শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন!

অনুপম হায়াৎ

চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন!

বর্তমানে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মিথ্যা, গুজব, গুঞ্জন না দাবড়িয়ে সত্য ও তথ্যভিত্তিক উন্নয়নমুখী চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার প্রসার ঘটানো। মহাকাশ থেকে মাতৃগর্ভ পর্যন্ত ‘ভিজুয়াল কনটেন্টময়’ প্রযুক্তির মহাসাগরে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা এখন শুধু তরি মাত্র। প্রয়োজনীয় জ্ঞান, কৌশল, শিক্ষা ও সততা প্রয়োগ করে এই তরি তীরে নোঙর করানোই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত...

 

চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা মূল সাংবাদিকতার একটি বিশেষায়িত শাখা। এতে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত কোনো ঘটনা, ধারণা, সংবাদ নিয়মিতভাবে পাঠক, শ্রোতা, দর্শক বা ভোক্তাদের কাছে পদ্ধতিগতভাবে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। চলচ্চিত্রের ‘আবিষ্কার’ হয়েছে পাশ্চাত্যেই। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার জন্মও হয়েছে পাশ্চাত্যেই। আদিতে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হতো সাধারণ পত্রিকার ‘আবিষ্কার’ হিসেবে। ১৯১১ সালে হলিউড স্থাপিত হলে চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটে তখন চলচ্চিত্রসংক্রান্ত পত্রপত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে।

বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সূত্রপাত ঘটে পঞ্চাশ দশকে ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠার আগে। তখন পাক্ষিক ‘সিনেমা’ (১৯৫০), সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ (১৯৫৪), ‘চিত্রমেলা’ (১৯৫৯) ও অন্যান্য চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রপত্রিকা বের হতো। এছাড়া দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক পাতায় চলচ্চিত্রসংক্রান্ত বিষয়াদি ছাপা হতো। ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার প্রধান সংবাদ মৃত হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৮ সালে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি’। এ সমিতি স্বাধীতার পর প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কার চালু করে। এভাবে এদেশে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা সাংস্কৃতিক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ওই সময় উচ্চশিক্ষিতরা চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও নির্মাণে জড়িত হন। যেমন ওবায়দুল হক, ফজলুল হক, মিজানুর রহমান, এমএম পারভেজ, সৈয়দ শামছুল হক, আজিজ মিসির, জহির রায়হান, খান আতা, আলমগীর কবির, খাদেজা খান চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন প্রমুখ।

পঞ্চাশ থেকে আশির দশক ছিল চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার স্বর্ণ যুগ। এরপর চলচ্চিত্রে ভিসিআর, ভিডিও এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাব পড়ে। তখন চলচ্চিত্র নির্বাচনে ভাটা পড়ে। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার ওপর এর প্রভাব পড়ে। চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রপত্রিকাও বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ওই সময় দৈনিক পত্রিকায় প্রতিদিন চলচ্চিত্রসহ অন্যান্য বিনোদনমূলক সংবাদ স্থান পেতে থাকে।

বর্তমানে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন? প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও চলচ্চিত্র আর আগের মতো নেই বলে এই প্রশ্ন উঠেছে। মূল সাংবাদিকতা অর্থাৎ মুদ্রণ মাধ্যমের (প্রিন্ট মিডিয়া) পাশাপাশি এখন বৈদ্যুতিক মাধ্যম (ইলেকট্রনিকস মিডিয়া)-এর জয়জয়কার। সাধারণ সাংবাদিকতায়ও তথ্য সংগ্রহ, লিখন পদ্ধতি, বিবর্ণ নিউজপ্রিন্টের বদলে কম্পিউটারে আঙ্গুলের স্পর্শে উজ্জীবিত শব্দাবলী, পরিবেশনা, প্রকাশনা, প্রদর্শন এবং ভোক্তার (পাঠক, দর্শক, শ্রোতা) গ্রহণ ক্ষমতা ও পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে নতুন মাধ্যমের (নিউজ মিডিয়া) যুগে। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায়ও পড়েছে এর প্রভাব। অন্যদিকে চলচ্চিত্র নির্বাহ, পরিবেশনা ও প্রদর্শন আর সনাতন পদ্ধতিতে হয় না। সেই সাদা-কালো যুগ নেই। নেই ৩৫ মিলিমিটারে পজিটিভ-নেগেটিভে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রদর্শনও। এখন ১৩-১৪ হাজার ফুট বহনের জন্য ভারী ভারী ক্যান বহন করতে হয় না। একটি ‘পেনড্রাইভ’ ধারণ করতে পারে লাখ লাখ ফুট ফিল্ম। ১, ৩, ৫ মিনিটের চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়ে থাকে এখন। এখন চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যেতে হয় না। যে কোনো চলচ্চিত্র মোবাইল, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইউটিউব, টিভি সেট, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ওটিটি প্ল্যাটফরমে দেখা যায়। এসব ‘নিউ মিডিয়া’ বা ডিজিটাল পদ্ধতির ফল। চলচ্চিত্র সাংবাদিকরাও এখন তাৎক্ষণিক তথ্যতা- সত্যতায় পূর্ণ হয়ে ভোক্তার কাছে যায়। ‘অনলাইন’ মুভি চ্যানেল ‘মুভি ডাটা বেস’ ‘সিনে আই’ প্রভৃতি ডিজিটাল পন্থায়।

শোনা যায়, এখন কোনো কোনো চলচ্চিত্র সাংবাদিক নিজের অনলাইন পত্রিকা চালায়। কেউ কেউ স্টুডিও হাউজ ‘ফিল্ম হাউজ’ নামে প্রতিষ্ঠান চালায়। তারা শিল্প বানায়। পুরস্কারও পায়। গুজব-গুঞ্জনের ঘুড়ি উড়ায়। তারকাদের গোপন বিয়ে ও সন্তানের খবর প্রচার করে। তারা ছুটছে অর্থ-বিত্তের পিছনে, আর পাচ্ছে চিত্রসুখও।

বর্তমানে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মিথ্যা, গুজব, গুঞ্জন না দাবড়িয়ে সত্য ও তথ্যভিত্তিক উন্নয়নমুখী চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার প্রসার ঘটানো। মহাকাশ থেকে মাতৃগর্ভ পর্যন্ত ‘ভিজুয়াল কনটেন্টময়’ প্রযুক্তির মহাসাগরে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা এখন শুধু তরি মাত্র। প্রয়োজনীয় জ্ঞান, কৌশল, শিক্ষা ও সততা প্রয়োগ করে এই তরি তীরে নোঙর করানোই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজেকে সুশিক্ষিত ও সশিক্ষিত করা এবং সাংবাদিকতার কৌশল, নীতি, স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব, সত্য ও তথ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে ভোক্তাদের কাছে তা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা।

লেখক : সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র গবেষক

সর্বশেষ খবর