শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে জবাবদিহিতা তৈরিতে কাজ করে

গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে জবাবদিহিতা তৈরিতে কাজ করে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- জয়শ্রী ভাদুড়ী ও রাশেদ হোসাইন

 

প্রশ্ন : স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কতদূর এগোল? গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা কী ধরনের পরিবর্তন আপনার চোখে পড়ছে?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : আমরা স্বাধীনতার আগেও সাংবাদিকতা দেখেছি, স্বাধীনতার পরও দেখছি। তবে বিশাল ব্যবধান! এ ব্যবধানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম পত্রিকার সংখ্যা একেবারেই সীমিত ছিল। আমার বাসায় ইত্তেফাক ও পাকিস্তান অবজারভার রাখা হতো। পত্রিকা যখন আমরা পড়তাম তখন দেখতাম পত্রিকাগুলো খুবই সাধারণভাবে ছাপানো হয়েছে। তা ছাড়া রেডিও, টেলিভিশন ও সরকারি চ্যানেল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এই ছিল আমাদের গণমাধ্যমজীবন। কিন্তু এখন গণমাধ্যমের বিস্ফোরণ ঘটেছে। আমাদের মুদ্রণমাধ্যমের সংখ্যা অগণিত। সরকারি, বেসরকারি চ্যানেল মিলে এখন গণমাধ্যমজগৎ ব্যাপক বিস্তৃত। সেই জায়গা থেকে আমরা এখন সারা দুনিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। এখন স্যাটেলাইট আছে, সেটার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকাসহ সব জায়গার খবর দেখি। মুদ্রণমাধ্যমে সেটিও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে তাৎক্ষণিক পাচ্ছি। এখন আমরা যে জায়গায় এসে গেছি সেটাকে বলা যেতে পারে- তথ্যপ্রযুক্তির সমবিন্দুতে এসে পৌঁছেছি। কেননা মুদ্রণমাধ্যম থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র কিংবা ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কথা যদি বলি সবই আমরা মোবাইল ফোনে মুহূর্তে করতে পারি। এটা একটা অভূতপূর্ব অগ্রগতি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী এ অগ্রগতি ঘটেছে। যার সুবিধা আমরাও উপভোগ করছি। এ ধরনের এক পরিবর্তন আমাদের চোখের সামনে ঘটে গেল যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমরা কল্পনাও করতে পারিনি যে, যেখানেই যাব সেখানেই আমাদের সঙ্গে মোবাইল ফোন থাকবে! বাসায় একটা ল্যান্ডলাইন থাকত, সেটা দিয়ে আমরা যোগাযোগ করতাম। যদি বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় টেলিফোন করতে হতো সেখানেও ট্রাঙ্কল কল বুক করতে হতো। সেটাতে সারা দিনেও লাইন পেত না। এ অবস্থা থেকে আমরা মুহূর্তের যোগাযোগব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আজ তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি হয়েছে বলেই আমরা এ জায়গায় আসতে পেরেছি। এখন গণমাধ্যমের সংখ্যাগত বিকাশের পাশাপাশি গুণগত বিকাশও ঘটেছে। আগের পত্র-পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসতে চাইত না। কেননা বেতন-ভাতা কম, তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই; কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য চাকরির পাশাপাশি সাংবাদিকতাকেও আগ্রহের সঙ্গে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। অনেক শিক্ষার্থী সাংবাদিকতা করার জন্যই পড়াশোনা করছে। ফলে গণমাধ্যমের গুণগত মানও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রশ্ন : বলা হয়ে থাকে, সংবাদমাধ্যম তাদের আধেয় বা কনটেন্ট প্রকাশের মাধ্যমে সার্বিকভাবে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটায়। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে জবাবদিহিতা তৈরির কাজ করে। দেশের সংবাদপত্রগুলোকে এক্ষেত্রে কতটা সফল বলা যেতে পারে?

- আমার মনে হয় গণমাধ্যমের কাজই হলো জবাবদিহিতার জায়গা সৃষ্টি করা। আমরা এখনো গণমাধ্যমকে যে সম্মান দেই সেটার কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আমরা গণতন্ত্রমনা মানুষ এবং গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ সেটা গণমাধ্যমের সুবাদেই হয়ে থাকে।

এখানে জবাবদিহিতার জায়গা গণমাধ্যম এককভাবে করতে পারবে সেটাও হয়তো নয়। জাতীয় সংসদের আমাদের যে জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন, আলোচনা করেন, তাদেরও দায়িত্ব জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। গণমাধ্যম জনগণের পক্ষ থেকে সেই কাজটি করে থাকে। সুতরাং জনগণের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যম আছে। কাজেই উভয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা দরকার। শুধু গণমাধ্যমই যে জবাবদিহিতার জায়গাটি সৃষ্টি করতে পারবে এমনটি নয়। বরং সমন্বিতভাবে সেটা করতে হবে। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকেও নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গণমাধ্যমকে প্রসারিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং গণমাধ্যমের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, প্রেস ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু হচ্ছে। ফলে একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ কাজগুলো করতে হবে। গণমাধ্যমকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গণমাধ্যম সমাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান। সমাজের আর ১০টা জায়গায় যদি সক্রিয় থাকে, আমার মনে হয় গণমাধ্যম একইভাবে সক্রিয় থাকবে এবং জবাবদিহিতার সেই কাজটি করবে।

 

হাতে-কলমে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা প্রসারিত করা দরকার। বর্তমান সময় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি ব্যবহারিক বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। তাত্ত্বিক বিষয় থেকে ব্যবহারিককে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

 

প্রশ্ন : দেশের সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব, বস্তুনিষ্ঠতা ও দায়বদ্ধতার চর্চা নিয়ে একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কী?

- আমি মনে করি, সম্পাদক ও সংবাদকর্মীরা একটি লক্ষ্য নিয়ে এ পেশায় আসেন। তারা সমাজে নির্মোহভাবে কাজ করবেন যাতে জনগণ সঠিক তথ্যটি পান। কিন্তু আমাদের দেশে ইদানীং একটা প্রবণতা দেখা গেছে, গণমাধমগুলো কোনো না কোনো শিল্প কিংবা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফলে সংবাদপত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মাধ্যমে কখনো কখনো কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে। তবে সাংবাদিকরা সেই জায়গা অতিক্রম করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চায় এগিয়ে চলেছে। ফলে এখন আমরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দেখি। সাংবাদিকদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তা ছাড়া গণমাধ্যমের ওপর মিডিয়া মালিকদের একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিশ্বজুড়েই লক্ষণীয়। সেই দিকটি খেয়াল রেখে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চা করতে হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে। আমরা কাক্সিক্ষত মাত্রায় অনেক সময় অগ্রসর দেখি না, তখন হতাশা বোধ করি। যদি বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে আমরা যে খুব বেশি পিছিয়ে আছি তা নয়।

প্রশ্ন : এবার ‘সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক অধ্যয়ন’ নিয়ে কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা শিক্ষা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? সাংবাদিকতার সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান কারিকুলাম বা আরও স্পষ্ট করে বললে এর অধ্যয়নকারীরা কতটা যুগোপযোগী?

- বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা ডিগ্রি দিয়ে। সেই সময়ে এক বছরের ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকতা করতে যেত। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ডিপ্লোমা কোর্স চলেছে। ১৯৬৯ সালের ডিপ্লোমা কোর্সের পাশাপাশি মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। এটা ছিল দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি। তারপর ১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষে তিন বছরের অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই কোর্স চার বছরে রূপান্তরিত হয়। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ খোলা হয়েছে। বর্তমানে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সাংবাদিকতার বিভাগ চালু রয়েছে। সাংবাদিকতা শিক্ষার সুযোগ প্রসারিত হচ্ছে। প্রথম অবস্থায় যে পাঠক্রম ছিল তার তুলনায় বর্তমান ২০২৪ সালে পাঠক্রমে অনেক গুণগতমান পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বেশি উন্নত, আধুনিক এবং যুগোপযোগী করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রথিকৃৎ। সেই যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বিভাগগুলো অনুসরণ করছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে নেই তবে হাতে-কলমে যেটা, সেটা এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে আছে। সাংবাদিকতা তো এখন আর পত্রিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এখন সম্প্রচার সাংবাদিকতা চলছে। আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সম্প্রচার সাংবাদিকতার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো সেভাবে চালু হয়নি। টেকনিক্যাল বিভাগের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ খোলা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও খোলা হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। আমরা চাই আমাদের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে শিক্ষার্থী বের হয়ে যেন তার কর্মক্ষেত্রে খুব ভালো করে। একজন শিক্ষার্থী যেন পূর্ণ দক্ষতা দিয়ে একটি গণমাধ্যমে যোগদান করতে পারে। সেই বিষয়গুলো এসব বিভাগ দেখছে।

আরেকটা বিষয় যেটা করা যেতে পারে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আলাদা আলাদা অনুশীলন সাংবাদিকতার জন্য একটি পত্রিকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সাংবাদিকতা বিভাগগুলো এই পত্রিকার দায়িত্বে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে অথবা সেই শহরের সমস্ত খবরাখবর দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক বের করবে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা আলাদা নিউজ পেপার থাকতে পারে। আমরা আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চিত্র দেখতে পাই। এ ছাড়া ক্যাম্পাস রেডিও এবং ক্যাম্পাস টেলিভিশন এই বিষয়গুলো নিয়েও আমাদের চিন্তা করতে হবে। ক্যাম্পাস রেডিও বিষয়ে যারা কাজ করবে তারা ক্যাম্পাস রেডিও থেকে সরাসরি জাতীয় রেডিওতে প্রবেশ করবে। এ ছাড়া ক্যাম্পাস টেলিভিশন দৈনিক ২ ঘণ্টা করে অন এয়ার করা যেতে পারে। যেখানে শিক্ষার্থীরা সংবাদ তৈরি করবে, প্রোগ্রাম করবে, সংবাদ উপস্থাপন করবে, এই বিষয়গুলো প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা গ্রহণ করবে। সংবাদের জন্য বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে। সেগুলো এডিটিং করে বুলেটিন আকারে দেবে। অর্থাৎ আমি যে কথাটি বলছি, হাতে-কলমে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা প্রসারিত করা দরকার। বর্তমান সময় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি ব্যবহারিক বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। তাত্ত্বিক বিষয় থেকে ব্যবহারিককে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রশ্ন : গত দশক থেকেই সাংবাদিকতায় নিউ মিডিয়ার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রকাশনা যেমন সহজ ও দ্রুততর হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে বললে, মিডিয়া আর নিউজ মিডিয়ার যে পার্থক্য তা ম্লান হতে শুরু করেছে। এ প্রেক্ষিতে আগামীতে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

- আমার মনে হয় প্রযুক্তিগত রূপায়ণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এগুলো প্রতিনিয়তই ঘটবে। এগুলো কখনো বন্ধ হবে না। আজকে তথ্যপ্রযুক্তি যে অবস্থানে আছে আগামীকাল সেই প্রযুক্তি আরও এগিয়ে যাবে। যে জায়গাটা আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত সেটা হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা। বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য আমাদের নির্মোহ মানুষ হতে হবে। সাংবাদিকের কাজ নির্মম সত্যনিষ্ঠ এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ লেখা এবং প্রকাশ করা। তাত্ত্বিক লেখাপড়ার মাঝে এ বিষয়গুলোকে প্রতিদিন আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সাংবাদিকদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। দেখা যায় বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে একজন সাংবাদিক ২০ বছর সাংবাদিকতা করেছে, হঠাৎ করে বস্তুনিষ্ঠতার ঘাটতির ফলে সংবাদের থিম পরিবর্তন হতে পারে। এজন্য বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। আজকের সমাজে নানা ধরনের প্রলোভন এবং চাপ আছে, নানা ধরনের লোভ-লালসার বিষয় আছে, সেগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। ধর্মীয়ভাবে সততা ও  বস্তুনিষ্ঠতার মধ্যে থাকতে হবে। এগুলোর মধ্যে আমাদের প্র্যাকটিস থাকতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে অনেক সহজে আমরা আমাদের সংবাদকে সারা বিশ্ব ছড়িয়ে দিতে পারছি। তবে মূল বিষয়টা হচ্ছে- আমি নিজে কতটা নির্মোহভাবে সংবাদকে প্রকাশ করতে পারছি।

প্রশ্ন : তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতিতে ‘মিসইনফরমেশন’, ‘ডিসইনফরমেশন’, ‘ম্যাল ইনফরমেশন’, ‘ডিপ ফেইকে’র মতো বিষয়গুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বভাবতই এগুলো সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও নানাভাবে ক্ষুণ্ণ  করছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংবাদমাধ্যমগুলোর করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

- গণমাধ্যমের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকমাধ্যমের বিস্তার ঘটেছে। সামাজিকমাধ্যম সমাজকে একীভূত রাখবে। সমাজকে সতেজ ও সক্রিয় রাখবে। এটাই আমরা আশা করেছি। সমাজের মধ্যে কিছু মানুষ আছে যারা মানুষ নামে অমানুষের মতো কাজ করে, তারা সামাজিকমাধ্যমকে ব্যবহার করে ভুল তথ্য দেয়। এ ক্ষেত্রে পত্রিকার মধ্যে ভুল হলে সংশোধনী দেওয়ার একটা বিষয় থাকে। পত্রিকার মধ্যে একটি ভুল হলে যে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নামে ভুল হয়েছে সে তার প্রতিবাদলিপি দিতে পারে; কিন্তু কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অপতথ্য প্রকাশ-প্রচার করে সামাজিকমাধ্যমে। গুজব ছড়িয়ে দেয় সামাজিকমাধ্যমে। এ মাধ্যম নীতিমালা মেনে ব্যবহার করা উচিত। কেউ যদি সামাজিকমাধ্যমে অপতথ্য দেয় তাহলে সেটা সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সেসব বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে রাখার জন্য সামাজিকমাধ্যমকে সেভাবে ব্যবহার করা উচিত। আমরা যখন বলি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তখন আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে- স্বাধীনতা মানেই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলতেন, স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা। আমার নিজের অধীনে আছি। এটা হলো আমার দায়িত্বগুলো আমার মেনে চলা। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যে কেউ চাইলেই রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে পারে না। তাকে অবশ্যই রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। ট্রাফিক রুলস মেনে চলতে হবে। আইনকানুন মেনে চলতে হবে। ঠিক একইভাবে আমাদের সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ মাধ্যমের নীতি মেনে চলতে হবে। আমার এ স্বাধীনতা অন্যকে অপদস্ত করা, অন্যকে হেয় করে কোনো কিছু লেখার জন্য নয়, অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নয়। আমার স্বাধীনতা হলো- আমি স্বাধীনভাবে আমার চিন্তার বিকাশ ঘটানো। অতএব আমাদেরকে গণমাধ্যমের নীতিমালা, সামাজিকমাধ্যমের নীতিমালা এসব মেনে চলতে হবে।

এ উন্মুক্ত জায়গায় যাদের মধ্যে সত্যতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার বৈশিষ্ট্যতা ধারণ করে তারা আসবে। সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ আইনটি হলো- সত্য কথা বলা। সত্য কথা বললে কোনো আইনে তাকে বিপদে ফেলতে পারবে না। আমি মনে করি, এ পেশায় যে আসবে তার মধ্যে সত্যনিষ্ঠ বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত। নির্লোভ ও নির্মোহ মনোভাব থাকতে হবে। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার দক্ষতা সবার থাকা উচিত। যোগাযোগ হলো একটি সম্পদ। টাকা-পয়সা ধন-সম্পদ এগুলো যেমন সম্পদ, যোগাযোগটা এর থেকেও বড় সম্পদ। যে যোগাযোগ ভালো করতে পারে সে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার ভিতর থেকে তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারবে। যোগাযোগ শুধুই পেশা নয়, অন্যান্য পেশার মানুষেরও যোগাযোগ দক্ষতা থাকা উচিত। একজন চিকিৎসকের যোগাযোগ দক্ষতা থাকা দরকার। রাজনীতিবিদদের তো সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ দক্ষতা থাকা উচিত।

সর্বশেষ খবর