সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

এখনো টিকে আছে যেসব প্রাচীন শহর

এখনো টিকে আছে যেসব প্রাচীন শহর

প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর নানা দেশ কিংবা অঞ্চলে-অসংখ্য শহর, নগর, বন্দর গড়ে উঠেছে। এসব নগরী মানবসভ্যতা বিকাশের পাশাপাশি প্রাচীন আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।  পৃথিবীজুড়ে এমন অসংখ্য শহর-নগর রয়েছে, যা প্রাচীনকাল থেকে আজও বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে...

 

৬৩০০ বছরের পুরনো প্রাচীন শহর

এটি সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর। এমনকি প্রাচীন নগরী (আলেপ্পো) মুহাফাজার (সিরিয়ার প্রদেশের) রাজধানী। এটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত শহর। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে প্রায় ৩১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ আলেপ্পো নগরীর মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ২০০। এটি পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যেও অন্যতম বড় শহর। শতাব্দীকাল ধরে আলেপ্পো সিরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল এবং ইস্তাম্বুল ও কায়রোর পরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ছিল। আলেপ্পো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর। অনেকে দাবি করেন ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্ব থেকে মানুষ আলেপ্পোতে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন এ নগরীটিতে রয়েছে প্রায় ৬৩০০ বছরের বেশি পুরনো ইতিহাস। সিরিয়ার তেল-আস-সাওদা এবং তেল-আল-আনসারি শহরে খনন কাজের মাধ্যমে অনেকে দাবি করেছেন আলেপ্পোতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে মানুষ বসবাস করছে। তৎকালীন সময়ে আলেপ্পো বাণিজ্যিক এবং সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই উৎকর্ষ সাধন করেছিল। বিখ্যাত শহরটির এমন দীর্ঘ ইতিহাসের পেছনে রয়েছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। শহরটি ভূ-মধ্যসাগর ও মেসোপটেমিয়ার মাঝে বৈদেশিক বাণিজ্যের সহায়ক।

 

দামেস্ক

১২০০০ বছরের পুরনো প্রাচীনতম নগরী

এটি সিরিয়ার রাজধানী। অনেকের দাবি, দামেস্কই পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। যদিও দাবির পক্ষে আজও কোনো জোরালো প্রমাণ মেলেনি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের তথ্যমতে, এ নগরীতে প্রায় ১২ হাজার বছর ধরে মানুষের বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, পম্পেই থেকে শুরু করে খালেদ ইবনে ওয়ালিদের মতো বিজেতারা ইতিহাস গড়েছিলেন এখানে। তাই সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু দামেস্কের নাম উঠে আসবে না এমনটা কল্পনা করাও দুরূহ ব্যাপার। আলেপ্পোর মতো দামেস্কেও একই সময় জনবসতি গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, খ্রিস্টপূর্ব ১০ হাজার বছর আগে মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করে। ইসলামী ইতিহাসে এই শহরের বিশেষত্ব অনেক। প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রা.) দামেস্ক থেকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে পুত্র ইয়াজিদের কাছে শাসনভার অর্পণ করে খিলাফত ব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্রের সূচনা করেন।

 

আর্বিল

৪৩০০ বছরের পুরনো দীর্ঘ মানববসতি

আর্বিল উত্তর ইরাকের প্রাচীন শহর। যা আর্বিল প্রদেশের রাজধানী। মসুল শহরের কাছে অবস্থিত নগরীটি প্রায় ৪ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। সুমেরীয়রা খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মানববসতি। সুমেরীয়রা একে উর্বিলুম নামে ডাকতেন। শুরু থেকেই এটি প্রাচীন আরবের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আর্বিলের কাছে গাউগামেলা নামের এক গ্রামে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে মহাবীর আলেকজান্ডার পারস্যের রাজা তৃতীয় দারিউসকে পরাজিত করেন। বর্তমানে এটি ইরাকের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ কুর্দি অধ্যুষিত শহর। নব্বই দশকে এ শহরে গৃহযুদ্ধ বাধে। কুর্দীয় বিভিন্ন গোত্র পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৯৬ সালে কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (কেডিপি) নেতারা সাদ্দাম হোসেনকে গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানালে সাদ্দাম এখানে ৩০ হাজার সৈন্যের বহর পাঠান এবং কেডিপিকে এখানকার শাসনভার দিয়েছিলেন।

 

জেরুজালেম

৫০০০ বছরের পুরনো লেবানিজ বন্দর

ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক শহর জেরুজালেম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় গুরুত্ব মিশে রয়েছে এ শহরের সঙ্গে। মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে পবিত্র ভূমি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে জেরুজালেম। ধর্মীয়ভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জেরুজালেমে রয়েছে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস। ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা এ অঞ্চলকে টেম্পল মাউন্ট নামেও ডাকে। জেরুজালেমে মুসলমানদের পবিত্র আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত, যা মুসলমানদের স্মৃতিবিজড়িত এবং সেখানে অনেক নবী এবং সাহাবার কবর রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছেও জেরুজালেমের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। বেথেলহামে যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেন বলেই তারা বিশ্বাস করেন। বাইবেলে বর্ণিত এই বেথেলহাম রয়েছে জেরুজালেম শহরের দক্ষিণাংশে। এ জায়গাটি খ্রিস্টানদের কাছে তাই ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া জেরুজালেমে ইহুদিদের পবিত্র ওয়েলিং ওয়াল অবস্থিত।

 

এথেন্স

৩৫০০ বছরের পুরনো গণতন্ত্রের জন্মশহর

গ্রিক সভ্যতার সূচনালগ্নে অনেক পাহাড়ের কারণে ইউরোপের গ্রিস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে এখানে অনেক নগররাষ্ট্র তৈরি হয়। তবে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা এবং পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা ও কোরিন্থ। এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস। এদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিল গ্রিসের খ্যাতনাম শহর এথেন্স। পর্যটকদের আকর্ষণের শীর্ষে থাকা শহরটি প্রায় ৩৫০০ বছরের পুরনো। এ শহরকেই বলা হয় গণতন্ত্রের জন্মশহর। এ শহরের পরতে পরতে মেখে আছে মহাবীর ও জ্ঞানীদের পদচারণ। রয়েছে নানা মিথ। আছে নানা কালের ঐতিহাসিক স্থাপনা। মনোরম সব ভাস্কর্য যেন হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তাই বছরজুড়ে এখানে থাকে পর্যটকদের ভিড়। এ শহর সম্পর্কে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলেন, ‘How great are the dangers I face to win a good name in Athens’

 

সাংহাই

১১০০ বছরের পুরনো জনবহুল নগরী

বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল শহরের তালিকায় নাম রয়েছে চীনের সাংহাই। এটি ৯০০ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা করা হলেও এর রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। ৬০০০ বছর আগে এখানে জনবসতি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে শহরটিতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সাংহাইয়ের জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখের মতো। এর আগে ১৯৯০ সালে এর জনসংখ্যা ছিল ৭৮ লাখ ২৩ হাজারের কিছু বেশি। চীনের সবচেয়ে বড় শহর সাংহাই গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল হাব হিসেবেও পরিচিত। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার সূচিতে ২০১৬ সালে সাংহাইয়ের অবস্থান ছিল ১৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর এটি। বৃহৎ প্রশাসনিক, বন্দরনগরী এবং ব্যবসায়িক শহর হিসেবে সাংহাইয়ের গুরুত্ব বাড়তে থাকে উনিশ শতকের প্রথম দিকেই। এরপর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সমাজতান্ত্রিকতা বিস্তার লাভ করে এখানে।

 

ইস্তাম্বুল

২৫০০ বছরের পুরনো দুই মহাদেশের শহর

এটি তুরস্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাচীনকাল থেকেই তুরস্কের শহর ইস্তাম্বুল দুই মহাদেশের শহর হিসেবে পরিচিত। প্রায় আড়াই হাজার বছরের বেশি পুরনো এই শহরকে কিংবদন্তি নগরীও বলা চলে। প্রাচীনতম শহরটি দুই মহাদেশকে একত্রিত করেছে। এশিয়া ও ইউরোপকে একত্র করায়- একে বলা হয় ইউরেশিয়া, যার বিভাজন রেখা হলো বসফোরাস প্রণালি। এই প্রণালির অবস্থান প্রাচীন এ শহরে। শহরটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর একটি শহর। ইস্তাম্বুল ইউনেস্কোর তালিকায় ইউরোপের রাজধানী শহরের মর্যাদা পেয়েছিল ২০১০ সালে। এটাই একমাত্র শহর যার ভৌগোলিক অবস্থান দুই মহাদেশে। পরিকল্পিত শহরটি দেখতে স্বপ্নের জগতের মতো। এক সময় ইস্তাম্বুলই ছিল পৃথিবী শাসনকারী অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। বিখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেন, ‘গোটা পৃথিবীকে যদি একটি রাজ্য ভাবা হয়, ইস্তাম্বুল হবে তার রাজধানী।’

 

বৈরুত

৫০০০ বছরের পুরনো প্রাচীন সমুদ্রবন্দর

লেবাননের রাজধানী শহর বৈরুত। যা বিশ্ববাসীর কাছে বন্দরনগরী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত। এটি লেবাননের প্রধান শহর। যার জনসংখ্যা মাত্র ১৯ লাখ। প্রাচীন এ শহরটি ভূ-মধ্যসাগরের একটি উপদ্বীপে গড়ে উঠেছিল। যা লেবাননের সর্ববৃহৎ এবং প্রধান সমুদ্রবন্দর। যা লেবাননের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বৈরুতের অধীনে রয়েছে বেশ কিছু উপশহর। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম (১৫১২-১৫১৫)-এর অধীনে অটোমানরা বর্তমান লেবাননসহ সিরিয়া জয় করে। অটোমানদের শাসনামলে বৈরুত স্থানীয় ড্রুজ ইমির নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের মধ্যে একজন, দ্বিতীয় ফখর-আল-দীন। সতেরো শতকের গোড়ার দিকে তিনি অটোমানদের থেকে সুরক্ষিত করেছিলেন। কিন্তু ১৭৬৩ সালে অটোমানরা পুনরায় এটি দখল করে নেয়। জিজার পাশা এবং আবদুল্লাহ পাশার অধীনে অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উত্তর যুগে বৈরুত মাত্র ১০ হাজার জনসংখ্যার ছোট্ট শহর ছিল।

 

কায়রো

৪০০০ বছরের পুরনো নীলনদ নগরী

এটি বিশ্বের দশম জনবহুল শহর। মিসরের রাজধানী। প্রাচীনকাল থেকেই এ শহরে মানুষের বসবাস। নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা নগরীর সূচনা হয় একেবারে প্রস্তর যুগে। পরে এটি জলপথে যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধার্থে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কায়রো সত্যিকারের উন্নতির মুখ দেখে প্রথম ফারাও মেনেসের শাসনামলে। বিংশ শতাব্দীতে এসে সেতু এবং বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় কায়রোতে। এত সব উন্নতির কারণে এ নগরীর জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৯২৭ সালের মাথায় ১০ লাখেরও বেশি হয়ে যায়। বর্তমানে এখানে ১ কোটি ৮৪ লাখ ১৯ হাজার মানুষ বাস করে। ১৯৫২ সালে মিসরীয় বিপ্লবের সময়ে কায়রো এবং পুরো মিসরেই ঔপনিবেশিক শক্তির পতন ঘটে। পরবর্তীতে মিসরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মিসরীয়রা কায়রোতে চলে আসেন। এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতেই কায়রোকে আরও বড় করে তোলা হয়। এতে পুরনো কায়রো এবং নতুন কায়রো দুই অংশের সূচনা হয়।

সর্বশেষ খবর