শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও আনন্দবাজারে সাংবাদিকতা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও আনন্দবাজারে সাংবাদিকতা

এই বছর জানুয়ারির শুরুতেই ঢাকায় গিয়েছিলাম। ঢাকায় বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসের সামনে দেয়ালে বড় করে লেখা- স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারেন, দেখেন। তাঁর স্বপ্নের একটি ফল হলো- বাংলাদেশ প্রতিদিন। ১২২ বছর আগে ঠিক একই ধরনের স্বপ্ন দেখেছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকার মালিক সম্পাদক প্রফুল্ল কুমার সরকার।

দু’জনের উদ্দেশ্যই হয়তো এক ছিল। প্রফুল্ল সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি জেলও খেটেছিলেন। ঢাকায় কান পাতলেই শোনাযায় প্রতিদিনের মালিক একজন বড় মাপের শিল্পপতিও। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রতিদিন ১৫ বছরে পা দিচ্ছে। আনন্দবাজার ইতোমধ্যে সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। এখন আনন্দবাজারের বয়স ১০২ বছর।

প্রতিদিনের এই স্বপ্নদ্রষ্টা সম্পর্কে ১৫-২০ বছর আগেই নানা গল্প শুনেছি। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মুকুল বোসের কাছে। মুকুলবাবু আমাকে বলতেন, তিনি যখন ছাত্র-আন্দোলন করতেন, তখন এই স্বপ্নদ্রষ্টাই ছাত্রদের নানা ধরনের সহযোগিতা করতেন। আনন্দবাজারের চার প্রজন্মের প্রতি বাঙালি পাঠকদের খুবই আস্থা। প্রায় সাড়ে চার দশক ওই পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যারা পয়সা দিয়ে কাগজ কেনেন, সেই পাঠকদের সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতা করা সংবাদের মাধ্যমে।

প্রতিদিনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাও এক যুগ হয়ে গেছে। মরহুম পীর হাবিব একবার কলকাতায় এসে আমার নম্বর খুঁজে আমাকে ফোন করেছিলেন। সেদিন বিকেলেই তাঁর সঙ্গে আমার মধ্য কলকাতার একটি ক্যাফেতে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কথা হয়। সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ছাড়াও আমরা দুই দেশের রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি।

ঢাকায় ফিরে যাওয়ার দিন বিমান ছাড়ার ৫/৬ ঘণ্টা আগে পীর হাবিব আমার বাড়িতে আসেন। কথা প্রসঙ্গে আমার লেখা বই। ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে’ নিয়ে যান পীর হাবিব। সেই বইয়ের খানিকটা অংশ তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপেন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রফুল্ল সরকার আনন্দবাজার প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জীবিতকালে এবং তাঁর পরে অশোক সরকারও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। অর্থাৎ জনগণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।

প্রফুল্ল সরকারের মৃত্যুর পর মাখন সেন, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, চপলাকান্ত ভট্টাচার্য অল্প সময়ের জন্য সম্পাদক ছিলেন। আশোকবাবু এর পরে সম্পাদক হন। অশোকবাবু দীর্ঘকাল আনন্দবাজারের সম্পাদনাই করেননি, তিনি যে নীতি চালু করে গেছেন তা ১০২ বছর পরেও বহাল আছে। অশোকবাবু নীতি নিয়েছিলেন, তাঁর কোনো সাংবাদিক কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নামতে পারবেন না। তাহলে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।

অশোকবাবু কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে বইমেলায় যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সেরিব্রাল অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। সেখানেই তিনি মারা যান। বইমেলার উদ্যোক্তা ও আনন্দবাজারের যে সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা তাঁকে পাশেই এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যান। রেডিওতে এই খবর প্রচার হতেই হাসপাতাল চত্বরে ভিড় জমে গিয়েছিল। অশোকবাবুর সঙ্গে সে দিন দুপুরেই আমার দেখা হয়েছিল অফিসের গেটে। আমাকে বলেছিলেন, মেলা থেকে আপনি আমার গাড়িতে আসবেন। অনেক কথা আছে। আমার আফশোস, সেই কথা আর শোনা হয়নি। কোম্পানির চেয়ারম্যান অশোকবাবুর আত্মীয় কালাইলাল সরকার পরের দিন আমাকে বলেছিলেন, অশোক তোমাকে বলতে চেয়েছিল সিদ্ধার্থের অপশাসনের ব্যাপারে নতুন কিছু লেখার জন্য।

ভারতের সংবিধানে চতুর্থ স্তম্ভে সরকারের সমালোচনা করার পুরো অধিকার দেওয়া আছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও একইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আমার মনে আছে, আমি যেদিন আনন্দবাজারে যোগ দিয়েছিলাম সেদিন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সন্তোষ কুমার ঘোষ, চিফ রিপোর্টার শিবদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন আপনি লোক চাইছিলেন। এই নিন। এই একজনকে আমরা সিলেক্ট করেছি।

 

৭১ সালের ৭ মার্চের পর বাংলাদেশেও পাকিস্তানিদের অত্যাচারের হাত থেকে লাখ লাখ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। তাদের অত্যাচার দুরবস্থা দেখে আনন্দবাজার তাঁদের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা। সংবাদপত্র তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ রিপোর্ট করার জন্য। তার সুফলও আনন্দবাজার পেয়েছিল...

 

শিববাবু আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন- মদ খাও? আনন্দবাজার নিয়মিত পড়? তোমার একজন রিপোর্টার হিসেবে দায়বদ্ধতা কার প্রতি? কঠিন চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী বলব? জবাব না দিয়ে ভাবলাম, কোনটা বলব? শিবদা বললেন- শোন, তোমার দায়বদ্ধতা যারা ২৫ পয়সা দিয়ে আনন্দবাজার কিনে পড়েন, তাঁদের প্রতি। ভুল খবর, খাওয়ানো খবর, অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতারা যদি তোমাকে কোনো খবর দেয়, তাহলে তা ১০ বার যাচাই করে নেবে। তোমাকে এখন ছোটখাটো প্রেস কনফারেন্সে পাঠাব। চা দিলে খাবা, কিন্তু বিস্কুটটা খাবা না। আমি ভয় ভেঙে বললাম, বিস্কুটটা খাব না কেন? উত্তরে শিবদা বললেন, বিস্কুটটা খেলে আমাদের দায়বদ্ধতা  তৈরি হবে। তুমি যে কপি দেবে, তা আমরা ছাপাতেও পারি, নাও ছাপাতে পারি।

পর দিন তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন সম্পাদক অশোক সরকারের ঘরে পরিচয় করাতে। অশোকবাবু বললেন- আমাদের নীতি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছেন? আমরা কোনো পক্ষেও নই, বিপক্ষেও নই। কিন্তু যে খবর আমাদের কাগজে প্রকাশিত হবে, তা পড়ে পাঠকরা যেন বুঝতে পারেন, আমরা ভুয়ো খবর দিই না।

এরই মধ্যে সাত দিনের মাথায় আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হলো কয়েকজন শিল্পপতি মিলে বিবেকানন্দ রক তৈরির চাঁদা তোলার মিটিং করছিলেন। নিউমার্কেটের একটি হোটেলে কয়েকজন শিল্পপতি সাংবাদিক বৈঠক করছিলেন। সকলের হাতেই ছিল মদের গ্লাস। আমার কাছে খবরটা শুনেই শিবদা উত্তেজিত হয়ে বললেন, চলো এডিটরের ঘরে যাই। শিববাবু যখন গোটা ঘটনাটা বললেন, সম্পাদকের নির্দেশ ওই কপি যাবে না। লিখতেও হবে না।

সাড়ে ৪ দশকে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেখেছি এবং লিখেছি। যেমন খরা, মানুষের দুর্গতি, বন্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রেল ধর্মঘট, দুটি যুদ্ধ (ভারত-পাকিস্তান, ’৬৫ এবং ভারত-পাকিস্তান ’৭১), নকশাল আন্দোলন। একদিকে আমার সৌভাগ্য, অনেক বড় বড় ঘটনার আমি সাক্ষী। ’৬৫ সালে পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ না হলেও তিন সপ্তাহ ধরে কলকাতায় রাতে আলো জ্বলত না। ’৬৭ সালে প্রথম কংগ্রেস হেরে যায় পশ্চিমবঙ্গে। সাতটি বামপন্থি দল মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিল। ’৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টিও ভেঙে দু-টুকরো হয়। ইস্যু ছিল একটি। একদল মনে করছিল, চীন কমিউনিস্ট। তারা ভারত আক্রমণ করেনি। আর ভেঙে গিয়ে অন্য দল সিপিএই। এর নেতৃত্বে ছিলেন ভুপেশ গুপ্ত, হীরেন মুখার্জি প্রমুখ।

সেই সরকার স্থায়ী হয় নয় মাস। ১৯৬৯ সালে আবার নির্বাচন হয়। ১৩ মাস পর সেই সরকারও ভেঙে যায়। কমিউনিস্টদের হাত ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যাওয়া অজয় মুখার্জি তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হন। অজয়বাবু কমিউনিস্টদের বাদ দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেন।

’৭১ সালের ৭ মার্চের পর বাংলাদেশেও পাকিস্তানিদের অত্যাচারের হাত থেকে লাখ লাখ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। তাদের অত্যাচার দুরবস্থা দেখে আনন্দবাজার তাঁদের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা।

সংবাদপত্র তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ রিপোর্ট করার জন্য। তার সুফলও আনন্দবাজার পেয়েছিল। যুদ্ধের শেষে জানা গেল আনন্দবাজার প্রচার সংখ্যা ১৪ লক্ষে পৌঁছে গেছে। আঞ্চলিক পত্রিকার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে চলে গেল আনন্দবাজার। কেরলের মালয়ালাম মনোরমার প্রচারসংখ্যা ছিল ৩০ লক্ষের কাছাকাছি। কেরলের ১৮টি জেলা থেকে এই কাগজ প্রকাশিত হয়।

জরুরি অবস্থা চালু হওয়ার পর সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ চালু করা হয়। আনন্দবাজার পত্রিকাকে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আনন্দবাজারকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। আমার মনে আছে, একদিন পত্রিকার ২৫০ কর্মচারীকে অফিসের ছাদে ডাকা হলো। অশোকবাবু বক্তৃতা দেবেন। সমস্ত সহকর্মীকে তিনি বললেন, হয়তো আপনাদের বেতন দিতে পারব না। আপনারা কি কাজ করবেন? সবাই হাত তুলে বললেন, আমরা বেতন চাই না। আনন্দবাজার যে ভূমিকা নিয়েছে, আমরা সবাই তার পাশে আছি। পাঠকের চাহিদা মেটানোর প্রতি আনন্দবাজার বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।

আজও তা অব্যাহত আছে। কিন্তু করোনার মতো একটা ব্যাধি এসে গোটা সংবাদপত্র জগৎকে আক্রমণ করেছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে সস্ত্রীক অশোক সরদার ঢাকায় গিয়েছিলেন। একটি পাঁচতারা হোটেলে বঙ্গবন্ধু অশোকবাবুকে সংবর্ধনা জানান।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমি ও আমার দেশ অশোকবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার অবর্তমানে যে সরকার কলকাতায় বসে যুদ্ধ চালিয়েছে, তাদের কাছ থেকে আমি সব শুনেছি। সেখানে অশোকবাবু নিজের জীবনের একটি কথা ফাঁস করেন। আমাদের ধারণা ছিল অশোকবাবুরা উত্তর কলকাতার ঘটি। সেদিন মঞ্চে বক্তৃতা দিতে উঠে তিনি বলেন, কে বলেছে আমি ঘটি? আমাদের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ায়। আমরাও বাঙাল।

এ কথা স্বীকার করতেই হবে, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের মধ্যেও দুর্নীতি ঢুকেছে। আনন্দবাজারের একজন সাংবাদিক ১৫ বছর চাকরি করার পর তার সম্পত্তি দাঁড়িয়েছে ৩৫০ কোটি টাকায়। তিনি সাড়ে তিন বছর উড়িষ্যার জেলেও কাটিয়েছেন। এই করোনা এনে দিয়েছে এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতার, তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য।

বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সঙ্গে আমার দীর্ঘ সম্পর্ক। বসুন্ধরাতে গেলেই মনে হয়। আমি যেন নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি। সম্পাদক নঈম নিজামের দক্ষতায় একে একে নানা শাখা সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আনন্দবাজার যেভাবে এগিয়ে চলেছে নঈম নিজামের নেতৃত্বে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে অগ্রগতির পথে চলেছে। আমার ধারণা, বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিকরা নঈম নিজামের নেতৃত্বে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবেন। যেভাবে তারা এগিয়েছেন গত ১৪ বছর।

 লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর