শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

খাদের কিনারেই দাঁড়িয়ে আছে অর্থনীতি

খাদের কিনারেই দাঁড়িয়ে আছে অর্থনীতি

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারেই দাঁড়িয়ে আছে। খাদে পড়ে না যাওয়ার জন্য আমরা চরম স্বল্পমেয়াদি চিন্তার মধ্যেই আটকে আছি। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোকে লালন করা হচ্ছে। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কখনই কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বিদ্যুতের বাড়তি দাম মানুষকে আরও বেশি ভোগাবে, কেননা এর প্রভাব তো পড়বে সর্বক্ষেত্রে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- মানিক মুনতাসির

 

প্রশ্ন : দেশের বর্তমান সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি খাদের কিনারেই দাঁড়িয়ে আছে। খাদে পড়ে না যাওয়ার জন্য চরম স্বল্পমেয়াদি চিন্তার মধ্যেই আমরা আটকে আছি। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যেন খাদে পড়ে না যাই সে দিকেই বেশি নজর দিয়ে থাকি এবং সেটার জন্য স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। অথচ খাদের কিনার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য। অর্থাৎ এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আমরা সেদিকে খুব বেশি নজর দিতে দেখি না।

প্রশ্ন : দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ডলার সংকটের সমাধান কী বলে আপনি মনে করেন?

- দেখুন এখানে দুটো বিষয়-একটা হলো, ডলার আয়। তো ডলার আসছে কোথা থেকে। এর একটা উৎস হলো-রপ্তানি আয়। অন্যটা রেমিট্যান্স। এর কোনোটা কি আমাদের পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। এখানে রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ দেশেই আসছে না। এটা নিয়ে কিন্তু কার্যকর কোনো সমাধান আমরা দেখিনি। আবার সঙ্গে যোগ হয়েছে পাচারের মতো ভয়াবহ বিষয়। এটার ক্ষেত্রে যে দায়ীদের শাস্তি হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। অন্যদিকে আমাদের যে ডলারের ব্যয় সেটার ক্ষেত্রে যে জবাবদিহিতা সেটাও তো প্রশ্নবিদ্ধ এবং অস্বচ্ছ। আমরা আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা করে গড়ে তুললাম তাতেও তো ডলারে প্রবাহ বাড়েনি। আবার বিলাসী পণ্যের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা আর আমদানি সংকুচিত করা কিন্তু এক কথা নয়। এখানে সংকোচনমূলক আমদানি নীতির কারণে আবার শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে। যার এক চরম নেতিবাচক প্রভাব আমাদের উৎপাদনের ওপর পড়ছে।

প্রশ্ন : উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

- মূল্যস্ফীতি তো অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিকর অবস্থা। উচ্চ পর্যায়ের একটা স্থায়ী মূল্যস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়েছে। যেটা সরকারি হিসাবে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। প্রকৃতপক্ষে এটা হয়তো আরও বেশি এবং এটা কিন্তু স্থায়ী। আমাদের সমসাময়িক অনেকগুলো দেশ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখানে ব্যর্থ হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের মূল্যস্ফীতি একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। আগে যেমন হতো পিক মৌসুমে জিনিসপত্রের দাম কমে আসত। এখন কিন্তু সেটা হচ্ছে না। বছরজুড়েই উচ্চমূল্য থাকছে। আবার এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার কাগজে-কলমে ঘোষিত নীতি নিয়েছে। অর্থাৎ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। অথচ বাস্তব অবস্থা আবার ভিন্ন। একদিকে সংকোচনমূলক ঘোষিক কাগুজে নীতি। অন্যদিকে এই নীতির বিরোধী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে স্ববিরোধী প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও বাজার ব্যবস্থার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের উচিত হবে আসছে বাজেটের আগেই একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। এটা এখন সময়ের দাবি। তাহলে আমরা বাস্তব অবস্থাটা বুঝতে পারব। এটার একটা ব্যাখ্যা দরকার। যা হবে অত্যন্ত জনহিতকর।

 

বিভিন্ন ধরনের আইনকানুন করে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর অতি নিয়ন্ত্রণমূলক আইনি ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থি। এ ছাড়া সাংবাদিকতার বিকাশে তেমন কোনো বিনিয়োগ বাড়ছে না...

 

প্রশ্ন : পুরনো সরকার নতুন করে ক্ষমতায় এসেছে। সামনে তো নতুন বাজেট। এই বাজেটে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন?

- দেখুন এটা আসলে নতুন কোনো সরকার নয়। পুরনো সরকারেরই ধারাবাহিকতা। আমরা যে খাদে না পড়ে যাওয়ার জন্য চরম স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আটকে আছি। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আসছে বাজেটে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোকে লালন করা হচ্ছে। এটার নিবর্তন করতে হবে। বাজেটের মাধ্যমে যারা এই সুবিধাগুলো নিয়ে থাকে। সেটাকে বন্ধ করতে এবারের বাজেট থেকেই।

প্রশ্ন : বাজার সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

- দেখুন আমরা কী দেখছি? আমরা দেখুছি, রাজনৈতিক ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোকে লালন করা হচ্ছে। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কখনই কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। এখানে জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। এটার কোনো ব্যাখ্যাও নেই। বাজার সিন্ডিকেট বা ক্ষমতাপুষ্ট গোষ্ঠীগুলো খুবই শক্তিশালী। যারা বাজারে বা বাজার ব্যবস্থাপনায় অনৈতিক মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বিরাজ করছে। তাদের রাজনৈতিক দাপট অব্যাহত রয়েছে। আমাদের এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোকে লালন করা হচ্ছে। তারা এখনো আগের মতোই রয়েছে। এটা কিছু কিছু বেড়েছেও।

প্রশ্ন : বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার বলছে সামনে আরও বাড়বে। এটা আমাদের জীবনযাত্রায় কী প্রভাব ফেলবে। এখানে সরকারের কী করা উচিত?

- বিদ্যুৎ বা জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবটা বহুমুখী। এটা তো একক কোনো বিষয় নয়। এটার প্রভাব সেচ, উৎপাদন, যাতায়াত, শিল্প, কৃষি সবখানেই পড়বে। এত কিছুর পরই যদি সাপ্লাই চেইনটাকে স্বাভাবিক রাখা যেত, উৎপাদন বাড়ানো যেত তাহলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ত। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। এখানে বিদু্যুতের দাম সমন্বয়ের নামে যেটা করা হয় সেটা তো আসলে সরকারে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ফসল এবং এটার বোঝাটা জনগণের কাঁধের ওপরই চাপানো হয়। কিন্তু অন্যদিকে সুবিধার প্যাকেটগুলো ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোকে পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কিনি। আবার ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থের গচ্চা দিচ্ছি। আবার উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি বহাল রেখেছি। এটার দ্বারা অল্প সময়ের বহুজন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। অথচ জনভোগান্তি বাড়ানো হয়েছে। বোঝাটাও চাপানো হয়েছে জনগণের কাঁধে। এক অর্থে এগুলো ভ্রান্তনীতি, অনৈতিক নীতি। আসছে বাজেটে এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া উচিত।

প্রশ্ন : চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া, সাধারণ মানুষের জীবনধারা ও অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকগুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

- আমরা শুধু অর্থনীতি আর অবকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু সেটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের এখন রাজনৈতিক উন্নয়ন, মানব উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন এসব নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে। রাজনীতি অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রেই জবাবদিহিতার কথা বলছি। সেটাতে আমলে নিতে হবে। অন্যথায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। তিনি বলেন, অথচ যে সংকট এখন চলছে এটা অবশ্যই বৈশ্বিক সংকটের অংশ কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক সংকট, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, জ্বালানি ও বিদ্যুতের সংকট এটা তো জনগণ তৈরি করেনি। এটা উন্নতি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবে তা হয়নি। এখানে একটি গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধান্য দিয়েছে রাষ্ট্র। ফলে সংকট সমাধানের বোঝা শুধু জনগণের কাঁধে চাপিয়ে তো জনকল্যাণমূলক কিছু করা সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন : দেশের বর্তমান গণমাধ্যম সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

- দেখুন এখানে বিভিন্ন ধরনের আইন-কানুন করে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর অতি নিয়ন্ত্রণমূলক আইনি ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এছাড়া সাংবাদিকতার বিকাশে তেমন কোনো বিনিয়োগ বাড়ছে না। গণমাধ্যমের বাস্তবতা হচ্ছে নিবর্তনমূলক আইন কাঠামো চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতামূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না।

প্রশ্ন : গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্রের দ্বায় কতখানি বলে আপনি মনে করেন?

- এখানে রাষ্ট্রের দ্বায় বা ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে গণমাধ্যমের ওপর নিবর্তনমূলক আইনি পরিকাঠামোগুলোকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এতে মালিক পক্ষ ও সাংবাদিক পক্ষকেও মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এখানে গণমাধ্যমের মালিকদেরও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে।

প্রশ্ন : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাদারি সাংবাদিকতার বিকাশে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

- দেখুন এখানে সবার আগে দেখতে হবে আমাদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থগুলো গণমাধ্যমের মূল মিশন ও ভিশনকে নষ্ট করছে কিনা? নির্ভীক সাংবাদিকতা, মালিকপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থগুলোকে গণমাধ্যমকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবুও কিন্তু গণমাধ্যম এগিয়ে চলেছে। এখানে সোশ্যাল মিডিয়া দেশের মূল গণমাধ্যমকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। অথচ সোশ্যাল মিডিয়া আর ম্যাস মিডিয়া কিন্তু এক জিনিস নয়। যার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যেও দেখা যায় রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে তারা ঘটনার প্রকাশ করে থাকেন। আবার এখানে ঘটনার প্রকাশ আর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার হওয়া কিন্তু বিষয় নয়।

প্রশ্ন : সাংবাদিক জগতের পুরোধাদের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী? একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে অনেক নতুন নতুন টিভি ও পত্রিকা এসেছে সে বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

- গণমাধ্যমের বিকাশ কিন্তু সংখ্যার বিষয় নয়। এখানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার বিষয়ে বড় বড় প্রশ্ন উঠেছে। সেটাকে খন্ডাতে হবে। এখানে গণমাধ্যমের যারা কর্ণধারা তারাও কিছুটা দায়ী। এখানে দলাদলি ও একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যারা সাংবাদিকতার পুরোধা তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তারা রাষ্ট্রের কাছাকাছিও আছেন। নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। এখানে গণমাধ্যমের পুরোধা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যেতে হবে।

সর্বশেষ খবর