সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি বিপদ ডেকে আনবে

তানভীর আহমেদ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি বিপদ ডেকে আনবে

অহরহ মিলছে নায়িকা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অপ্রীতিকর ভুয়া ভিডিও বোঝার উপায় নেই কোনটা আসল কোনটা নকল

চাইলেই নকল করা যায় মানুষের চেহারা, কণ্ঠস্বর সব!

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বর্ণযুগের দিকে পা বাড়াচ্ছে বিশ্ব। কথা এখানেই শেষ নয়। সঙ্গে যোগ করছেন, মহামারি কিংবা পারমাণবিক বোমার মতোই ভয়ংকর রূপে ব্যবহার হতে পারে এ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এরই মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বাংলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহারের নমুনা দেখে চোখ কপালে উঠেছে সবার। হুবহু যে কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর নকল করছে ভয়েস ক্লোনিং নামের প্রযুক্তি। এর জন্য কাউকে মাত্র কয়েক মিনিট তার কণ্ঠের রেকর্ডিং করে দিতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে সফটওয়্যার জেনে যায় তার কণ্ঠের আওয়াজ, তার বাচনভঙ্গি- কীভাবে ওই ব্যক্তি কথা বলেন। এ সফটওয়্যার আপনার কণ্ঠস্বরের সব বিশেষত্ব জেনে নেওয়ার পর আপনি যখন কম্পিউটারের কিবোর্ডে কোনো শব্দ বা বাক্য লিখবেন সেটা হুবহু আপনার গলার আওয়াজে উপস্থাপন করবে। শুনলে মনে হবে আপনিই সরাসরি কথা বলছেন। অপরাধীদের কাছে এ সফটওয়্যার যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য তৈরি হচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। শুধু কণ্ঠস্বর নয় এখন গোটা মানুষের ভিডিও নকল করা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। ডিপফেক নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইছে দেশে দেশে। ডিপফেক প্রযুক্তি হলো এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে নকল ভিডিও তৈরি হয়, অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আপনার মুখের সঙ্গে অন্য কোনো ব্যক্তির শরীর জুড়ে দিয়ে ভিডিও বানানো হয়। এ প্রযুক্তি দিয়ে হুবহু নকল ভিডিও বানানো সম্ভব হচ্ছে। মেশিন লার্নিং প্রয়োগের মাধ্যমে দিন দিন নিখুঁতভাবে নকল ভিডিও বানানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে অভিনেত্রী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেলিব্রেটি অনেকেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকের নগ্ন ছবি, ভিডিও, অডিও বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন সাইবার অপরাধীরা। বলিউড নায়িকাদের নগ্ন ভিডিও, নাচ-গান রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেওয়া হয় অনলাইনে। প্রথম দেখায় বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারেননি এসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর পক্ষে এ ভিডিও যে মিথ্যা সেটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, যদি না এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন। ডিপফেক ভিডিও এতটা নিখুঁত হয় যে ভুক্তভোগীর পক্ষে সমাজকে বোঝানো তো দূরের কথা, নিজের পরিবারকেও বোঝানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এমনকি এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি, যা দিয়ে সাধারণ মানুষ ডিপফেক ও অরিজিনাল ভিডিওর পার্থক্য বুঝবেন।

 

ভুল ও বানোয়াট তথ্য দেওয়া, পাসওয়ার্ড চুরি করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রযুক্তিসেবা পাওয়া যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেন তো বটেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইনে ব্যক্তিগত ছবি, তথ্য- সবকিছুই থাকে। এগুলো সুরক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড। সেই পাসওয়ার্ড চুরির কাজও করা যাচ্ছে এআই দিয়ে। কিবোর্ডের টাইপের শব্দ শুনে পাসওয়ার্ড চুরি করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। অনলাইন জুম মিটিংয়ের সময় যন্ত্রের মাইক্রোফোন এবং কিবোর্ড টাইপ করার শব্দ শুনে এটি পাসওয়ার্ড চুরি করতে সক্ষম। জুম অ্যাপটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিবোর্ড টাইপ করার শব্দ শুনেই ৯৩ শতাংশ পাসওয়ার্ডই নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে এআই। স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে কাজটি করছে মাইক্রোফোন ব্যবহার করে। মাইক্রোফোন ব্যবহার করে স্মার্টফোনের প্রায় ৯৫ শতাংশ পাসওয়ার্ড সঠিকভাবে শনাক্ত করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ বছরের শুরুতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ গ্লোবাল রিস্কস প্রতিবেদনে বলা হয়- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে সৃষ্ট ভুল তথ্য বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠছে। চাটজিপিটিসহ অন্যান্য এআই প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বর্তমানে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। এআইভিত্তিক বানোয়াট কনটেন্ট সাধারণ মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে সক্ষম। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো- এআইয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট এসব ভুল, মিথ্যা বা বানোয়াট তথ্য আগামীতে সামাজিক বিভক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

 

চাকরি ছাড়ার আগে এআই গডফাদারের সতর্কবার্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপজ্জনক

তার নাম জিওফ্রে হিন্টন। এআই মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের গডফাদার বলা হয় তাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবিশ্বাস্য উত্থানের পেছনে যে কজনের নাম প্রথমেই আসে তাদের একজন তিনি। গুগলে চাকরি করতেন। প্রায় এক দশক ধরে গুগলের এআই উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য কাজ করেছেন তিনি। গত বছর গুগল ছাড়ার সময় তার মন্তব্য গোটা বিশ্বের প্রধান মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রকাশ হয়। তিনি বলেন, ‘আমি গুগলের চাকরি ছেড়েছি যাতে শুধু গুগল নয়, অন্য সব প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এআই কীভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তা ব্যাখ্যা করতে পারি।’ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে হিন্টন বলেন, ‘আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিই যে, আমি না করলেও অন্য কেউ এটা করত।’ এর পরই গুগলের প্রধান বিজ্ঞানী জেফ ডিন বলেছেন, ‘সাহসিকতার সাথে উদ্ভাবন করার পাশাপাশি আমরা এআই-এর নতুন ঝুঁকিগুলোও বুঝতে শিখছি।’ বাজারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এআই চ্যাটবট জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকেই এ ঝুঁকিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে এআই চালিত চ্যাটজিপিটির ভুল তথ্য প্রচার করা বিষয়টি সে সময় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। তারপরই প্রযুক্তিজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তি ‘সমাজ এবং মানবতার জন্য গভীর ঝুঁকি’ উল্লেখ করে ছয় মাসের জন্য এআই সিস্টেমের প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে এআই ল্যাবগুলোর জন্য এক চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।

 

এআই নিয়ে কাজ করা ৩৫০ জন ইঞ্জিনিয়ার গবেষক ও নির্বাহীর খোলা চিঠি

মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এআই

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় উদ্বিগ্ন খোদ প্রযুক্তিবিদরাই। এআই নিয়ে কাজ করেন এমন নেতৃস্থানীয় প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এআই। ৩৫০ জনেরও বেশি ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক ও নির্বাহী এ বিষয়ে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। তাদের মতামত হলো- তারা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি তৈরি করছেন সেটি মহামারি এবং পারমাণবিক যুদ্ধের মতো বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রয়েছেন তিনটি নেতৃস্থানীয় এআই কোম্পানির প্রধান নির্বাহীরা- ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যামুয়েল অল্টম্যান, গুগল ডিপমাইন্ডের প্রধান নির্বাহী ডেমিস হাসাবিস এবং অ্যানথ্রোপিকের প্রধান নির্বাহী ডারিও আমোদেই ছিলেন। লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি বা বার্ডের মতো চ্যাটবটগুলো। অনেকেই আশঙ্কা করছেন ভবিষ্যতে এ লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল ভবিষ্যতে ভুয়া তথ্য ও প্রপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হবে। এমনকি কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির হার যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনা হয় তাহলে এটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে, কয়েক বছরের মধ্যে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। মার্কিন সিনেটের শুনানিতে ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি এ প্রযুক্তি যখন খারাপ কিছু করে তখন তা আরও বেশি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’ ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী বলেন, এআই কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য একটি নতুন সংস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ছাড়া গণতন্ত্রের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কেও নিজের উদ্বেগ জানান তিনি। সেন্টার ফর এআই সেফটির নির্বাহী পরিচালক ড্যান হ্যান্ড্রিকস বলেন, ‘নিজেরা যে প্রযুক্তি তৈরি করছেন, তার ঝুঁকি নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন।’

সর্বশেষ খবর