শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - অধ্যাপক যতীন সরকার

রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়নের পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে

রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়নের পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে

শিক্ষাবিদ-গবেষক-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার (জন্ম : ১৯৩৬) বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা চিন্তক। ১৯৬৪ সালে অধ্যাপনা শুরু করেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে। অবসর নেন ২০০২ সালে। ২০০৫ সালে নেত্রকোনা শহরে থিতু হন। সমাজের সামষ্টিক উন্নয়নের কথা ভেবে তিনি লিখেছেন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁর রচনা আমাদের নিয়ত পাঠ্য। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান

 

প্রশ্ন : স্যার, কেমন আছেন?

- শরীর খুব খারাপ। না মরে বেঁচে আছি। অনেক দিন যাবৎ আর্থ্রাইটিসে ভুগছি। পায়ে ব্যথা। আমার ঘাড়ের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। বাইরে চলাফেরা কোনোভাবেই করতে পারি না। এমনকি ঘরের মধ্যেও হাঁটাচলা করতে পারি না। সারা দিন ঘরেই থাকি। তিনটি পত্রিকা আসে। পত্রিকা পড়ি। পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়। বিভিন্ন মানুষ আসে। আমার খবর নিতে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। প্রায় সময় আমাকে শুয়ে থাকতে হয়। বয়স হয়েছে।

প্রশ্ন : মনের জোর ঠিকই আছে...

- (হাসি)। মনের জোর আছে। এখন ৮৮ চলে। তবে সহজে মরছি না। হা হা হা। রবীন্দ্রনাথ তো ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ‘বেঁচে’ ছিলেন। এই ‘বেঁচে’ থাকার মানে প্রতিনিয়ত নিজেকে নিজে অতিক্রম করে যাওয়া। এই অর্থে ৮০ বছরের শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ‘বেঁচে’ ছিলেন। আমার ঠাকুরদা, বাবা এক শর বেশি বেঁচেছিলেন। আমরা কিন্তু আসলে ‘বেঁচে’ নেই, জীবিত আছি মাত্র (হাসি)।

প্রশ্ন : এখন কী লিখছেন?

- তুমি তো জানো, ৫০ বছর বয়সে আমার প্রথম বই বের হয়। ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। প্রবন্ধের বই। আর ৮০ বছর বয়সে আমার শেষ বই বের হয়, ‘প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা, প্রতিভা’। এখন আমার ৮৮ বছর বয়স। আশির পরে মূলত আমি কিছু লিখিনি। তবে এই যে মানুষ আসে, গলাবাজি করি, রেকর্ড করে নিয়ে যায়, ওইগুলোর কিছু বিভিন্ন জায়গায় ছাপা হয়।

প্রশ্ন : জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে না?

- পড়ে। শৈশব। বাবা-মা। বন্ধু-স্বজনের কথা মনে পড়ে। আমার ঠাকুরদার একমাত্র সন্তান আমার বাবা। আমার কোনো জ্যাঠা, কাকা, পিসি ছিল না। আমার জন্মের আগে একটি বোনের জন্ম হয়। সে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা যায়। এরপর ঠাকুরদা (পিতামহ) রামদয়াল সরকার বংশলোপের আশঙ্কায় কাতর ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বংশের ধারা অব্যাহত রাখতে দেবদেবীর শরণাপন্নও হন ঠাকুরমা। পীর-দরবেশের দরগায় শিরনি মানতও বাদ গেল না। ধাত্রীর মুখে আমার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ পেয়ে ঠাকুরদা নাকি বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমার অশান্তি দূর হলো। এই নাতিই আমার মনে শান্তি নিয়ে এলো।’ তাই নাম রাখলাম শান্তি। ডাকনাম শান্তি হলে কী হবে, ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, মা-বাবার মনে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি জোগাতে পারিনি। জন্মের পর থেকেই আমার কঠিন সব পীড়া তাঁদের উদ্বিগ্ন রাখত। ফলে আমার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ দিতে বাধ্য হন। সেটাই আমাকে অকম্মা ও অপদার্থ বানিয়ে ফেলে। খেলাধুলা থেকে তো দূরে রাখতেন। এমনকি গাঁয়ের অন্যদের মতো গাছে উঠতেও দিতেন না। খাল-বিলের দেশের মানুষ হয়েও ভালো করে সাঁতারও শিখতে পারিনি। কাজের মানুষ হওয়ার বদলে বড় হতে লাগলাম কেবল দেখার মানুষ, ভাবনার মানুষ আর কথার মানুষ হয়ে।

প্রশ্ন : তাহলে বেশ আদর-স্নেহে বেড়ে উঠেছিলেন...

- হিন্দু-মুসলিম, ধনী-গরিব, জোতদার-জমিদারদের একটা সমন্বিত সমাজে বেড়ে ওঠে আমার শৈশব। ধর্ম, সমাজ, সময় যুক্তির দৃষ্টিতে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টাটা আমি আমার পরিবার থেকেই শিখেছিলাম। আমার পরিবারটি ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে পুরো গ্রামের মধ্যে একটি এলিট পরিবার। আমার ঠাকুরদা রামদয়াল সরকার ছিলেন একজন গ্রামীণ এলিট। প্রকৃত অর্থেই আমার চিন্তা, চৈতন্য ও মানসজগতের ভিত্তিভূমি কিংবা শিক্ষালয় ছিল আমার পরিবার।

 

বর্তমান ছাত্রদের মান অত্যন্ত নিম্ন। বহু ছাত্র এমএ পাস করছে বটে, তবে বিদ্যার গভীরতা তাদের নেই। একটা বিষয় আমি বুঝি, শিক্ষানীতিকে সমাজনীতি থেকে, সমাজব্যবস্থা থেকে আলাদা করে চিন্তা করা যায় না

 

প্রশ্ন : এলিট বলতে কি বিদ্বান বুঝিয়েছেন?

- তুমি ঠিকই বলেছ, ‘এলিট’ শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহার হয়। আসলে এলিট মানে বিদ্বান। আমি এলিট বলতে বুঝিয়েছি পুরো গ্রামটার মধ্যে আমাদের বাড়ির মতো এমন বিদ্যাচর্চা কোথাও হতো না। সেই অর্থে আমি একটা এলিট পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করছি। এ বিদ্বান-এলিট পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় আমার একটা সুবিধা হয়েছে। আমি হালচাষ শিখিনি। খেতখামারেও কোনো দিন কাজ করিনি। কারণ কৃষকের সন্তান আমি ছিলাম না। আমার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। কিন্তু কৃষকের জমির আইলে দাঁড়িয়ে কৃষকের জীবন অনুভব করার একটা সংবেদনশীল এবং যৌক্তিক মন তৈরি হয়েছিল সেই রামপুরের প্রতিবেশে।

প্রশ্ন : আপনার মননচর্চা তাহলে পরিবার থেকে গড়ে উঠেছিল...

- অবশ্যই। শেকড়ের বাইরে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। শেকড়ের সংযুক্তিতেই আমার বিকাশ। আমার ঠাকুরদা, আমার ঠাকুরমার চেতনাতেই রাঙায়িত হয়েছি আমি। আমার ঠাকুরমা বলতেন, ‘তোকে মাথায় রাখতাম না উকুনে খাবে, মাটিতে রাখতাম না পিঁপড়েয় খাবে। তোকে কোলেই রাখতাম।’ আমিও বইয়ের জগতের মধ্যেই সমস্ত কিছুই পেয়ে গেলাম। বইয়ের চাইতে বড় কিছু নেই-এ বোধটা ছেলেবেলাতেই আমার হয়ে গেল। আসলে বইয়ের পাঠক ছাড়া আমি আর কিছুই হইনি। এভাবেই কিন্তু আমি বড় হয়ে উঠেছি।

প্রশ্ন : স্যার, আপনি তো ভাষা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন...

- ১৯৫২ সালে আশুজিয়া হাইস্কুলে আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। বলতে পারো ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমার রাজনৈতিক জীবনের সম্পৃক্ততা। বাজারে বাজারে চোঙ্গায় মুখ লাগিয়ে স্লোগান ধরেছি। গ্রামের বাজারে হরতাল করেছি। গীতিকবি জালাল খাঁর পুত্র কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম আমাদের ভাষা আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন। শুধু বাজারে হরতাল নয়, গ্রামের ভিতরে বৈঠকে আমি বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলেছি। গ্রামের মানুষকে এ বৃহত্তর আন্দোলনটা সম্পর্কে ধারণা দেওয়াই ছিল ওই বৈঠকের উদ্দেশ্য। আমার জীবনের নায়ক যদি হন আমার ঠাকুরদা রামদয়াল সরকার, তবে বলতে হবে আমার বক্তা হওয়ার নায়ক আমার বাবা।

প্রশ্ন : বাম রাজনীতিতে কীভাবে যুক্ত হলেন?

- ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পরই মার্কসবাদে দীক্ষিত হই। ময়মনসিংহে ‘নয়াজামানা পুঁথিঘর’ নামে বইয়ের দোকানটি ছিল নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির ‘অঘোষিত’ অফিস। এখানে কমিউনিস্টরা আড্ডা দিত। আড্ডা বসত কমরেড শৈলেন রায়ের বাসায়ও। এ দুটি আড্ডাতেই কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে আসি। এরপর ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুবের মার্শাল ল জারির পর সবই ছত্রখান হয়ে গেল। নয়াজামানা পুঁথিঘরে তালা পড়ল। কমিউনিস্টদের অনেকেই গ্রেফতার হলো, অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেল। ১৯৫৯ সালে বিএ পাস করার পর স্কুলে মাস্টারি নিই। প্রথমে আশুজিয়া হাইস্কুলে, পরে বারহাট্টায়। আজকের বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুণ ওই সময় আমার ছাত্র ছিল। বারহাট্টায় আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। কমরেড সুকুমার ভাওয়াল ও কমরেড অজয় রায়ের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হই। এ সময় থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির গোপন মুখপত্র ‘শিখা’ পাঠের সুযোগ পাই। শিখার পাতা থেকেই খবর পাই যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর ভাঙনের সূচনা হচ্ছে। পরে পার্টি ‘মস্কোপন্থি’ ও ‘পিকিংপন্থি’ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমি দুই বছর বারহাট্টায় মাস্টারি করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হই ১৯৬১ সালে। সেখানেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে পড়ি ১৯৬২ সালে।

প্রশ্ন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক আপনাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিলেন?

- একাধিক শিক্ষক আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। তাঁর ক্লাসে আমরা পারতপক্ষে সামনের সারির বেঞ্চে বসতে চাইতাম না। কারণ ওই ভয়। একেবারে শারীরিকভাবে নির্যাতন হওয়ার ভয়। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, বাংলা ভাষার ইতিহাস ও চর্যাপদ পড়াতে গিয়ে তিনি যা যা বলতেন তার নির্যাস আমাদের খাতায় লিখে নিতে হতো। তিনি আমাদের অন্তত সামনের বেঞ্চের ছাত্রদের, খাতায় উঁকি দিয়ে দেখতেন আমরা কী লিখেছি। একটু ভুল পেলেই ছাত্রদের মাথায় প্রচ- চাটি মেরে গর্জন করে উঠতেন-‘কী লিখেছিস হতভাগা!’ একদিন বললেন-‘লিখো, চর্যাপদের ভাষা-বিচার’। আমরা সবাই এ শিরোনামটি লিখে কলম ধরে অপেক্ষা করছি। তিনি আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন। সামনের সারির ছাত্রদের খাতাগুলো একনজর দেখেই ফেটে পড়লেন-‘সব মূর্খ, মূর্খ... কতগুলো গাধা-গরু ইস্কুল কলেজে মাস্টার হয়ে যাবে, আর কতগুলো গাধা-গরু তৈরি করে এখানে পাঠাবে।’ আমাদের ভুলটা হলো ‘ভাষা-বিচার’ লিখতে ‘ভাষা’ ও ‘বিচার’-এর মধ্যে আমরা কেউ হাইফেন দিইনি। ডক্টর হকের দৃষ্টিতে এটি মারাত্মক অপরাধ। ক্লাসে নয় শুধু, ক্লাসের বাইরেও তিনি আমাদের ভাষা-শিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।

প্রশ্ন : আপনি শিক্ষক হলেন কেন?

- স্কুলে পড়ার সময় এক সভায় ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের দর্শনের অধ্যাপক সুধীন চক্রবর্তীর বক্তৃতা শুনে একান্ত মুগ্ধ হয়ে পড়ি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, আমাকে কলেজের অধ্যাপক হতে হবে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে একাডেমিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়েছে। লক্ষ্য, কলেজের অধ্যাপক হওয়া। ১৯৬৪ সালের আগস্টে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে নাসিরাবাদ কলেজে যোগদানের মধ্য দিয়ে আমার লক্ষ্য পূরণ হয়। ব্যাকরণ পড়াতাম। আমার ক্লাসে আনন্দ মোহনসহ আশপাশের কলেজের শিক্ষার্থীরা আসত। একবার তো ট্রেনে ঢাকায় যাওয়ার পথে এক টিটি এসে আমাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তবে শুধু ক্লাসে পড়িয়ে তৃপ্তি পাই না। ময়মনসিংহ শহরে ‘মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র’সহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাম। সেসব সংগঠনে যা করতাম তা ‘মাস্টারি’ ছাড়া আর কিছুই না। ময়মনসিংহ শহরে এখানে-ওখানে সারা দিন মাস্টারি করার যে সুযোগ পেয়েছিলাম, সেটিই ছিল পরম পাওয়া। তাই নাসিরাবাদ কলেজ ও ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার কথা ভাবিইনি। সারা জীবন ধরে আমার আনুষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ছাত্রের শ্রদ্ধা পেয়ে আসছি।

প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের স্মৃতি...

- ১৯৭১ সালে নানা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে আমাদের পরিবারটি তিন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আমার স্ত্রী কানন সরকার তাঁর পিতৃপরিবারের সঙ্গে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় কীভাবে, সেসব বিস্তৃতভাবে ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন’ গ্রন্থে লিখেছি। একাত্তরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেত্রকোনায় ভাটি এলাকায় স্কুল-কলেজের কিছু ছাত্রকে নিয়ে ‘পাঠচক্র’ চালাই। এ ছেলেদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ভারতের মেঘালয়ে গিয়ে সেপ্টেম্ব^র থেকেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতার সাক্ষাৎ লাভ করি। তাঁরা মেঘালয়ে ক্যাম্প করে মুক্তিযুদ্ধের কাজে সহায়তা দান করেন। আমিও তাঁদের নির্দেশে বাংলাদেশ থেকে মেঘালয়ে চলে যাওয়া অনেক ছাত্রকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিই এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে।

প্রশ্ন : আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধে আপনার বাড়ি লুট হয়েছিল...

- অনেক কষ্টের। জীবনে এত দুঃখ আর পাইনি। লুটেরারা অর্থকড়ি কিছু না পেয়ে বইপত্র, পা-ুলিপি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। একজন লেখক হয়ে এটা মেনে নেওয়া নিশ্চয়ই অনেক কষ্টের। সে সময় ‘বাংলা উপন্যাসে মুসলমান’ শিরোনামে একটি লেখা প্রায় শেষ করেছিলাম। মূল্যবান গবেষণা ছিল। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সে গবেষণাও মনে হয় ছাই হয়েছিল। আর খুঁজে পাইনি। দুঃখ করে আমি কবীর চৌধুরীকে চিঠি লিখলাম-স্যার, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি লেখালেখি বাদ দিলাম। তিনি আমাকে উৎসাহ দিলেন। আবার লেখা শুরু করতে বললেন।

প্রশ্ন : ১৯৭৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে আপনাকে জেলে যেতে হয়েছিল...

- ৩ মার্চ আমি অ্যারেস্ট হলাম। জেলখানায় প্রায় ১৮ মাস ছিলাম। আমার পাশের কক্ষে তোফায়েল আহমেদ, সদ্যবিদায়ি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ছিলেন। জিয়াউর রহমানের জেলখানায় গিয়ে আমি লেখক হয়েছি। যখন জেলখানায় যাই তখন মনে হলো এত দিন তো শুধু মাস্টারি করেছি, এবার জেলখানার ভিতরে সেই মাস্টারির ঢঙেই কিছু লিখব। আমি যে প্রতিজ্ঞা করি, তা রক্ষা করি। লিখলাম, ‘ব্যাকরণের ভয় অকারণ’। আমি তো কষ্ট লেখক। জেলখানায় খাতা পাওয়াও ছিল কঠিন, আমাকে ভয় দেখানো হলো এসব লেখা আমি বাইরে নিয়ে যেতে পারব না। যাই হোক, একজন সহকারী জেলার আমার উপকার করলেন। তাঁর মাধ্যমেই একটা একটা লেখা আমি লিখতাম আর বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। এভাবে ৪০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখে ফেলি। তো ব্যাকরণ লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

প্রশ্ন : চলমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?

- বিয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা করেছি। আমি অহংকারের সঙ্গে বলি আমার চেয়ে ভালো মাস্টার বাংলাদেশে নেই। হা হা হা। ভালো ছাত্র, খারাপ ছাত্র সারা জীবন ছিল। বর্তমান ছাত্রদের মান অত্যন্ত নিম্ন। বহু ছাত্র এমএ পাস করছে বটে, তবে বিদ্যার গভীরতা তাদের নেই। একটা বিষয় আমি বুঝি, শিক্ষানীতিকে সমাজনীতি থেকে, সমাজব্যবস্থা থেকে আলাদা করে চিন্তা করা যায় না। একটা শিক্ষানীতিকে পরিপূর্ণভাবে, যথার্থরূপে সব মানুষের উপযোগী করার জন্য কোনো কমিটি-কমিশনের কাজ না, যদি না সমগ্র সমাজব্যবস্থাটার পরিবর্তন ঘটে। কাজেই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আমাদের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এর আগ পর্যন্ত এ শিক্ষানীতি সেই শিক্ষানীতি-এগুলো জোড়াতালি ছাড়া আর কিছুই হবে না। সমাজব্যবস্থা যেভাবে চলছে তার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা চলতে হবে। আমি আশাবাদী মানুষ। নিষ্ক্রিয় আশাবাদে আমার বিশ্বাস নেই।

প্রশ্ন : কোন বিষয়গুলো আপনাকে কষ্ট দেয়?

- রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়নের পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অধঃপতন। খাদ্যে ভেজাল। ধারাবাহিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি। মানুষের নৈতিক স্খলন।

প্রশ্ন : এ স্খলনের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

- প্রকৃতিকে প্রকৃত রেখে এর যে সংস্কার করা সেটাই সংস্কৃতি। দরকার সাংস্কৃতিক জাগরণ। সাংস্কৃতিক জাগরণ হলেই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রশ্ন : নাগরিক হিসেবে কোন বিষয়গুলো আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত?

- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নজরুলের খন্ডিতকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রচর্চা যেমন হয়েছে, তেমন বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের যে চর্চা তা-ও হয়েছে। কাজেই এটি প্রকৃত প্রস্তাবে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। সে আন্দোলনই একসময় রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার পরে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হয়। এ মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মুক্তির সংগ্রামের কথা। এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত মুক্তির সংগ্রামে বিজয় লাভ করা।

প্রশ্ন : অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক সময় দিয়েছেন। আপনাকে ধন্যবাদ।

- তোমাকেও ধন্যবাদ। তোমরা ভালো থাকো।

স্থান : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। বিকাল ৪টা ৩০-৬টা। বানপ্রস্থ, সাতপাই, নেত্রকোনা

সর্বশেষ খবর