বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আধুনিক যুগের সপ্তাশ্চর্য

আধুনিক যুগের সপ্তাশ্চর্য

তালিকায় থাকা পর্যটন স্থানগুলোর সব বিশ্বের ঐতিহাসিক স্থান। যা আজকের পৃথিবীতে ‘আধুনিক যুগের সপ্তাশ্চর্য’ হিসেবে বেশ পরিচিত। ২০০৭ সালে ‘নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন’ এই সপ্তাশ্চর্যগুলো নির্বাচন করে।

 

তাজমহল, [ ভারত ]

তাজমহল মুঘল সাম্রাজ্যের একটি মুকুট; এবং স্থাপত্যশিল্পের কৃতিত্ব হিসেবে গোটা বিশ্বে আজও অনন্য। এই স্থাপত্যে ১৫২৬ থেকে ১৭৬১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ রাজা-মহারাজা এখানে তাঁদের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৩২ থেকে ১৬৪৮ সালে তাজমহল প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। বলা হয়, তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। বিশাল এই স্থাপনাটি নির্মাণে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক দিন-রাত পরিশ্রম করেছিলেন। এবং নির্মাণকার্য শেষ করতে প্রায় ১৬ বছর সময় লেগেছিল। ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে আজও স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের মৃত্যুর পর বিরহ-শোকে কাতর হয়ে পড়েন। এরপরই স্ত্রীর স্মরণে বিশাল এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, ওস্তাদ আহমেদ লাহোরি ছিলেন এর প্রধান স্থপতি। তাঁর তত্ত্বাবধানে ২০ হাজার লোকের ২২ বছরের পরিশ্রমে সম্পন্ন হয়েছিল তাজমহল। এটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীকে ভীষণভাবে প্রতিফলিত করে। শ্বেতপাথরের তৈরি সমাধিসৌধ চন্দ্র-সূর্যের আলোয় প্রভাবিত হয়। দিনের আলো আর রাতের আঁধারে তাজমহল বর্ণিল রূপ ধারণ করে, যা কি না আবার প্রতিফলিত হয় সামনে থাকা জলাধারটিতে। অপূর্ব নির্মাণকুশলীতে গড়া ৪০০ বছর আগে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে নির্মিত এই সৌধটি বিশ্ববাসীর কাছে আজও বিশ্বের অনন্য এক বিস্ময়।

 

দ্য গ্রেট ওয়াল, [ চীন ]

আজকের দিনে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’ চীনের জাতীয় প্রতীক। সুবিশাল এই মহাপ্রাচীরটি ১৮০০ বছর ধরে নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২২০ অব্দ থেকে ১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজা-মহারাজা এবং রাজবংশ এই মহাপ্রচীরটি নির্মাণ করেন। ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’ আসলে অনেক দেয়ালের সমন্বয়। ধারণা করা হয়, এর প্রতিটি স্তরের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য অনুমানিক ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার কিলোমিটার। প্রাকৃতিক ভূখণ্ডের কৌশলগত ব্যবহারের উদ্দেশে এই মহাপ্রাচীরের নকশা করা হয়েছিল; যা মূলত পাহাড় আর গিরিখাতের সমন্বয়ে তৈরি। একক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং মোঙ্গলীয়দের আক্রমণ রুখে দেওয়াই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। প্রাচীরের সবচেয়ে সংরক্ষিত অংশটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে দক্ষিণ-পূর্ব লিয়াওনিং প্রদেশ থেকে উত্তর-পশ্চিম গানসু প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। মিং রাজবংশ ১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই প্রাচীরকে শক্তিশালী করে।

 

মাচু পিচু, [ পেরু ]

মাচু পিচু হলো প্রাক-কলম্বিয়ান ইনকাদের বসতি; যা আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব ঢালে অবস্থিত। ১৫ শতাব্দীতে ইনকা রাজা পাচাকুতেক পাহাড়ে মেঘের মধ্যে রাজকীয় প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৫ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৬ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মেঘের রাজ্যটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে, যদিও এর সঠিক কারণটি আজও অজানা। প্রচলিত আছে, গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়লে, ইনকাদের এই স্থাপনা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৫৩২ সালে স্পেনীয়দের হাতে ইনকা সাম্রাজ্যের পতনের পর ৩০০ বছরের বেশি সময় এটি মানব সভ্যতা থেকে হারিয়ে যায়। স্প্যানিশ আক্রমণের পূর্বে মাচু পিচু ছিল ইনকাদের তীর্থস্থান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ১৯১১ সালের আগে এটি বিশ্বের বুকে অপরিচিত ছিল। স্থানীয়রা অঞ্চলটিতে চাষাবাদ করলেও অন্যান্য দেশের মানুষজন একে বিধ্বস্ত জনপদ হিসেবেই জানত।

 

পেত্রা, [ জর্ডান ]

কথিত আছে, নবটায়েনদের হাতে পেত্রা নগরী নির্মিত হয়েছিল। যারা ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওয়াদি মুসা উপত্যকায় বসবাস করেছিল। নবটায়েন সাম্রাজ্যের রাজা চতুর্থ আরেটাসের (খ্রিস্টপূর্ব ৯ থেকে ১০ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলের রাজধানী ছিল পেত্রা। অপূর্ব নির্মাণকুশলতায় পাথরে খোদাই করে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুরম্য অট্টালিকা। এটি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও প্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্যারাভান রুট। কৌশলগতভাবে এটি ছিল রেশম এবং মসলা বাণিজ্যে ব্যবহৃত অন্যতম প্রাচীন রুটের পাশে অবস্থিত নগরী। ইতিহাসবিদদের মতে, ১০৬ খ্রিস্টাব্দে শহরটি রোমান সাম্রাজ্যের হাতে পড়ে। এখানে রয়েছে পাথরে খোদাইকৃত মূর্তি, ৪ হাজার আসনের অ্যামফিথিয়েটার এবং এল-দেইর আশ্রমের ওপরে অবস্থিত ৪২ মিটার উঁচু হেলেনীয় মন্দির। যেগুলো আজও মধ্য-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।

 

দ্য কলোসিয়াম, [ ইতালি ]

কলোসিয়াম-আর্কেড-অ্যাম্ফিথিয়েটার রোমান সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহারণ। যা ‘ফ্লাভিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার’ নামেও পরিচিত। ইতালির রোমে এটি অবস্থিত। এখানে গ্লাডিয়েটরদের মল্লযুদ্ধ ও বন্যপ্রাণীদের লড়াই প্রদর্শিত হতো। প্রায় চার শতাব্দী ধরে এই অ্যাম্ফিথিয়েটার গ্লাডিয়েটরদের লড়াই, ভয়ংকর শো, পাশাপাশি জনসাধারণের মৃত্যুদণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়াও মঞ্চস্থ হতো বিনোদনমূলক নৌযুদ্ধ। চক্রাকার স্থাপনাটিতে একসঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার দর্শক অবস্থান করতে পারতেন। ৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে ফ্লাভিয়ান বংশের সম্রাট ভেস্পাসিয়ান ও তাঁর পুত্র সম্রাট তাইতাস বিখ্যাত এই ‘কলোসিয়াম’ নির্মাণ করেছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এটি একটি অস্থায়ী আবাসন কমপ্লেক্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কালেভাদ্রে ভূমিকম্প আর দস্যুদের আক্রমণে কমপ্লেক্সটির খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

চিচেন ইৎজা, [ মেক্সিকো ]

মায়া সভ্যতার বিখ্যাত মন্দির-শহর ছিল চিচেন ইৎজা। যা শেষ পর্যন্ত মায়া-টোলটেক সভ্যতার অংশ হয়ে ওঠে। আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রটি মেক্সিকোর ইয়ুকাতান উপদ্বীপে অবস্থিত। প্রায় ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চিচেন ইৎজা শহরটি বিকাশ লাভ করেছিল। পরবর্তীতে এটি মায়াপান এবং উক্সমাল শহরের রাজনৈতিক উদ্দেশে সংযুক্ত হয়েছিল। ষষ্ঠ থেকে ১২০০ শতাব্দী পর্যন্ত এটি তাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল। ১৬ শতকে স্প্যানিশরা আসার আগেই এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ইউরোপীয়রা উপনিবেশ গড়ার পূর্বে মায়ানরা মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা শাসন করেছিল। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে বিখ্যাত চিচেন ইৎজার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য শুরু হয়েছিল। ধ্বংসাবশেষে পাওয়া মন্দিরটি (এল ক্যাসিলো পিরামিড) শহরের বিখ্যাত স্থাপনা, যার ৩৬৫ সিঁড়ি জ্যোতির্বিজ্ঞানে মায়ানদের সৌর ক্যালেন্ডারে প্রতিদিনের সাক্ষ্য দেয়।

 

ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার, [ ব্রাজিল ]

ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার; আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অতি-সম্প্রতি নির্মিত স্থাপনা। ব্রাজিলে অবস্থিত মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ৩৮ মিটার (১২৫ ফুট)। যিশুখ্রিষ্টের মূর্তিটি ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরের ৭১০-মিটার উঁচু করকোভাদো পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। বিশ্বের বৃহত্তম যিশুখ্রিস্টের এই মূর্তিটি ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো ব্রাজিলের প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। কেননা, বিংশ শতাব্দীতে ক্যাথলিক চার্চ কতৃক ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার উন্মুক্তের সময়, ব্রাজিলিয়ানদের ৯০ শতাংশেরও বেশি জনসাধারণ ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মীয় ক্যাথলিক। মূর্তিটির ওজন প্রায় ১,১৪৫ টন, এবং মূর্তিটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন যিশু তাঁর দুই হাত প্রসারিত করে পুরো শহরকে আলিঙ্গন করছেন। হাইটার দ্য সিলভা কোস্টা নামের এক ব্রাজিলীয়র করা নকশা অনুযায়ী ফরাসি শিল্পী পল ল্যান্ডোওস্কি যিশুর নির্মাণকাজ শেষ করেছিলেন।

সর্বশেষ খবর