বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

সোমালিয়ার জলদস্যু

আবদুল কাদের

সোমালিয়ার জলদস্যু

সোমালিয়া, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত একটি রাষ্ট্র। দেশটি পৃথিবীর দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। চিরকাল দারিদ্র্যের শিকার দেশটি। আর দেশটির দারিদ্র্যের প্রধান কারণ হলো গৃহযুদ্ধ। যাতে বাড়তে থাকে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট; যা নব্বইয়ের দশকে চরম আকার ধারণ করে।  ফলশ্রুতিতে সোমালিয়া তীর-উপকূলে জলদস্যুতার উত্থান ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে এসে তা সমুদ্রপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সোমালিয়ার জলদস্যুতা ও তার বিভীষিকাময় ইতিহাস নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন...

 

সোমালিয়ান জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ

বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’। সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ। বাণিজ্যিক কাজের জন্য জাহাজটি প্রায়শই দেশ-বিদেশের বন্দর দাপিয়ে বেড়ায়। সম্প্রতি ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী এই জাহাজটি। এটি একটি বাল্ক ক্যারিয়ার। জলদস্যুরা স্পিডবোট নিয়ে জাহাজটির চারদিকে ঘিরে ফেলে। একদল জাহাজে উঠে পড়ে। সবার হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র। জাহাজের সবাই আতঙ্কিত। দুপুর দেড়টায় জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন মালিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। জলদস্যুদের কাছে জিম্মি হয় ওই জাহাজের ২৩ নাবিকের সবাই। জানা গেছে, জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর জাহাজটি মোজাম্বিকের কাছাকাছি অবস্থান করছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুর দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, ‘জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে জলদস্যুদের।’ জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণের খবর পেয়েই শিপিংয়ের কর্মকর্তারা যে কোনো মূল্যে তা ঠেকানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এর ১৫ মিনিট পরই ক্যাপ্টেনের একটি ই-মেইল বার্তা আসে চট্টগ্রামে। তাতে তিনি জানান, জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়ে ফেলেছে।

জিম্মি জাহাজ থেকে গোপনে অডিও বার্তাও পাঠিয়েছেন চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান। অডিও বার্তা থেকে জানা যায়, জাহাজটিতে খাবার পানির পরিমাণ কম। আবার জাহাজে যেসব কার্গো রয়েছে সেগুলোও বিপজ্জনক। রয়েছে অগ্নিঝুঁকিও। অডিও বার্তায় আরও জানা যায়, আমাদের জাহাজে ২০-২৫ দিনের রসদ (খাবার) আছে। ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি আছে। আর জাহাজে রয়েছে ৫৫ হাজার টন কয়লা। সোমালিয়ান জলদস্যুরা জাহাজে ওঠার পর কার সঙ্গে কী আচরণ করেছে তাও বর্ণনা করেছেন ওই অফিসার। জানা গেছে, জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই জলদস্যুরা সেটিকে সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যায়। এটি এখন সোমালিয়ার বন্দরে রয়েছে। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাই আসছিল জাহাজটি। ২০১৬ সালে তৈরি জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। প্রথমে জাহাজটির নাম ছিল ‘গোল্ডেন হক’। বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’।

 

প্রায় দেড় বছর জিম্মি ছিলেন বাংলাদেশি নাবিকরা

বাংলাদেশি কোনো জাহাজের সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আরব সাগরেই সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে অন্য একটি জাহাজ এমভি জাহান মনি। জাহাজটি ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়া থেকে যাত্রা করেছিল। সিঙ্গাপুর বন্দরে যাত্রাবিরতি করে এবং ২৭ নভেম্বর গ্রিসের উদ্দেশে রওনা হয়। এক মাসেরও বেশি সময় ২৫ নাবিক ও প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীসহ মোট ২৬ জন মানুষ সমুদ্রে ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে ছিনতাই হয়েছিল জাহাজটি। এরপর জাহাজটিকে সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দেয় জলদস্যুরা। জাহাজটি ১১ ডিসেম্বর সোমালিয়ার উপকূলের কাছে নোঙর করেছিল। পরবর্তীতে নানা প্রক্রিয়া শেষে ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

 

সোমালীয়রা কেন জলদস্যুতা বেছে নেয়?

সোমালিয়ানরা পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র জাতিগুলোর মধ্যে একটি। যাদের দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক অনৈক্যের ইতিহাস অনেক দিন আগের। এক কথায়, সোমালীয়রা চিরকাল দরিদ্রতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিল। এডেন উপসাগর বাণিজ্য জাহাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কারণ এটি ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে বাণিজ্যের অনুমতি দেয়। ফলে বিদেশি জাহাজগুলো এই অঞ্চল থেকে বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে এসব এলাকার জেলেরা মাছ আহরণ করতে পারতেন না। এমনকি সোমালিয়ার মাটি অনেকটা পাথুরে এবং কৃষিকাজের জন্য সম্পূর্ণ অনুর্বর। তাই এখানকার বাসিন্দাদের নিজেদের ভরণপোষণ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। পাশাপাশি ১৯৮৬ সালে সোমালিয়ান বিপ্লবের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। গৃহযুদ্ধে জড়িত ও বিদ্রোহী বাহিনীর অনেক সদস্য বিভক্ত জাতিকে নিয়ে যুদ্ধে অর্থায়নের জন্য এডেন উপসাগরে জলদস্যুতা শুরু করে। সেই থেকে ইউরোপীয় জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র উপকূল থেকে মাছ ধরত এবং বর্জ্য ফেলত। তাদের বিতাড়িত করতে সোমালিয়ান উপকূলবাসী ট্রলার এবং স্পিডবোট নিয়ে সাগরে নেমে পড়ে। কিন্তু এসব জাহাজকে তারা তাড়াতেও পারছিলেন না এবং শুল্কও বসাতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে বর্জ্য ফেলতে আসা কিছু জাহাজকে আটকে ফেলে ওই উপকূলবাসী সোমালিয়ানরা। এরপর থেকে তাদের মনে জলদস্যুতার নব ধারণা জন্ম নেয়। এ ধারণা থেকেই কিছু জেলে হাতে অস্ত্র তুলে নেন। তাদের থেকেই আধুনিক যুগের সোমালিয়ান জলদস্যুদের উত্থান। সমুদ্রে মাছ ধরার সুবাদে জেলেরা সাগরের আদ্যোপান্ত জানতেন। আর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সোমালিয়ান কিছু কোস্ট গার্ড বা সেনাবাহিনী। এদের সমন্বয়ে জলদস্যু দল তৈরি হয়। জলদস্যুরা আজও বিদ্যমান এবং তাদের ক্ষমতা বেড়ে চলছে, তাদের জলদস্যুতা ছড়িয়ে পড়ছে ভারত পর্যন্ত।  যদিও জলদস্যুতা একটি অপরাধ তবুও এর মাধ্যমে প্রচুর অর্থের জোগান হয়। কারণ জলদস্যু বাহিনীগুলো আন্তর্জাতিক ক্র্যাকডাউন থেকে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে গেছে।   আর তাদের শিগগিরই যে কোনো সময় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

 

কীভাবে জলদস্যুরা কাজ করে থাকে

প্রারম্ভিক দিনগুলোতে, কয়েকটি বন্দুকসহ জলদস্যুরা জাহাজের কাছে যাওয়ার জন্য মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার করত। তারপর কেবল বোর্ডে আঁচড়ানো বা দড়ি ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করত। পরবর্তীতে তারা আদায়কৃত মুক্তিপণ থেকে অর্থ অর্জনের পাশাপাশি স্পিডবোট, ট্র্যাকিং ডিভাইস এবং শক্তিশালী অস্ত্র কেনে। সাধারণত তারা ‘মাদার শিপ’ লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। তারপর কয়েকটি স্পিডবোট নিয়ে জাহাজের উভয় পাশ ঘিরে ফেলে। হুক বা মই দিয়ে জাহাজে উঠে অবস্থানরত নাবিক এবং ক্রুদের জিম্মি করে। এক্ষেত্রে জলদস্যুরা কখনো কখনো নাবিকদের ভয় দেখানোর জন্য গুলি চালায়। প্রায়শই জাহাজে সমুদ্রে জিগজ্যাগিং বা জলদস্যুদের স্প্রে করার মতো প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন অনুসারে বেশির ভাগ জাহাজের নাবিকরা নিরস্ত্র হয়ে থাকেন। তাই যে কোনো দেশেই জলদস্যুরা জাহাজে উঠলে কিংবা জিম্মি করলে নাবিকরা সাধারণত দ্রুত আত্মসমর্পণ করে।

 

কারা সোমালীয় জলদস্যু?

আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় একটি দেশ সোমালিয়া। দেশটির কথা এলেই সবার আগে চোখে পড়ে এখানকার জলদস্যুদের বর্বরতার কথা। যারা সমুদ্রপথে জাহাজ অপহরণ থেকে শুরু করে জাহাজের নাবিক এবং ক্রুদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের (জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ন্যাটো) পদক্ষেপে সোমালিয়ার উপকূলে জাহাজ চলাচলের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যদিও এসব সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও অঞ্চলটিতে জলদস্যুতার ঘটনা থেমে নেই। বন্ধ হয়নি সোমালিয়ানদের জলদস্যুতা। অপহরণ ও সহিংসতার জন্য বিশ্বে সোমালিয়ার জলদস্যুরা সোমালিয়া উপকূলের সমুদ্রপথে বড় এক আতঙ্ক। কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা না থাকায় অভ্যন্তরীণভাবে তাদের বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। প্রকৃত অর্থে দেশটির বিস্তৃত উপকূলজুড়ে জলদস্যুতার ঘটনাকে গোপনে সেখানকার জনগণ থেকেও সমর্থন জানানো হয়। ১৯৯১ সালে সোমালীয় সরকারের পতন ঘটে। এরপর ভয়ানক গৃহযুদ্ধ ও নতুন সরকারের অদক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে দেশটিতে আধুনিক জলদস্যুতা দেখা দেয়। এই জলদস্যু বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই সোমালীয় যুবক। ২০১০ সালে সোমালীয় সরকারের প্রকাশিত তথ্যে জলদস্যুদের ৮০ শতাংশই সোমালিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের বিবাদপূর্ণ অংশের বাসিন্দা। আর মাত্র ২০ শতাংশ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল উত্তরাঞ্চলের। বিবিসির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, সোমালীয় জলদস্যুরা মোট তিন আগে বিভক্ত। এক. উপকূলের জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন। এরাই মূলত দস্যু চক্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য। দুই. সাবেক সেনা কর্মকর্তা। যারা দেশটির পূর্ববর্তী সরকার বা স্থানীয় সম্প্রদায়ের হয়ে যুদ্ধ করা সাবেক সৈনিক বা সেনা কর্মকর্তা এবং তিন. প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দল। এরা মূলত জলদস্যুদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, অভিযান পরিচালনার সময় জলদস্যুদের প্রতিটি দলে এই তিন ধরনের সদস্যরা থাকে। ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ হিসেবে পরিচিত জলভাগের সুবিধাজনক অঞ্চলে থাকায় সোমালীয় জলদস্যুরা চাইলে ওই পথে চলাচলকারী সব নৌযানকে আক্রমণ করতে পারে।

 

সেই ১৯৯৫ সালে শুরু

১৯৯৫ সাল, উপকূলে অবৈধ জাহাজের অনুপ্রবেশ রোধে চলছে নজরদারি।  স্থানীয় জেলেদেরই কটি দল পালন করছে এ দায়িত্ব। তবে ছোট নৌকা করে এসব গতিদানবের কাছাকাছি যেতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এমনি এক দিন আচমকা অদূরে ভেসে থাকা একটি জাহাজের দেখা মিলল। দেরি না করে তারাও নৌকায় করে জাহাজটিকে ঘিরে ফেলতে সমর্থ হলো। নিয়ে এলো ডাঙার কাছাকাছি। জিম্মিকৃতরা শর্তমতো ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানে সম্মত হলো।

জলদস্যুদের রাজধানী

একদিকে ভারত মহাসাগরের নীল উষ্ণ জলের আচ্ছাদিত প্রাচীন শহর অন্যদিকে বৃহৎ নুগাল পর্বত- ইয়েল (Eyl) শহরটি সোমালিয়ার জলদস্যুদের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। এক সময়ের প্রাচীন শহরটি এখন ভীষণ কঠিন সময় পার করছে। এই শহরের উপকূলজুড়ে জাহাজের বিষাক্ত বর্জ্য (ক্রুড অয়েল, নানা বর্জ্য তেল) ছড়িয়ে পড়া এবং বিদেশি ট্রলারের মাধ্যমে অবৈধভাবে মাছ আহরণ করার কারণে- এখানকার সমুদ্র অনেকটা মৎস্যহীন হয়ে পড়েছে। এর বাইরেও সোমালিয়ার মাটি অনেকটা পাথুরে এবং কৃষিকাজের জন্য সম্পূর্ণ অনুর্বর। তাই এখানকার বাসিন্দাদের ভরণপোষণ সম্পর্কে কোনো প্রকার ধারণাই নেই। ফলে উপার্জনের একমাত্র মাধ্যমই হলো জলদস্যুতা। প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দার এই শহরে প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িত। আজকের দিনেও হাজার হাজার জলদস্যু সোমালিয়া এবং তার উপকূলে কাজ করছে, যদিও কতজন আছে তার সঠিক কোনো সংখ্যা নেই।

 

জলদস্যুতা বৈধ না অবৈধ

আমরা সাধারণত জলদস্যুতাকে অবৈধ পেশা হিসেবেই ধরি। কিন্তু সোমালিয়ায় এ পেশা এতই আকর্ষণীয় যে, ওখানকার মানুষ রীতিমতো জলদস্যু হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ কারণে সেখানে এ পেশাটি বৈধ। এর কারণ হিসেবে তারা বিদেশি জাহাজের মাধ্যমে অবৈধভাবে মাছ ধরা এবং বর্জ্য ফেলাকে দায়ী করে থাকে। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, এমন সোমালীয় জলদস্যুরা নিজেদের এ কার্যক্রমকে অবৈধভাবে মাছ ধরা জাহাজ এবং বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেখে। এসব কারণে বহু অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরাও জলদস্যুদের দলে যোগ দেয়। অভিযোগগুলো যদিও বেশ গ্রহণযোগ্য। কারণ জাতিসংঘ অনুমান করে যে, ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে অবৈধ মাছ ধরার কোম্পানিগুলো বছরে সোমালীয় উপকূলরেখা থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হলুদ টুনা আহরণ করে। এ ছাড়া উপকূলে চলাচলকৃত জাহাজগুলো থেকে নিঃসৃত বর্জ্য সাগরের পানি দূষিত করে। আর এসব বর্জ্য সোমালিয়ার উপকূলে গিয়ে জড়ো হয়ে উপকূল ভরে ফেলছে।

 

আধুনিক জলদস্যুতার উত্থান

১৬৫০ থেকে ১৭৩০ পর্যন্ত জলদস্যুদের দাপট ছিল সবচেয়ে বেশি। আওরঙ্গজেবের আমলেও দলবল সমেত মুঘল সেনাপতি শায়েস্তা খাঁর হাতে ধরা পড়েছিলেন জলদস্যু সেবাস্তিয়ান গঞ্জালেস। ইতিহাসের সেই কাহিনির পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে আজকের দিনেও। সময় যত এগিয়েছে জল থই থই সাগরে যাদের অবাধ বিচরণ, সেই জলদস্যুদের কাহিনির প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। তবে সেকেলে কাহিনিগুলো মোড় নিয়েছে আজকের আধুনিক জলদস্যুতায়। তৎকালীন জলদস্যুতার জন্য ব্যবহার হতো নৌকা, তীর-ধনুক, তলোয়ার। তবে আজকের আধুনিক বিশ্বে এসব জলদস্যুদের হাতে আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজ-সরঞ্জাম। স্টিলের পাতের ছোট নৌকাগুলোর সঙ্গে এঁটে দেয় শক্তিশালী ইঞ্জিন, পাল্টে দেয় ক্ষিপ্রগতির আক্রমণাত্মক যুদ্ধযানে। আধুনিক জিপিএস প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বাণিজ্যিক জাহাজের রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে কাজে লাগাায় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের দল। আক্রমণের জন্য বেছে নেয় গভীর রাত থেকে ভোরের সময়টা। তাতে ব্যবহৃত হয় RPG-7, TT33, Type56, AK47, AKM, RPK, PK ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র। এ ছাড়া ব্যবহৃত হয় F1 ও RGD-5-এর মতো হাতবোমাও!

 

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে জলদস্যুতা

সমগ্র বিশ্বে সোমালিয়ার জলদস্যুতার কুখ্যাতি রয়েছে। আর বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোও বেশ উদ্বিগ্ন। সিএনবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (UNSC) অনুসারে- সোমালিয়ার উপকূলে নৌচলাচলের স্বাধীনতা কার্যকর করার জন্য জলদস্যুতাবিরোধী পদক্ষেপগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর সর্বশেষ পুনর্নবীকরণের পর একেবারে নিঃশব্দে এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মেরিটাইম সিকিউরিটি ফার্ম অ্যাম্ব্রের মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের প্রধান বিশ্লেষক ড্যান মুলারের মতে, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে, সোমালি জলদস্যুতা সংক্রান্ত ঘটনায় প্রায় ২০ শতাংশই বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজ। ২০২৩ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অনেকগুলো পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রধান শিপিং লেন অর্থাৎ সমুদ্রপথগুলোয় জলদস্যুতা বাড়ছে। আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) বার্ষিক জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে সামুদ্রিক জাহাজের বিরুদ্ধে ১২০টি জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে এমন ঘটনা দেখা গিয়েছিল ১১৫টি। আইএমবি ক্রু সুরক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান           হুমকি হিসেবেও  দেখছে। ২০২৩ সালে ক্রুদের জিম্মি করা ৪১ থেকে ৭৩ শতাংশ বেড়েছে এবং ক্রু অপহরণ হয়েছে ২ থেকে ১৪ শতাংশ।

 

জলদস্যুদের পরিণতি

সোমালিয়ার জলদস্যুরা হয়তো পৃথিবীবাসীর ক্ষতি করছে না, কিন্তু এমন কর্মকান্ডে কোনো নির্দিষ্ট দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে দেশের বাণিজ্যে প্রভাব পড়ছে। এজন্য জলদস্যু মোকাবিলায় পৃথিবীর সব দেশের মাথাব্যথা নেই, তবে ভুক্তভোগী দেশগুলোর ঠিকই আছে। আর জাতিসংঘও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও সোমালিয়ায় জলদস্যুতা বন্ধ হচ্ছে না। দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের অভাবের কারণে, কোনো অভ্যন্তরীণ কর্তৃপক্ষ জলদস্যুদের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। বিশেষত আল-শাবাব, আল-কায়েদার মতো ইসলামী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সোমালিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। সোমালিয়ার বৃহৎ উপকূলরেখা বরাবর এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো স্থানীয়দের সমর্থন পেয়েছে। তবে বিশ্বের নানা প্রান্তে জলদস্যুদের গ্রেফতারের ঘটনাও রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে জলদস্যুতার জন্য ১৩০০-এর বেশি সোমালি যুবক বিদেশে কারাগারে বন্দি হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগকে জেলে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ২০১৫ সালে আল জাজিরাকে বলেছিল যে, ১৪০০ এর বেশি ‘জলদস্যু এবং সন্দেহভাজন জলদস্যু’ ২১টি দেশে আদালতে বা কারাগারে রয়েছে। বিদেশে কারাগারে যাদের পরিবারের সদস্যরা আছেন তারা জলদস্যুতার জন্য আটককৃতদের প্রত্যাবাসনের আহ্বান জানাচ্ছে, যাতে তারা সোমালিয়ার কারাগারে সাজা ভোগ করতে পারে। তারা যেন তাদের প্রিয় মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে পারে।

সর্বশেষ খবর