরণের, গিয়ার চাকা, চরকা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিককালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন এবং টারবাইনের সবই চাকার পরিবর্তিত রূপ।

 

বীজগণিত ও মানুষের চোখ

বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে গণিতের ভিতের ওপর। আর গণিত দাঁড়িয়ে আছে বীজগণিতের ওপর। ‘আলজেবরা’ গাণিতিক হিসাব পদ্ধতিকে সহজ করে দিয়েছে। তাই আজ এই শাস্ত্রটির ব্যবহার ও শিক্ষা সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর প্রথম বীজগণিত নিয়ে প্রথম গ্রন্থটি রচনা করেছেন পার্সিয়ান বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজম। সপ্তম শতকে তিনি রচনা করেন দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘আল-জাবর ওয়াল মুকাবলা’। তার রচিত বইটিই মূলত আলজেবরা। মুসলিম এই গণিতবিদ রচিত বীজগণিতের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক গণিতের যাত্রা ও পথচলা শুরু হয়। এদিকে তৎকালীন আরব বিশ্ব শুধু গণিতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি, বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমানভাবে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তারা বিবর্ধক কাচ বা চশমার ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। বসরা নগরীর বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আলহাজেন সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন চোখের গঠন প্রণালি এবং চোখ কীভাবে কাজ করে। তিনিই প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ করেন, চোখের দৃষ্টি রশ্মির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অনুভূতি নেই। এ ছাড়া তিনিই প্রথম চশমার ধারণা দিয়ে বলেন, বাঁকানো কাচের পৃষ্ঠতল চোখের দৃষ্টি সহায়ক হিসেবে বিবর্ধনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

জীবন রক্ষাকারী আবিষ্কার অ্যান্টিবায়োটিক

প্রাচীনকালে বিভিন্ন ছত্রাক আর গাছের লতাপাতার নির্যাস দিয়েই মূলত বিভিন্ন সংক্রমণের চিকিৎসা করত মানুষ। কালে কালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে আসে পরিবর্তন। আবিস্কার হয় অ্যান্টিবায়োটিক। যা ছিল পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি। এটি চিকিৎসা জগতে এনে দেয় নতুন দিগন্তের সন্ধান। ১৯২৮ সাল, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সেখান থেকেই পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন। স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামক জীবাণু নিয়ে কাজ করতে গিয়েই তিনি এ ধরনের ছত্রাকের সন্ধান পান, যার জীবাণুনাশক ক্ষমতা রয়েছে। ছত্রাকটির নাম ‘পেনিসিলিয়াম নোটেটাম’। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন আকস্মিক এক ঘটনাক্রমে। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডনিবাসী চিকিৎসক ও জীবাণুতত্ত্ববিদ। ১৯২৮ সালে তিনি আবিষ্কার করেন বিশেষ এক ধরনের ছত্রাকে জীবন রক্ষাকারী পেনিসিলিনের অস্তিত্ব। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং সর্বপ্রথম পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও একে মানবদেহে ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় নিয়ে আসেন দুজন বিজ্ঞানী- হাওয়ার্ড ফ্লোরি (১৮৯৮-১৯৬৮) ও আর্নস্ট চেইন (১৯০৬-১৯৭৯)। ১৯৩৮ সালে এরা পেনিসিলিনের নিষ্কাশন ও বিশুদ্ধকরণের কাজ সম্পন্ন করেন।

 

তারবিহীন যোগাযোগের যন্ত্র

এখন যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন। কিন্তু এর সূচনা হয়েছে তারবিহীন যোগাযোগব্যবস্থার ধারণার মাধ্যমে। ওয়্যারলেস বা তারহীন যোগাযোগ বলতে বোঝায় কোনো তার, ক্যাবল বা অন্য কোনো ইলেকট্রিক কনডাকটর ছাড়াই নির্দিষ্ট দূরত্বে তথ্যের আদান-প্রদান। আর এসবের শুরুটা হয়েছিল রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে। রেডিও ওয়েভ হলো আলোকরশ্মি, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, ইনফ্রারেড রশ্মি এবং এক্স-রে রশ্মিরই আরেকটি রূপ। ১৮৮৮ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ প্রথম রেডিও ওয়েভ আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন, এই ওয়েভ আলোর গতিতে চলে। পরবর্তীতে ইতালিয়ান ইঞ্জিনিয়ার মার্কোনি হার্টজের গবেষণাকে তারহীন যোগাযোগব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেন। ১৮৯৪ সালে হার্টজের গবেষণা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভ করে মার্কোনি এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও সম্ভাবনা উপলব্ধি করেন। ১৮৯৫ সালের শেষ দিকে মার্কোনি একটি ট্রান্সমিটার ও রিসিভার আবিষ্কার করেন, যা ২.৫ কিলোমিটার বা ১.৫ মাইল পর্যন্ত রেডিও সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম। এরপর ১৯০১ সালে তিনি এর একটি উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন। এই রেডিও সিগন্যালের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই ১৯২৮ সালে টেলিভিশন রিসিভার আবিষ্কার করা হয়।

 

আগদাদ ব্যাটারি পৃথিবীর প্রাচীন ব্যাটারি!

১৮৬৬ সালে জর্জেস লেকল্যান্স একটি ব্যাটারি আবিষ্কার করেন। কিন্তু এর অনেক আগেই নাকি ব্যাটারি আবিস্কৃত হয়েছিল। সময়টা তখন ১৯৩৮ সাল; প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বাগদাদের খুজুত রাবু নামক স্থানে এক বিস্ময়কর পাত্রের সন্ধান পান। যা ছিল ৫ সেন্টিমিটার। পাত্রটি ছিল সিরামিক নির্মিত। ভেতরে মেলে একটি ধাতব নল এবং ভিন্ন ধাতুর তৈরি লৌহদণ্ডের অস্তিত্ব। বিশ্লেষকরা একে প্রাচীন ব্যাটারি আখ্যায়িত করেন। ইতিহাসে এটি ‘বাগদাদ ব্যাটারি’ নামে জায়গা করে নেয়। লোহার দণ্ডটি ছিল তামা দিয়ে আবৃত। ধারণানুযায়ী, তামার নলের ভিতর অম্লীয় দ্রবণ ব্যবহার করে ব্যাটারিটি সচল করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের দিকে প্রাচীন পারস্যে এমন ব্যাটারি তৈরি করা হতো। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী উইলার্ড গ্রেও ঝটপট বাগদাদ ব্যাটারির রেপ্লিকা তৈরি করে ফেলেন। এতে ভিনেগার ঢেলে সফলতা পান। তখন ব্যাটারিটি সচল হয়ে প্রায় ১.৫ থেকে ২.০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। ১৯৩০ সালে উইলহেম কনিগ একটি পেপারে উল্লেখ করেন, প্রাচীন পারস্যে বাগদাদ ব্যাটারিকে হয়তো গ্যালভানিক কোষ হিসেবে ব্যবহার করে ইলেকট্রোপ্লেটিং করা হতো। কিন্তু এই হাইপোথিসিসকে নাকচ করে দেন বিজ্ঞানীরা। ফলে বাগদাদ ব্যাটারির মূল রহস্য থেকে যায় ধোঁয়াশার আড়ালে।

 

প্যাপিরাস থেকে কাগজ

জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা কাগজের ব্যবহার দেখতে পাই। লেখা ছাড়াও কাগজের ওপর লেখা ছাপানো হয় এবং কোনো দ্রব্যের মোড়ক হিসেবেও কাগজ ব্যবহƒত হয়। যদিও কাগজের ইংরেজি শব্দটি প্যাপিরাস শব্দ থেকে এসেছে। এদের উৎপাদন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বর্তমান কাগজে উন্নয়নও প্যাপিরাসের উন্নয়ন থেকে পৃথক। প্রধানত কাঠ, বাঁশ, ছেঁড়া কাপড়, ঘাস, পুরনো কাগজ ইত্যাদি কাগজ তৈরির প্রধান উপাদান। মনে করা হয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনে আধুনিক কাগজের প্রচলন শুরু হয়। যদিও এর আগে কাগজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রাচীন চীনে মণ্ড দ্বারা তৈরি কাগজ দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে হান জাতির চাই লুন নামের এক ব্যক্তি আবিষ্কার করেন। চীনে সিল্কের সাশ্রয়ী ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে কাগজ ব্যবহার শুরু হয়। কাগজের প্রচলন চীন থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্বের মাধ্যমে এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপে কাগজের উৎপাদন শুরু হয়। যেখানে সর্বপ্রথম পানিচালিত কাগজ উৎপাদনের কাগজকল ও কলকবজা বা মেশিন আবিষ্কার ও নির্মাণ করা হয়। চিঠি, সংবাদপত্র ও বইয়ের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান এবং সাশ্রয়ী উপাদান হিসেবে কাগজ ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পে রূপ নেয়।

 

মানব সভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছিল যে ছাপাখানা

পঞ্চদশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার প্রিন্টিং প্রেস। এটি এমন এক যান্ত্রিক পদ্ধতি, যা কোনো কাগজ বা কাপড়ের পৃষ্ঠে চাপ প্রয়োগ করে কালি বা রঙের একটি আস্তরণ তৈরি করে। এই আস্তরণ হতে পারে কোনো লেখা বা কোনো নকশা বা চিত্র। জোহানেস গুটেনবার্গকে মূলত প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কারক হিসেবে মানা হয়। ১৪৪০ সালের দিকে তিনি এটি আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন জার্মানির অধিবাসী এবং পেশায় একজন স্বর্ণকার। অবশ্য প্রিন্টিংয়ের ইতিহাস শুরু হয় আরও অনেক আগে থেকেই। গুটেনবার্গের এই আবিষ্কারের প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে চীনা সাধকরা ব্লক প্রিন্টিং নামের একটি পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। এতে কাঠের তৈরি কোনো ব্লকে কালি লাগিয়ে কোনো কাগজের পৃষ্ঠে নকশা বা লেখা প্রিন্ট করা হতো। যা অষ্টম শতকে কোরিয়া এবং জাপানেও প্রচলিত ছিল। এরপর ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটতে থাকে প্রিন্টিং পদ্ধতির। এ ছাড়া ইউরোপে সে সময় জাইলোগ্রাফি নামক আরেকটি প্রিন্টিং পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। তবে সবকিছুর অবসান ঘটে গুটেনবার্গের আবিষ্কারের মাধ্যমে। তিনি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে হাতে হাতে প্রেসিং করে মুদ্রণ করার বদলে মেকানিক প্রেসিং করা যেত।

 

পণ্য পরিবহন সহজতর করেছে স্টিম ইঞ্জিন

স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে কলকারখানার বেশির ভাগ পণ্যই হাতে তৈরি হতো। এ ছাড়া পানিচালিত কিংবা পশুটানা যন্ত্রগুলোই ছিল শক্তির প্রধান উৎস। ১৭১২ সালে থমাস নিউকোমেন সর্বপ্রথম বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে পানির পাম্পের ইঞ্জিন তৈরি করেন। এরপর ১৭৬৯ সালে জেমস ওয়াট নিউকোমেনের এই ইঞ্জিনের কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি ইঞ্জিনে পানি থেকে বাষ্প প্রস্তুতকারী যন্ত্র সংযুক্ত করেন। ফলে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা আরও বেড়ে যায় আর ইঞ্জিনটি হয় আরও ব্যবহারযোগ্য। তার তৈরি এই ইঞ্জিন ঘূর্ণন শক্তি উৎপন্ন করতে পারত। জেমস ওয়াটের এই ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে মানুষ ইঞ্জিন চালিত গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হলো। সেই সঙ্গে তৈরি হলো ইঞ্জিনচালিত রেলগাড়ি। ফলে দ্রুতগতিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সক্ষম হলো মানুষ। স্টিম ইঞ্জিন তৈরির প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে ডার্টমাউথ নিবাসী নিউকোমেন একটি স্টিম ইঞ্জিন নির্মাণ করেন। যা ব্যবহৃত হতো কয়লা উত্তোলনে। তবুও বিংশ শতকের প্রথম দিকেই বাষ্পচালিত এরূপ টারবাইন নির্মাণ করা হয়েছিল, যার একেকটির সাহায্যে ৪৩ হাজার ৭০০টি অশ্বের শক্তির সমান কাজ করা সম্ভব ছিল। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্টিমচালিত টার্বাইন ব্যবহার করা হয়।

 

দূরদূরান্তে কথা বলার অন্যতম সেরা মাধ্যম টেলিফোন

টেলিফোন আবিষ্কার ছিল বিজ্ঞানের একটি কল্পনাতীত অধ্যায়। একবার ভাবুন তো, পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, দূর থেকে দূরান্তে কারও সঙ্গে কথা বলি, একটু হলেও কি অবাক হই না! তাহলে বুঝুন এই যন্ত্র আবিষ্কারের পর মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল। আলেক্সান্ডার গ্রাহামবেলকে টেলিফোনের আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয়। তবে এ নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল এবং ইলিশা গ্রে উভয়েই ওয়াশিংটনের পেটেন্ট অফিসে ১৮৭৬ সালে টেলিফোন আবিষ্কারের পেটেন্ট এপ্লিকেশন জমা দেন। আর সে সময় গ্রাহামবেলের আবেদনটি আগে নিবন্ধিত হয়। একই জুনে ফিলাডেলফিয়ার প্রদর্শনীতে বেল প্রথমবারের মতো তার আবিষ্কৃত টেলিফোন উপস্থাপন করেছিলেন। যন্ত্রটি সফলতার সঙ্গে একপ্রান্তে উচ্চারিত শব্দ অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারত। অবশ্য তার টেলিফোনটির ব্যবহার ছিল খানিকটা কষ্টসাধ্য। তবে ১৮৭৭ সালে তিনি টেলিফোনকে সহজে ব্যবহারযোগ্য করে উৎপাদন শুরু করেন এবং ক্রমান্বয়ে ইউরোপের বাজারে ছড়িয়ে দিতে থাকেন।

 

এখান থেকে উত্থান হয়েছিল খাদ্য মজুদ কিংবা শীতলকরণের

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে প্রাচীন পারস্যে হিমায়ক কক্ষ তৈরি করা হতো। যাকে ‘ইয়াখছাল’ বলা হতো। একে বর্তমানের বরফঘরের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যেতে পারে। মূলত বরফঘরের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই তৈরি করা হতো। এর উপরিভাগ ছিল গম্বুজাকৃতির এবং ভেতরের দিকে ছিল কতক ফাঁপা জায়গা। নিরেট, তাপরোধী কিছু গাঠনিক উপাদান দিয়ে ভেতরে ফাঁপা জায়গা মুড়িয়ে দেওয়া হতো। অন্তভৌমের ফাঁপা জায়গার আয়তন হতো ৫ হাজার ঘন মিটারের মতো। কাঠামোটিতে শীতল বাতাস প্রবেশ করত এর ভিত্তি এবং অন্তভৌমের ফাঁপা অংশ দিয়ে। এর মোচাকৃতির গঠন দিয়ে গরম তাপ বেরিয়ে যেত। ফলে ভেতরের অংশের তাপমাত্রা হতো বাইরের অংশ থেকে কম। এগুলো তৈরি করা হতো সারোজ নামে পানিরোধী হামানদিস্তা দিয়ে। বালি, কাদা, ডিম, ছাগলের পশম এবং ছাই সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা হতো সেই বিশেষ হামানদিস্তা। এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো- এটি তাপ ও পানিরোধের উপযোগী। এর আসল কাজ ছিল বরফ সংরক্ষণ করে রাখা। বরফের পাশাপাশি এতে খাবারও সংরক্ষণ করা হতো।

 

পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে ইন্টারনেট

পৃথিবীতে যে আবিষ্কারটি গোটা বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছে সেটি হলো ইন্টারনেট। আমরা এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি যে, ইন্টারনেট ছাড়া আমরা একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না। ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী তথ্য আদানপ্রদান ও প্রচারের জন্য একটি অভূতপূর্ব মাধ্যম। ১৯৬০-এর গোড়ার দিকে ইন্টারনেটের আগমন ঘটে। এম-আইটির জে.সি.আর. লিক্লাইডার ‘ইন্টারগ্যাল্যাক্টিক নেটওয়ার্ক’ নামক একটি ধারণার জন্ম দেন। এই পদ্ধতিতে কম্পিউটারকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়। এরপর ১৯৬০-এর শেষের দিকে ARPANET বা Advanced Research Projects Agency Network এর আগমন ঘটে। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে তৈরি একটি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা যা কয়েকটি কম্পিউটারকে একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসত। ১৯৮৩ সালের পর থেকে বিজ্ঞানীরা আধুনিক ইন্টারনেট আবিষ্কারের দিকে এগোতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি আসে বিজ্ঞানী টিম বার্নাস লির World Wide Web বা WWW আবিষ্কার। তার এই আবিষ্কার হাইপার-লিংক বা ওয়েবসাইটভিত্তিক ইন্টারনেটের সূত্রপাত ঘটায়।

 

আশির দশকের পর কম্পিউটারে আমূল পরিবর্তন আসে

বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার কম্পিউটার। এটি এমন এক যন্ত্র যাতে কোনো তথ্য বা উপাত্ত প্রবেশ করালে সেই তথ্যকে নিপুণভাবে ব্যবহার নতুন তথ্য বা ফলাফল পাওয়া যায়। চার্লস ব্যাবেজকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়। তবে এই আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় অ্যাবাকাস আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ব্রেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম ক্যালকুলেটিং মেশিন আবিষ্কার করেন। পরে গণকযন্ত্রের ইতিহাসে যোগ হয় বিখ্যাত জার্মান ভিলহেলম লিবনিজের নাম। তার গণক যন্ত্র যোগ-বিয়োগের সঙ্গে গুণ ভাগও বের করতে পারত। ১৯৪০ সালে ক্লড শ্যানন প্রথম ডিজিটাল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার আবিষ্কার করেন। প্রোগ্রামেবল ডিভাইসের জন্য এটি সম্ভাবনার দুয়ার খোলে। ১৯৪১ সালে করনার্ড জিউস আবিষ্কার করেন পৃথিবীর প্রথম অপারেশনাল কম্পিউটার। যা মার্কেটে আসতে থাকে ১৯৭৭ সালের দিকে। তবে বর্তমান কম্পিউটারের রূপরেখা তৈরি করেন ব্রিটিশ গণিতবিদ ‘চার্লস ব্যাবেজ’। ১৮২২ সালে তিনি লগারিদমসহ গাণিতিক হিসাবনিকাশ সহজ করার লক্ষ্যে একটি যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। এরও পরে ১৮৩৩ সালে তিনি আগের সব গণনাকারী যন্ত্রের স্মৃতিভাণ্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ জন্য তিনি একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যার নাম দেন অ্যানালটিক্যাল মেশিন। এর কাজ অবশ্য তিনি শেষ করতে পারেননি। তার এ মেশিনের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করেই আজকের এ কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছে। এ জন্যই তাকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়। কম্পিউটারের বড় সাফল্য আসে মাইক্রোপ্রসেসর আবিষ্কারের ফলে। ব্যবহারের সুবিধা এবং কাজের ক্ষমতা বেড়ে যায়।

সর্বশেষ খবর