বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
আবদুল কাদের

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়

প্রকৃতি নিজের মতো করেই মানবসভ্যতাকে আগলে রাখে। তবে এর বিপরীত হলে ধরিত্রীতে নেমে আসে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবে এসবের বাইরে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীতে বয়ে আনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। যার অসংখ্য উদাহরণও রচিত আছে ইতিহাসের পাতায়। যার কারণ পেশাদারিত্বের অভাব এবং উদাসীনতা। এসব বিপর্যয় নিয়ে আজকের আয়োজন...

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়

চেরনোবিল বিপর্যয়

এপ্রিল ২৬, ১৯৮৬

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে একটি হলো- ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা। যা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়েও কয়েক শ গুণ ভয়াবহ বলে বিবেচিত হয়। দিনটি ছিল ২৬ এপ্রিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনে অবস্থিত চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরীক্ষা চালানোর সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। পর পর দুটি বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চেরনোবিল। মুহূর্তেই নিভে যায় ৩১টি প্রাণ এবং ২৩৭ জন তীব্র বিকিরণ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। দুর্ঘটনার সূত্রপাত চতুর্থ পারমাণবিক চুল্লিকে কেন্দ্র করে। মূলত পারমাণবিক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গেলে কী ঘটতে পারে? তা নিয়েই চলছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিপর্যয়ের রাতে কর্মীরা ভুলবশত পারমাণবিক চুল্লির টারবাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতল পানি প্রবাহিত করে। রিঅ্যাক্টরটির শক্তি নামিয়ে আনা হয়েছিল ৭ শতাংশে। জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরিয়ে ফেলা হয়, পাওয়ার রেগুলেটর সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কোরের সঙ্গে সংযুক্ত কন্ট্রোল রডও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। একের পর এক নেওয়া অনেক অপরিকল্পিত এবং ভুল সিদ্ধান্তের ফলে শুরু হয়ে যায় নিউক্লিয়ার চেইন রিঅ্যাকশন বা শেকল বিক্রিয়া।  ওই দুর্ঘটনার প্রায় ২০ ঘণ্টা পর আবার বাইরের বাতাস ঢুকে পারমাণবিক চুল্লির দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ১০ দিন ধরে জ্বলে সে আগুন। পারমাণবিক বিক্রিয়ায় কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর কয়েক লাখ মানুষ সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। তখন থেকেই পরমাণু বিকিরণজনিত নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন আশপাশের অঞ্চলের বাসিন্দারা; যা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। এখন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়-বিকিরণজনিত নানা রোগের পাশাপাশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।

 

আর্সেনাল হিল এক্সপ্লোয়েশন

এপ্রিল ৫, ১৮৭৬

১৮৭৬ সালের ৫ এপ্রিল, সল্টলেক সিটিতে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ। স্থানীয় মরমন চার্চের অর্ধবার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমিয়েছিল। সল্টলেকের পার্কে তখন লোকেরা বেসবল খেলছিল, হ্রদে  তখন সারি সারি নৌযান; উজ্জ্বল রোদে তারা পিকনিক করতে সমবেত হয়েছিল। ১৮ বছর বয়সী দুই যুবক ফ্র্যাঙ্ক হিল এবং চার্লস রিচার্ডসন। দুজনই তখন পাউডার ম্যাগাজিনের কাছে আর্সেনাল হিলে গবাদি পশু চরাচ্ছিলেন। এটি ছিল শহরের গোলাবারুদের ভান্ডার। পশু চরানোর সময় একঘেয়েমি এড়াতে হিল এবং রিচার্ডসন মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একঝাঁক গিজ পাখির দিকে পটশট নিতে শুরু করেন। ক্ষণিক বাদে পরপর তিনটি বিস্ফোরণে ৪০ টন গানপাউডার, ব্লাস্টিং পাউডার এবং বিভিন্ন বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ বিস্ফোরিত হতে থাকে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন হিল ও রিচার্ডসন। আকস্মিক বিস্ফোরণে সল্টলেকে থাকা ঘোড়া, গাছগাছালি, বেসবল খেলোয়াড় এবং আগতদের সবাই দূরে ছিটকে পড়ে। ভবনের কাচের টুকরোগুলো বাতাসে উড়ে গেল। প্রচন্ড বিস্ফোরণে আশপাশের ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার (২ মাইল) ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা প্রতিটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেদিন চারজন নিহত হয়েছিল এবং  পাউডার ম্যাগাজিন এলাকায় বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল।

 

লন্ডনের বিয়ার সুনামি

অক্টোবর ১৭, ১৮১৪

অতিবৃষ্টিতে বন্যার ঘটনা আমাদের চেনা। কিন্তু প্রায় দুই শতাব্দী আগে লন্ডনে ভয়াবহ এক বন্যায় মারা গিয়েছিল অনেক মানুষ। সেই বন্যা হয়েছিল পানির বদলে বিয়ারের। অদ্ভুত হলেও সত্য। ১৮০০-এর দশকের গোড়ার দিকে এমনি এক ঘটনার সাক্ষী হয় লন্ডন। নগরীটির দুই রাস্তা, গ্রেট রাসেল স্ট্রিট এবং টটেনহ্যম কোর্ট। যার সংযোগস্থলে ছিল সেকালের বিখ্যাত বিয়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘হর্স সু ব্রিউয়ারি’। কারখানায় ছিল বাইশ ফুট উঁচু কাঠের ফার্মেন্টশন ট্যাঙ্ক। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ব্যারেল বিয়ার মজুদ থাকত সেখানে। এক দুর্ঘটনায় সেদিন বিয়ারের স্রোতে ভেসে যায় গোটা শহর। আহত হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়াও সেদিন বহু ঘরবাড়ি ও অন্যান্য নানা জিনিসের ক্ষতি হয়েছিল। ট্যাঙ্ক ধরে রাখে এমন লোহার রিং চাপ সহ্য করতে না পেরে আচমকা খুলে যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বের হতে থাকে ট্যাঙ্কের মজুদ বিয়ার। বিয়ারের স্রোতে ভেঙে যায় আরও কয়েকটি ট্যাঙ্ক। প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার গ্যালন বিয়ার বেরিয়ে আসে কারখানা থেকে।

 

লন্ডনের ভয়ংকর ধোঁয়াশা

ডিসেম্বর ৫, ১৯৫২

আলোচিত ঘটনাটি ‘দ্য গ্রেট স্মগ’ বা ভয়ংকর ধোঁয়াশা নামে পরিচিতি। ১৯৫২ সালের ৫ ডিসেম্বর আকস্মিক এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল লন্ডন। ভয়ংকর বায়ু দূষণের শিকার হয়ে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। লন্ডনবাসী সেদিনের মতো আকাশে এমন অন্ধকার আর কখনো দেখেনি। কেউ যেন ঘন কালো চাদরে ঢেকে দিয়েছিল পুরো নগরী। আর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল গোটা লন্ডন। ব্রিটেনে তখন জ্বালানির প্রধান উৎস কয়লা। আর এই পোড়ানো কয়লার ধোঁয়াই লন্ডনকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল। সেদিন ছিল প্রচন্ড ঠান্ডার দিন। লন্ডনবাসী জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের ফায়ারপ্লেস জ্বালিয়ে ঘর উষ্ণ করছিল। অনেকে আবার ঠান্ডা থেকে রেহাই পেতে কয়লার চুলা জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছিল। পাশাপাশি তৎকালীন কারখানাগুলোয় পুরোদমে চলছিল জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার। কয়লা পোড়ানো ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যায় শীতের ঘন কুয়াশা। আর তাতেই বাধে বিপত্তি। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন শহরের ওপরে (বায়ুমন্ডলে) দূষণ আটকে যায়। আর আকাশ পরিষ্কার করার জন্য সেদিন কোনো বাতাসও ছিল না। ফলাফল দূষিত ধোঁয়া কোথাও যেতে পারেনি। দূষিত বায়ুতে ঢাকা পড়ে গোটা নগরী। দুপুর নাগাদ এই ধোঁয়া হলুদ-বাদামি আকার ধারণ করে। অনেকটা পচা ডিমের মতো গন্ধ পেতে শুরু করেছিল লন্ডনবাসী। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ড. ব্রায়ান কমিন্স। তিনি বলেন, ‘ধোঁয়াশা শুরু হয়েছিল এক শুক্রবারে। এটা ছিল একেবারে কালো। কখনো একটু হলদেটে।’ বিপদ আঁচ করতে পেরে নগর কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছিল এই বলে যে, ‘প্রয়োজন ছাড়া বাসিন্দারা যেন কেউ বাইরে না বোরোয়।’ বাতাস এত ঘন ছিল যে, লোকেরা নিজেদের পা দেখতে পেত না। টেমস নদীতে নৌ চলাচল বন্ধ ছিল। ভবনগুলোতে মৃত পাখি পড়েছিল এবং গবাদি পশু দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। আনুমানিক ১২ হাজারের বেশি মানুষ সরাসরি দূষিত সালফারাসের কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মারা গিয়েছিল।

ভোপাল রাসায়নিক বিপর্যয়

ডিসেম্বর ৩, ১৯৮৪

ভারতের মধ্য প্রদেশের ভোপাল মানেই সবুজ নগরায়ণ, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম হ্রদের নগরী। কিন্তু প্রায় চার দশক আগে এই চিরায়িত স্বীকৃতি হারিয়ে যায়। ১৯৮৪ সালের ২ ও ৩ ডিসেম্বর ভারতের মধ্য প্রদেশের ভোপাল শহরে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনাগুলোর একটি। একসময় ভোপালের জনবসতির মধ্যেই ছিল ইউনিয়ন কার্বাইডের রাসায়নিক কারখানা। তৈরি ও সঞ্চিত হতো উদ্বায়ী বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট। দুর্ঘটনার রাতে একটি এমআইসি ট্যাঙ্কে পানি ঢুকে গ্যাস নির্গত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ৪০ মেট্রিক টন মারণ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। যদিও তৎকালীন সেই দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে নগরীর ভিতরে ও বাইরে। দুর্ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ জনবসতির ভোপালের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ চোখজ্বালা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের প্রদাহে আক্রান্ত হন। রাজ্য সরকারের এফিডেভিট অনুযায়ী গ্যাসের প্রভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৭৮৭ জন মানুষ।

 

গুড়ের বন্যায় মৃত্যুপুরী!

জানুয়ারি ১৫, ১৯১৯

বিপর্যয়ের কারণ- গুড়! অবাক হচ্ছেন! এই গুড়ের বন্যা বোস্টনের নর্থ এন্ডের ২১ জন বাসিন্দার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। আহত হয়েছিল অন্তত ১৫০  জন। ঝোলা গুড়ের প্রচন্ড সুনামিতে অসংখ্য ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, এমনকি পথচারীরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান। সেদিন বোস্টনের নর্থ এন্ডের এক স্টোরেজ ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণে প্রায় ২ মিলিয়ন (২০ লাখ) গ্যালনের বেশি গুড় লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিস্ফোরিত ট্যাঙ্কটি ছিল ১৫ মিটার (৫০ ফুট) লম্বা এবং ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন লিটার (২ দশমিক ৩ মিলিয়ন গ্যালন) গুড় রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর সূর্যাস্ত হলে বোস্টনের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। আর এতে স্থানীয়দের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়া গুড় ঘন হতে থাকে এবং জরুরি কাজে নিয়োজিত কর্মীরা এক সময় গুড়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে জমেই গিয়েছিল। ছড়িয়ে পড়া গুড় পরিষ্কারের পর তার নিচ থেকে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল।

 

ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা

জুলাই ৯, ১৯১৮

শত বছরের বেশি আগে আমেরিকা দেখেছিল ভয়াবহ এক ট্রেন দুর্ঘটনা। যা ইতিহাসে ‘গ্রেট ট্রেন রেক’ নামে বেশি পরিচিতি। অনেকে একে আবার ‘ডাচম্যানস কার্ভ ট্রেন এক্সিডেন্ট’ নামেও চেনেন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল আমেরিকার টেনেসির ন্যাশভিলে। ১৯১৮ সালের ৯ জুলাই দুটি ট্রেন দ্রুতগতিতে যাত্রা করেছিল। তবে ন্যাশভিল থেকে প্রায় ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরে এর ভয়াবহতার প্রভাব (বিকট শব্দ) শোনা গিয়েছিল। ঘটনার দিন সকাল ৭টা নাগাদ প্রকৌশলী ডেভিড কেনেডি #৪ ট্রেনটি স্টেশন থেকে বেরিয়ে মেমফিসের দিকে যাত্রা শুরু করে। চালক তখন ট্রেনটিকে রেললাইনের একক পথে নিয়ে আসেন। একক পথ ধরে ট্রেনটি যখন চলছিল তখন টাওয়ার অপারেটর লক্ষ্য করলেন যে, বিপরীত দিক থেকে আরেকটি ট্রেন তখনো স্টেশনে এসে পৌঁছোয়নি। অর্থাৎ আগের ট্রেনটি তখনো একই পথ ধরে স্টেশনের দিকে ছুটে আসছে। টাওয়ার অপারেটর নিজের ভুল বুঝতে পেরে #৪ ট্রেনটিকে থামাতে দ্রুত বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ট্রেন দুটি একই পথ ধরে বিপরীতমুখী হয়ে ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় (৬০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) ছুটে আসছিল। ট্রেন দুটি প্রচন্ড জোরে একে অন্যকে আঘাত করে। বগিগুলো একে অন্যের ওপরে উঠে যায়। আশপাশের এলাকায় তখন ছড়িয়ে পড়ে কেবল ধ্বংসাবশেষ আর মৃতদেহ। সে দুর্ঘটনায় ১০১ জন মারা গিয়েছিল এবং ১৭১ জন আহত হয়েছিল।

 

এক্সন ভালদেজে তেল ছড়িয়ে পড়া

মার্চ ২৪, ১৯৮৯

আমেরিকার আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম এবং এর আশপাশের অঞ্চলটি সামুদ্রিক স্যামন, গ্রিজলি বিয়ার, ওটার, অগণিত প্রজাতির পাখি এবং জলজ প্রাণীর আবাসস্থল। আদিম ও শান্তিপূর্ণ এলাকাটি স্থানীয় জেলেদের আয়ের উৎস। কেননা এটি জেলেদের জন্য একটি বৃহৎ মৎস্য আহরণস্থল হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু ১৯৮৯ সালের ২৪ মার্চের পর এখানকার জীবন-জীবিকা চিরতরে বদলে যায়। কারণ তা ছিল মানবসৃষ্ট এক ভয়ানক বিপর্যয়। সেদিন প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে এক্সন ভালদেজ তেলবাহী জাহাজ থেকে অপরিশোধিত তেল ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে; এক্সন ভালদেজ আমেরিকান এক্সন শিপিং কোম্পানির মালিকানাধীন একটি সুপারট্যাঙ্কার লং বিচ শিপ, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডের ব্লাইগ রিফকে আঘাত করে। ফলে তেলবাহী জাহাজ থেকে অপরিশোধিত তেল ছড়িয়ে পড়ে। মোটামুটি ৪১ মিলিয়ন লিটার (১১ মিলিয়ন গ্যালন) তেল সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। পরে কয়েক দিনে ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন গ্যালন (৩৭ হাজার টন) তেল ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে সমুদ্রের পানি বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে হাজার পাখি, ওটার, শত শত সামুদ্রিক শিল এবং ঈগল বিপর্যয়ে পড়ে মারা যায়।

 

জন্স টাউনের বাঁধ বিপর্যয়

 মে ৩১, ১৮৮৯

১৮৮৯ সালের ঘটনা। তৎকালীন আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় জনপ্রিয় একটি ক্লাব ছিল। নাম ‘সাউথ ফর্ক ফিশিং অ্যান্ড হান্টিং’। কর্তৃপক্ষ প্রদেশটির জন্স টাউনের বাসিন্দাদের জন্য বিলাসবহুল এক লজ নির্মাণ করে। ধনী লোকেরা অবকাশযাপন, পশু শিকার এবং মাছ ধরার জন্য সেখানে প্রায়ই ভিড় জমাতেন। লজের পাশেই ছিল অসাধারণ একটি লেক। যার মনোরম পরিবেশ বরাবরই লোকদের টানত। আর লেকের পানি থেকে লজকে আলাদা করেছিল মাটির একটি বাঁধ। যদিও বাঁধটি ছিল মাটির তৈরি এবং অতিকায় দুর্বল। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কখনোই বাঁধটি মেরামত করা হয়নি। ফলাফল একই বছরের ৩১ মের ভয়াবহ বিপর্যয়। মে মাসের শেষ নাগাদ দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে লেকটির পানি বাঁধের ওপরে উঠে যায়। কর্তৃপক্ষ পানি বন্ধের চেষ্টা চালায় কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। দুর্ঘটনার দিন বেলা ৩টা ১০ মিনিটে প্রচন্ড গর্জনে বাঁধটি ভেঙে যায়। লেকের লাখ লাখ গ্যালন পানি ৬৪ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় (৪০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) বেগে লজ উপত্যকায় আছড়ে পড়ে। ফলে লজ উপত্যকা ঘরবাড়ি, প্রাণীকূল এবং গাছ ইত্যাদিতে বোঝাই হয়ে যায়। স্থানীয়রা আশ্রয়ের আশায় উপত্যকার উঁচু স্থানে উঠে পড়ে। কিন্তু সেখানে বোঝাইকৃত ঘরবাড়ি-গাছ গাছালির জটলায় আকস্মিক আগুন ধরে যায়। বিপর্যয়ে প্রায় ২২০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। জন্স টাউনের ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।  

 

হ্যালিফ্যাক্স জাহাজ বিস্ফোরণ

ডিসেম্বর ৬, ১৯১৭

একে বলা হয় হ্যালিফ্যাক্স, নোভা স্কটিয়ার বন্দর বিপর্যয়। নরওয়েজিয়ান জাহাজ এস এস ইমো এবং ফরাসি বাষ্পচালিত জাহাজ এস এস মন্ট ব্লাঁ-এর মধ্যকার সংঘর্ষের ফলে ইতিহাসের বৃহত্তম এই অপারমাণবিক মহাবিস্ফোরণটি ঘটেছিল। যদিও এর আগে বিপদের আশঙ্কায় মাউন্ট ব্লাঁ জাহাজ থেকে হুঁশিয়ারি সংকেত দেওয়া হয়েছিল। তাতে লাভ হয়নি। জাহাজ দুটি খুব কাছাকাছি অবস্থান করায় সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। মন্ট ব্লাঁ জাহাজটি ২ হাজার ৯৩৫ টন বিস্ফোরক বহন করছিল। সংঘর্ষের ফলে জাহাজে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়লে তা ব্যাপক শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে বিশাল এক জলোচ্ছ্বাস তীরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চলে আঘাত হানে। এতে হলিফ্যাক্সের সৈকত থেকে উত্তরে ৮০০ মিটার বিস্তৃত অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিস্ফোরণে জাহাজ দুটি চ্যাপ্টা হয়ে যায়। তীরবর্তী গাছপালা ভেঙে যায় এবং হ্যালিফ্যাক্স বন্দর ধ্বংসাবশেষের স্তূপে পরিণত হয়। সব মিলিয়ে সেদিন প্রায় ২ হাজার নিহত এবং ৯ হাজার আহত হয়েছিল।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর