শিরোনাম
শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
নিবন্ধ

বড় হওয়া ঐচ্ছিক

আবু তাহের

বড় হওয়া ঐচ্ছিক

কবি শামসুর রাহমান বলে গেছেন, ‘মহাজ্ঞানী প্লেটো আরব মুল্লুকে পরিচিত ছিলেন ‘আফলাতুন’ নামে। আমাদের আফলাতুন শাব্দিক অর্থেই আফলাতুন।’

 

‘অনেকেই কবিতা লেখে, সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সাংবাদিকতা অনেকের পেশা, সবাই সাংবাদিক নয়, কেউ কেউ সাংবাদিক।’ কথাগুলো বলেছিলেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক আফলাতুন। চাকরি করতেন ‘দৈনিক বাংলা’য়, তুমুল আড্ডায় মেতে থাকতেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের রোজ বিকালের সদস্য-জটলায়। প্রেস ক্লাব তখন লালরঙা দোতলা ভবন। আমরা জনা পাঁচেক সমমনা ‘সংবাদশ্রমিক’ ছিলাম আফলাতুন দাদুর গভীর অনুরাগী। হ্যাঁ, তাঁকে আমরা ‘দাদু’ সম্বোধন করতাম। নানা বিষয়ে তাঁর বিশদ জ্ঞান ছিল; কিন্তু সেগুলোর প্রকাশ ঘটত আকস্মিক কোনো পরিস্থিতিতে। কবি শামসুর রাহমান বলে গেছেন, ‘মহাজ্ঞানী প্লেটো আরব মুল্লুকে পরিচিত ছিলেন “আফলাতুন” নামে। আমাদের আফলাতুন শাব্দিক অর্থেই আফলাতুন।’

রাজধানীর শাহজাহানপুরে ভাড়া-করা বাড়িতে বাস করতেন আফলাতুন দাদু। আমিও ওই এলাকায় অনেকদিন থেকেছি। আড্ডা শেষে প্রেস ক্লাব থেকে রাত আটটার দিকে বাড়িমুখো হতেন। কখনো রিকশায় উঠতেন না, হেঁটেই যেতেন। কেন? ফিটনেসের প্রয়োজনে। একবার বলেছি, আপনি তো পলকাদেহী, ফুঁ দিলে হাওয়ায় ভেসে যাবেন, আপনার আবার ফিটনেস! তিনি বললেন, আয়! আমার সঙ্গে লড় দেখি। এমন একখান আছাড় মারব, চিতপটাং হয়ে থাকবি সাড়ে তিন দিন।

প্রচুর পান খেতেন আফলাতুন দাদু। পান চিবোতে চিবোতে শাহজাহানপুর যাত্রাকালে অনেক সময় তাঁর সঙ্গী হয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেশ-দুনিয়া-রাজনীতি-মানবচরিত্র সম্পর্কে যেসব কথা বলতেন সেগুলোর মধ্যে থাকত নিবিড় পর্যবেক্ষণের হিরণ¥য় দ্যুতি। এখন তাঁর চলে যাওয়ার (মৃত্যু : ১৪ মে, ২০০৬) ১৮ বছর পরে আফসোস হয়, কেন যে ওসব টুকে রাখলাম না। রসিকতার ছলে হুল ফুটিয়ে দেওয়ার অতুলনীয় মুনশিয়ানা ছিল আমাদের এই দাদুর। এ লেখার একেবারে শেষ দিকে ওই মুনশিয়ানার নমুনা থাকবে।

‘ছুটি’ ম্যাগাজিনে আমার কয়েকটি নিবন্ধ বেরিয়েছিল। সেগুলো পড়ে মুগ্ধ আফলাতুন আমায় পরামর্শ দেন, ‘শুধু পয়সার জন্য না, নিজের আনন্দের জন্যও লিখিস।’

জানতে চাইলাম, নিজের আনন্দ জিনিসটা কী। তিনি বলেন, যে লেখায় মানুষের ন্যূনতম উপকার হয় সেটাই লেখকের জন্য আনন্দ বয়ে আনে বেশি। এইটা তোরে রাহাত খানও কইছিল। তুই রাহাতরে কইছস-‘লেইখা দুই পয়সা পাইলে তাতেই নিজের আনন্দ।’

লোকসংগীত সংগ্রাহক ও লেখক বিখ্যাত অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিনের (জন্ম : ৩১ জানুয়ারি, ১৯০৪-মৃত্যু : ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭) বাড়ি শান্তিনগরে। আমার তদানীন্তন অফিসও ওই এলাকায়। অসুস্থ অধ্যাপককে দেখতে যাচ্ছেন আফলাতুন। পথিমধ্যে আমাকে পেয়ে বলেন, ‘চল্ স্যারের সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দিই।’ গেলাম। অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন গড়গড়া হুঁকোয় তামাক সেবন করছিলেন। দুজনের সংলাপ বিনিময় উপভোগ্য। অধ্যাপক আমায় বলেন, আপনার এই দাদু যে ভয়ানক এক পাষ- তা জানেন। দারুণ ছোটগল্প লিখত এই হারামি। তিন বছর ‘দেশ’ (কলকাতার) পত্রিকায় ওর গল্প বেরিয়েছে। হঠাৎ লেখা বন্ধ করে দিল। কেন জানেন! বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সাহিত্যপ্রতিভা বিকশিত করবার জন্য সংগঠন করবে।

সেদিন আফলাতুন আমায় বুদ্ধি দেন, খবরের কাগজে জীবনকালে দেখা-শোনা-জানা ব্যাপারগুলো আড্ডায় যেভাবে বলিস সেগুলো সুযোগ পেলেই ছাপার অক্ষরে পরিবেশন করবি। নিজের আনন্দ হবে, যারা পড়বে তাদের জ্ঞান না হলেও মজা তো পাবে। সেই থেকে এভাবে লিখে চলেছি যেভাবে আজ এখানে লিখছি।

বাঘ হয়ে যায় গরু : বিশ্বকাপ ক্রিকেট ১৯৯৯’তে পাকিস্তানকে হারিয়ে দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই টিমের অলরাউন্ডার নাঈমুর রশিদ রাহুলের বাবা আবদুর রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, অর্থনীতিতে তিনি এমএ। আইনশাস্ত্রে ডিগ্রিধারী। পাবনার বিখ্যাত অধ্যাপক আবদুল হামিদের জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুর রশিদ (মৃত্যু : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১) তাঁর জনকের আগ্রহে ধর্মবিষয়ক ডিগ্রি ‘মমতাজুল মোহাদ্দিসিন’ হাসিল করেছিলেন।

আগাগোড়া আলোকিত মানুষ আবদুর রশিদ একটা লিমিটেড কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। এ কোম্পানির মালিকানায় যে দৈনিক পত্রিকাটি বের হতো তার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঘটনাক্রমে ২০০৫ সালে আমি ওই পত্রিকায় যোগ দিলাম। দেখি তিনি এ পত্রিকার সবার প্রিয় গুরুজন। অচিরেই রশিদ ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই। দুপুরে তাঁর বাড়ি থেকে খাবার আসত তাঁর ও আমার। ভাবির রান্নার হাত চমৎকার। যতদিন ওই পত্রিকায় কাজ করেছি প্রায় প্রতিদিনই রশিদ ভাইয়ের কল্যাণে সুস্বাদু সব খাবার খেয়েছি।

রশিদ ভাই একদিন আমায় বলেন, রবি ঠাকুর মনে করতেন মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। সম্ভবত উনি ভালো মানুষের ওপর আস্থা রাখার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ওরকম বলে থাকতেন। তবে আমি আমার জীবনে যা যা দেখেছি তার ভিত্তিতে আপনাকে বলি-‘ধরুন আপনি গাঁয়ের পথে হাঁটছেন। আপনার বিপরীত দিক থেকে আসা পথিক জানায়, ওই যে দূরে তালগাছ তার গোড়ায় একটা বিলাই ছিল। কিছুক্ষণ পর সে দেখেছে বিলাইটা বাঘ হয়া গেছে। ওর কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।

কিংবা ধরুন, এক ব্যক্তি আপনাকে জানাল যে তাদের বাড়ির পুকুরের সবচেয়ে বড় রুই মাছটি হঠাৎ কুমির হয়ে গেছে। এটাও বিশ্বাস করলে করতে পারেন। অথবা ধরুন, এক রিপোর্টার আপনাকে বলছে, চিড়িয়াখানায় একটা ঘোড়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাতি হয়ে গেছে। এটাও বিশ্বাস করা যায়।

এই যে আমাদের স্পোর্টস এডিটর আসিফ ইকবাল। ধরুন আসিফ একদিন আপনাকে বললেন, ভাই নরসিংদীতে আমাদের বাড়ির লাগোয়া জঙ্গলে বাঘ এসেছিল। কয়েক শ লোক সশস্ত্র হয়ে জঙ্গল ঘেরাও করে ফাঁকা গুলির আওয়াজ করতে থাকে। ভয়ার্ত বাঘ লাফ দিয়ে পালায়। জনতাও তাকে ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেতে খেতে বাঘটি সবার চোখের সামনে গরু হয়ে গেল। আসিফের এ রিপোর্টও আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।

কিন্তু কেউ যদি বলে, কুখ্যাত অমুক মন্দ মানুষটি ভালো হয়ে গেছে, খবরদার! কখনোই তা বিশ্বাস করবেন না।’

শতভাগ নির্ভুল : বংশাল রোডে ‘সংবাদ’ অফিস। সম্পাদক আহমদুল কবির গম্ভীর মুখে তাঁর কামরায় আসীন। তাঁর মন খারাপ। কেননা ‘গণভবন’ থেকে জানানো হয়েছে ‘সংবাদ’-এ প্রকাশিত ‘যে আবেদন এখন আর রাষ্ট্রপতির সামনে যায় না’ শীর্ষক সংবাদটি ভিত্তিহীন। তখন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। প্রকাশিত সংবাদটির প্রতিবাদ মৌখিকভাবে করেছেন রাষ্ট্রপতির তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিশ। তথ্য উপদেষ্টা আর সংবাদ সম্পাদক সম্পর্কে খালাতো ভাই। সম্পাদক মনঃকষ্টে ভুগছেন; তাঁর নির্বাহী সম্পাদক আওয়াল খান ভরসা দিচ্ছেন-‘রিপোর্টটি নির্ভরযোগ্য। বানোয়াট রিপোর্ট ও কখনোই করে না।’

‘ও’ মানে মতিউর রহমান চৌধুরী (এখন ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদক)। সহকর্মী কামদা প্রসাদ ভৌমিক বলল, ‘আইজকা মনে অয় মতিউররে খাইছে।’ প্রতিবেদনটি পড়লাম যার সারকথা : সাধারণ নাগরিকরা বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকার দাবি করে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে সরাসরি আবেদন পাঠান। আবেদনগুলো প্রতি সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির নজরে নেওয়া হলে তিনি সমাধানের জন্য জেলা প্রশাসকদের দিকনির্দেশনা দেন। এতে চটজলদি উপকার পাওয়া যায়। দুই বছর এটা চলেছে। তারপর আর আবেদনগুলোর প্রক্রিয়াকরণ নেই।

জরুরি তলব মতিউর রহমান চৌধুরীকে। সম্পাদক আহমদুল কবির জানতে চান, তোমার সোর্স কে? মতি বলেন, তা তো বলা যাবে না। সম্পাদক বলেন, ‘লুক আওয়াল, হাউ ডেয়ার দিস গাই! হি ইজ অবজেটিং টু ডিভালজ টু হিজ এডিটর।’ মতি বলেন, ‘আপনি কেবল এডিটর নন, পত্রিকার মালিকও। মাই সোর্স মে বি হার্মড বাই ইয়োর অ্যাকশন। টু মি মাই সোর্সেস সিকিয়োরিটি ইজ ফার্স্ট।’

আওয়াল ভাই খুব নিচু স্বরে মতির সঙ্গে একটু আলাপ করার পর চেয়ার থেকে উঠে সম্পাদকের কাছে গিয়ে কানে ফিসফিস করলেন। পরক্ষণে আহমদুল কবির একচেঞ্জে নির্দেশ দেন ‘গণভবনে তথ্য উপদেষ্টাকে ধর।’ লাইন পেতেই বললেন : ‘দাউদ, মাই রিপোর্টার ইজ হানড্রেড পার্সেন্ট রাইট। আই অ্যাম প্রাউড অব হিম’- বলেই রিসিভার রেখে দিলেন সশব্দে। রিপোর্টার কিছুতেই সম্পাদকের কাছে সোর্সের পরিচয় দিলেন না। তদুপরি বুক চিতিয়ে বললেন, তার কাছে সংবাদ উৎসের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। সম্পাদককে সোর্স জানালেন না, কিন্তু পেশাদার সাংবাদিক নির্বাহী সম্পাদকের কাছে ঠিকই সব বললেন। সবই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিলেন আহমদুল কবির। পত্রিকার মালিক তিনি, সেই অহং দ্বারা তিনি ক্ষুব্ধ হননি, গর্জে ওঠেননি। তার বদলে রিপোর্টারের জন্য গর্ববোধ করলেন। মিনার উচ্চতার ব্যক্তিত্ব যাঁদের তাঁরা এমনই হয়ে থাকেন। হয়তো এঁদের দেখেই সেই প্রবচনটির উদ্ভব যেখানে বলা আছে-‘বার্ধক্য অপরিহার্য, বড় হওয়া ঐচ্ছিক।’

ত্রিভুবনে নাই : মহাজন সাংবাদিক আতাউস সামাদ (জন্ম : ১৬ নভেম্বর, ১৯৩৭-মৃত্যু : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২) এনটিভি নেটওয়ার্কের সিইও থাকার সময় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার মালিক-সম্পাদক ছিলেন। ‘এখন’ নামের পত্রিকাটিতে লিখবার জন্য অনুরোধ করলেন তিনি। এক পাতার লেখা, শিরোনাম ‘মিঠেকড়া’। স্থির হয়, বিষয়বস্তু তিনি ব্রিফ করবেন, লেখা কীভাবে সংগ্রহ করা হবে জানালেন। এরপর প্রশ্ন, ‘তোমায় কত দিতে হবে?’

‘এ কী কথা সামাদ ভাই!’ বলেছি আমি, ‘আপনার কাগজে লিখবার যোগ্য ভাবলেন আমাকে, এ তো বিরাট সম্মান।’ তিনি বলেন, ‘দেখ, আমি তো জমেদ আলী সমেদ আলী কাউকে ডাকিনি। তোমাকে ডেকেছি তুমি পারো তা-ই। যে পারে সে করে; যে পারে না সে শেখায়।’ কত আমার প্রত্যাশা জানাবার জন্য চেপে ধরলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে এতই যখন লাজ, মুন্নার কাছে বোলো।’

সাংবাদিক মুন্না মিয়া নানাবিধ কাজে আতাউস সামাদের সহায়ক হয়ে কাজ করতেন। মুন্নাকেও আমি কোনো অঙ্ক বলিনি। প্রথম চার সপ্তাহের লেখার যে সম্মানি সামাদ ভাই দেন তা মুগ্ধকর ছিল। মাসের প্রথম সপ্তাহে আগের মাসের বিল পেয়ে যেতাম। ‘এখন’ অফিসে গেলে কোনো কোনো দিন সামাদ ভাইকে পেতাম, দেখতাম খুব ব্যস্ত। ওই অবস্থাতেই খোশগল্প করতেন। তীব্র রসিকতাও করতেন। একদিন দেখি শওকত মাহমুদ (জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি) আর সামাদ ভাই।

বললেন, তাহেরকে কেন লাইক করি জানো? কারণ মূসা ভাই ওকে লাইক করেন। মূসা ভাই (স্বনামখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা। জন্ম : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১-মৃত্যু : ৯ এপ্রিল, ২০১৪) বলেছেন, গোঁয়ারের মতো যতই কথা বলুক না কেন তাহেরের দিলটা কিন্তু ভালো। বাট বি অ্যালার্ট। যাদের দিলটা ভালো তাদের কিল্টাও কিন্তু স্পিডিলি আসে। শওকত মাহমুদ জানান, তিনি সংবাদ-এ আমার সঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছেন; আমাকে কখনো কাউকে প্রহারোদ্যত হতে দেখেননি।

সেদিন কথা কথায় আতাউস সামাদকে বলি, ১৯৯১ সালে ‘ভোরের কাগজ’-এ তিনি একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাবলির ওপর যে নিবন্ধ লিখেছেন তাতে একটা অসম্পূর্ণতা আছে। তিনি লিখেছেন, ‘ওই সময় লাহোর থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক  ‘সান’-এর ঢাকায় একটি ব্যুরো ছিল। আমি আর আমার বন্ধু আওয়াল খান দুজনে মিলে ওই ব্যুরো চালাতাম।’ আমি বলেছি, আপনি তো ব্যুরো চিফ ছিলেন। তথ্যটা চেপে গেছেন।

‘হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক।’ বলেন আতাউস সামাদ, ‘চেপে গিয়েছি। ওটা এক ধরনের তৃপ্তি। তোমারও তো বয়েস হচ্ছে। একটা বয়সে পৌঁছে বুঝবে বন্ধুকে ছোট করে যাদের বড় হতে হয় তাদের মতো কাঙাল ত্রিভুবনে নাই।’

কাঙাল কাহারে কয় : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ হওয়ার পর কিছুদিন জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দিলেও বেশি মনোযোগী ছিলেন রাজনীতিতে। তিনি স্বজেলা নোয়াখালীতে থিতু হলে তাঁর জায়গায় দলের কেন্দ্রীয় কৃষি সম্পাদক হন মতিয়া চৌধুরী।

প্রায় তিন বছর হলো হানিফ ভাই দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। আমার বয়সী প্রাক্তন ছাত্রলীগারদের অনেকের স্মৃতিতে হানিফ ভাই এক অক্ষয় সম্পদ। নীতিনিষ্ঠা, সততা আর বিদ্যানুরাগ তাঁকে মহান করে তুলেছিল। শৈশবে তাঁর বাবা মারা যান। সীমাহীন অনটনের ভিতর মানুষ হয়েছেন। যখন জিলা স্কুলে পড়তেন তখন আমার বোনের বাড়িতে লজিং থাকতেন। সে বাড়ির লোকেরা তাঁকে যে গভীর মমতায় আগলে রাখতেন, সংসদ সদস্য হওয়ার পর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর কণ্ঠ।

অধ্যাপক হানিফ বলতেন, ‘দারিদ্র্য কুৎসিত। তার চাইতেও কুৎসিত কপট বড়লোকী।’ তাঁর স্কুলজীবনের একটি ঘটনা বলেছিলেন। তখন নাইনে পড়েন। ক্লাস টিচার জানান, আমেরিকা কিছু শীতবস্ত্র উপহার দিয়েছে পাকিস্তানের গরিব ছাত্রদের জন্য। তোমরা যারা নিতে আগ্রহী নাম বল, আমি তালিকা করছি। ক্লাসের চারদিক থেকে একযোগে আওয়াজ উঠল-‘হানিফের নাম লিখুন স্যার, হানিফের নাম লিখুন। ও খুব গরিব।’ শীতবস্ত্রের চারটি বড় কার্টন রাখা ছিল টিচারের আসনের পাশেই। ক্লাস মনিটর একটি কার্টন খুলে ভিতরের মাল যাচাই করে। একেবারে ব্র্যান্ড নিউ বাহারি ডিজাইনের উলের পুলওভার সব। ওটা দেখে বড়লোকের পুত্ররা উদ্বেগাফুল হয়ে হাঁক দেয়-‘আমার নাম লিখুন স্যার, আমার নাম লিখুন।’

মোহাম্মদ হানিফ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘স্যার মেহেরবানি করে আমার নামটা কেটে দিয়ে এদের নাম লিখুন। মাগনায় শীতের কাপড় পাওয়া এদের বেশি দরকার। আমি গরিব। এরা তো কাঙাল। কাঙালের আকুতিতে সাড়া দেওয়া গরিবের কর্তব্য।’

কবিতার গন্ধ : ডেইলি স্টার-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সৈয়দ ফাহিম মোনায়েম ১/১১ সরকারের জমানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব হয়েছিলেন। তাঁর বাবা সৈয়দ নূরউদ্দিন সাংবাদিক এবং কবি হিসেবে স্বনামখ্যাত ছিলেন। সৈয়দ নূরউদ্দিন বহু বছর বিদেশে চাকরিবাকরি করে জেনারেল জিয়ার আমলে দেশে ফিরে আসেন। তখন আমি সংবাদ-এ। এ পত্রিকায় তিনি উপদেষ্টা সম্পাদক নিযুক্ত হন। খুবই আধুনিক মনের মানুষ। তরুণদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলে বিশুদ্ধ কিশোরগঞ্জিয়া ভাষায় বাংলা বলতেন। কিন্তু তাঁর কাব্যভাষা ছিল মোহন। এজন্য ত্রিশের দশকের সেরা কবিদের অন্যতম বলে গণ্য হতেন।

আমাদের দাদু আফলাতুন ছিলেন কবি সৈয়দ নূরউদ্দিনের জুনিয়র দোস্ত। এক বিকালে তাঁরা দুজন প্রেস ক্লাবের বৈঠকঘরে গোলটেবিল ঘিরে পরচর্চা করছেন। এমন সময় স্যুটেড-বুটেড দুই ভদ্রলোক এলেন। এরা সাংবাদিক নন। একজন ইতালি থাকেন, সৈয়দ নূরউদ্দিনের পুরনো পরিচিত। বললেন, ‘সৈয়দ ভাই, আপনার অমুক কবিতায় অসাধারণ কিছু শব্দ পেলাম। এত চমৎকার ব্যবহার করলেন সেই শব্দগুলো। মারভেলাস! ম্যাজিকটা কী বলুন তো।’

‘ম্যাজিক-ফ্যাজিক কিছু না।’ ফুরফুরে মেজাজে বলেন সৈয়দ নূরউদ্দিন, ‘টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, টয়লেটে আমি যখন হাই কমোডে বসি, বিচিত্র সব শব্দ তখন মাথায় আসে। টয়লেট থেকে বেরিয়েই শব্দগুলো নোট করে রাখি। যখন কবিতা লিখতে বসি, নোটবই থেকে শব্দগুলো নিয়ে লাগসই লাইনে বসাই। দ্যাটস অল।’

আফলাতুন বলেন, ‘অ!’

‘অ করছিস কেন’ জানতে চাইলেন কবি সৈয়দ নূরউদ্দিন, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই অ?’

‘অ মানে বুঝলাম আর কী।’

নূরউদ্দিন, ‘কী বুঝলি?’

আফলাতুনের উত্তর, ‘বুঝলাম, কেন আপনার কবিতায় এত দুর্গন্ধ।’

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর