ট্রি প্ল্যান্টের অফিস দ্বীপ বনের উত্তর-পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত। প্রায় তিন একর জায়গায় অফিস চত্বর। জায়গাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা, গুটিকয়েক শোভাবর্ধনকারী গাছ-গাছালি থাকলেও সেগুলো তত ক্ষতির কারণ হয় না আমাদের। বরং বৃক্ষছায়ায় শীতল হওয়ার সুযোগ থাকে। মাঠের মতো প্রশস্ত চত্বরটিতে প্ল্যান্ট থেকে আহরিত কাঁচামাল শুকানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। প্ল্যান্টের অফিস মোটাসোটা শালের খুঁটির ওপর টিন-কাঠের নির্মিত চমৎকার একটি ভবন। অফিসের পাটাতন সেগুনকাঠের। মসৃণ চকচকে যেমন, টেকসইও তেমনি কাঠগুলো। ভবনের উচ্চতা দোতলা সমান। কাঠের মই মাড়িয়ে ওপরে উঠতে হয়। বুনো কুকুর আর খেপাটে মহিষ থেকে বাড়তি সতর্কতা নিতেই খুঁটির ওপর অফিস নির্মাণ করা হয়েছে।
ছোট বড় মিলিয়ে পাঁচটি কামরা অফিসের। একটি কামরায় আমি অফিস চলাকালীন বসি। পাশের কামরায় পর্যায়ক্রমে বসেন বিনয় ভৌমিক আর সিকান্দার বারী। তারা দুইজন প্ল্যান্টের সহকারী ম্যানেজার। অর্থকড়ি, হিসাব-কিতাব, কাগজপত্র দেখাশুনা করেন বাহারুদ্দিন আর নরেন বিশ্বাস, তারা বসেন একটি কামরায়। অন্য কামরায় বসেন সম্পদ রক্ষাকারী বোরহান মল্লিক আর প্রহরীপ্রধান তৈমুর আলী। অপরদিকে ১২ জন প্রহরীর মধ্যে ৮ জনের আরেকটি কামরা। বাকি ৪ জন প্রহরী থাকে শাখা অফিসে। আর ছোট্ট আরেকটি কামরা আছে অবশ্য, সেটি খুবই ছোট। সেটাকে কামরা বলা ঠিক হবে না। সেখানে লোহার একটা সিন্দুক থাকে শুধু। কোম্পানির যৎসামান্য অর্থকড়ি, কাগজপত্র ঘচ্ছিত থাকে সিন্দুকে। টয়লেট, কিচেন নিচে।
অফিস চত্বরের বাইরে টিনের ছাউনি দেওয়া উঁচু করে হাতিশালা বানানো হয়েছে। যেন ঝড়-বাদলেও নিরাপদে থাকে হাতিটা। মাহুতের থাকার ব্যবস্থাও আশেপাশে করা হয়েছে। দ্বীপ বনে হাতির প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করার নয়। এখানে গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হাতিছাড়া বিকল্প কিছু ভাবাই যায় না। বিশেষ করে আমাদের প্ল্যান্ট দেখাশুনা করতে হলে হাতির পিঠে চড়ে চলাচল করা অনেকটাই নিরাপদ।প্ল্যান্টের মধ্যখান দিয়ে রাস্তার মতো ফাঁকা একটা জায়গা রাখা হয়েছে। সেখানে কোন ধরনের গাছপালা লাগানো হয়নি। রাস্তায় ছোট ছোট ঘাসে আবৃত থাকলেও রাস্তার পাশে গুলঞ্চ লতা, আষাঢ়ি লতা, স্বর্ণলতা, বিকাশ লতা, গিলা লতা, পিপুল লতায় ঠাঁসা। শুধু লতায় আর লতায় রাস্তার পাশ ছেয়ে আছে। লতায় যখন ফুলফোটে রাস্তার দু’পাশ তখন বাহারি রঙে রাঙিয়ে যায়, ফুলের হালকা মিষ্টিঘ্রাণে নেশাগ্রস্তের মতো উদাস লাগে তখন। এই সময় মৌমাছিদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। পুষ্পরস পানে ব্যস্ত থাকলেও আনন্দে গুঞ্জন করে বনপ্রান্তর মুখরিত করে তোলে। এই লতাগুলোর অনেক কদর প্ল্যান্টে, এগুলো ঔষধিলতা, প্রচুর ভেষজগুণ। ফলে ইচ্ছা সত্ত্বেও লতাগুল্ম ছাঁটাই-টাটাই করতে পারি না। লতাগুল্মের কারণে হাতির যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটে না কখনো, অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারে। তবে মানুষের পায়ে হেঁটে যাতায়াতের জন্য রাস্তাটি মোটেও নিরাপদ নয়; বিপজ্জনক। যত্রতত্র সাপখোপ শুয়ে থাকে রাস্তায়, তার ওপর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে থাকে বুনো কুকুরের পাল। সুতরাং সাবধান হতে হয় আমাদের, তাই হাতির পিঠে চড়াই নিরাপদ মনে করি আমরা। তাছাড়া হাতির পিঠে চড়ে একদিনে প্ল্যান্টের বেশ কিছু জায়গা প্রদক্ষিণও করতে পারি। অন্যান্য বাহন এখানে অনুপযুক্ত। বন্যপ্রাণী আইনে বনের ভেতর শব্দ হয় অমন যানবাহন নিষিদ্ধ হওয়ায় মোটরবাইক চালানো যায় না। অবার সাইকেল চালানোও নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় ঘোড়ায় চড়াও। বুনো কুকুর, খেপাটে মহিষ সামনে পড়লে ভয়ঙ্কর বিপদ। যে বিপদের মুখোমুখি হলে পালিয়ে আসা কঠিনতর। অনেক কিছু চিন্তা করেই কোম্পানি থেকে লাইসেন্সকৃত ভারতীয় এই মাদী হাতিটি সরবরাহ করা হয়েছে। যাতে করে হাতি অন্যসব হিংস্রপ্রাণী তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো।
হস্তি শাবটাকে যখন আনা হয়েছিল তখন ওর বয়স ছিল ২ বছর। জেলা সদর পর্যন্ত সড়কপথে এসেছিল, তার পর নদী পার করতে ফেরিতে করে আনা হয়েছে। সেই থেকেই আমাদের প্ল্যান্টে আছে ১৫ বছর ধরে। সেই হিসেবে ওর বয়স ১৭ বছর। মাহুত মোহন মাঝি ওর অভিভাবক। শুরু থেকেই দেখাশুনা করে। দুই জনের মধ্যে দারুণ ভাবসাব, খুব খাতির, মেরে ধরে কাজ করাতে হয় না। বন্যপ্রাণী আর মানুষের মধ্যে এমন খাতির হতে পারে তা আমাদের মায়ারানীকে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। বলতে ভুলে গেছি, আমাদের মাদী হাতির নাম মায়ারানী।
বিশাল আয়তনের প্ল্যান্ট একদিনে পরিদর্শন করে শেষ করা যায় না। রাতের আঁধার নামার আগেই যদি ফিরে আসি তাহলে বাকি অংশের খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব হয় না আর। বিষয়টি চিন্তা করে আমরা প্ল্যান্টের মধ্যবর্তীস্থানে দুই কামরার একটি শাখা অফিস বানিয়েছি। সেখানে আমাদের সহকারী ম্যানেজারদের একজন করে পর্যায়ক্রমে ডিউটি করেন। এছাড়াও সেখানে ছোটখাটো একটা বাংলো আছে, মাসে অন্তত একবার আমাকে সেখানে রাত্রিযাপন করতে হয়, হিসাব-কিতাবের বিষয় আছে। সহকারী ম্যানেজার ছাড়াও সেখানে ৪ জন প্রহরী নিয়মিত ডিউটি করেন। আর ১৪-১৫ জন শ্রমিকও সেখানে থাকে। তারা বনের ওই দিকে কাজকর্ম করে। এতে কাজের সুবিধা হয়। তবে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে বা খবরাখবর আদান প্রদান করতে হলে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। ওয়াকিটকি থাকলেও ফিকোয়েন্সি এতটা কভারেজ করে না। সে ক্ষেত্রে দোনালা বন্দুক সঙ্গে নিয়ে দুই তিনজন একত্রিত হয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতটাই ভয়ঙ্কর এই বনের বুনো কুকুর আর মহিষগুলো। এখানে চোর ডাকাতের তেমন উৎপাত নেই, আছে বুনো জানোয়ারের উপদ্রব। যে উপদ্রব খুবই ভয়ঙ্কর; যার কারণে জীবন মরণের খেলা ঘটে!
দ্বীপ বনের একটি ভয়ঙ্কর উদ্ভিদ ‘পার্থেনিয়াম’। যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচতে সক্ষম এই উদ্ভিদটি। উদ্ভিদটি সাধারণত এক থেকে দেড় মিটার উচ্চতার হয়। অসংখ্য শাখা; ত্রিভূজের মতো ছড়িয়ে থাকে। ছোট ছোট সাদা ফুল হয়। গাছটির আয়ুষ্কাল মাত্র তিন-চারমাস। এরইমধ্যে ৪ থেকে ২৫ হাজার বীজ জন্ম দিতে সক্ষম। উদ্ভিদটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। গবাদিপশু চরানোর সময় ওদের গায়ে লাগলে শরীর ফুলে যায়। এ ছাড়াও তীব্র জ্বর, বদহজমসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। আর পশুর পেটে গেলে তো কথাই নেই, মারাত্মক বিষক্রিয়া ঘটে। বিশেষ করে গাভী পার্থেনিয়াম খেলে দুধ তিতা হয়। ওই দুধ অনবরত কেউ খেলে সে লোকের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। শুধু পশুই নয়, উদ্ভিদটি মানুষের হাতে-পায়ে লাগলে লাল হয়ে ফুলে যায়। পাশাপাশি ত্বকে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। আক্রান্ত মানুষটির ঘনঘন জ্বর, অসহ্য মাথাব্যাথা ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে থাকে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
উদ্ভিদটিকে পুড়িয়ে ফেলতে হলেও সতর্ক থাকতে হয়। যেমন: এটি কেউ কাটতে গেলে ব্যক্তির হাতে-পায়ে লাগতে পারে। পোড়াতে গেলে ফুলের রেণু দূরে উড়ে বংশবিস্তার ঘটাতে পারে। আবার ব্যক্তির নাকে, মুখেও লাগতে পারে। তাতে করে তিনি মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রথমে উদ্ভিদটিকে নিধন হয়।
সবচেয়ে ভালো হচ্ছে জৈবিক প্রক্রিয়ায় দমন করলে। তাতে করে ক্ষতির শঙ্কা নেই বললেই চলে। এই পদ্ধতিতে নানা ধরনের পাতাখেকো অথবা ঘাসখেকো পোকার মাধ্যমে পার্থেনিয়াম দমন করা যায়।
উদ্ভিদটি মানুষ এবং গবাদি পশুর যেমন ক্ষতি করে তেমনি আবার উপকারও করে। এর রয়েছে কিছু ঔষধি গুণও। এই আগাছা থেকে মানুষের প্রচণ্ড জ্বর, বদহজম, টিউমার, আমাশয়সহ নানা ধরনের জটিল রোগের প্রতিষেধক তৈরি হচ্ছে। এমনকি গবেষকরা মরণব্যাধি ক্যান্সারেরও প্রতিষেধক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এই প্ল্যান্টে পার্থেনিয়ামের চাষাবাদ করা হয় না। তার পরেও উদ্ভিদটি যে কীভাবে ছড়িয়েছে তা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে ভেষজ উদ্ভিদের বীজের সঙ্গে পার্থেনিয়ামের বীজ এসে বনপ্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়াতে আমাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হচ্ছে। আর শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পার্থেনিয়ামকে আমরা জৈবিক উপায়ে নিধনও করছি।
আমার বড়ো বাংলোটি প্রধান অফিসের সন্নিকটেই। সেটিও অফিস আদলেই তৈরি। বাংলোর পশ্চিমপাশ কুঞ্জলতার দখলে। থোকায় থোকায় অগনতি লাল-গোলাপি ফুলফোটে মৌসুমে। গন্ধ না থাকলেও নজরকাড়া রূপে আকৃষ্ট হই আমি। এরা এক বর্ষীলতা, বছরান্তে বীজ বুনতে হয়। বাংলোর সামনে অপরাজিতার ঝোঁপ। শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে সাপের জিভের মতো লকলক করছে বারান্দার রেলিং ধরতে। বেয়ে ওপরে উঠার প্রাণান্তকর চেষ্টায় হেরে গেছে লতাগুলো। বাওনি না থাকায় লতাগুলোর আর বারান্দা দর্শন ঘটেনি। অপরাজিতার ফুলগুলোও বেশ আকর্ষণীয়। গাঢ় নীলবর্ণের ফুলগুলো মিষ্টি হাসি হেসে আমাকে আকুল করে তোলে। দক্ষিণে বাংলো লাগোয়া মাঝারি আকৃতির একটা নিমগাছ। বৈশাখের দখিনা হাওয়ায় নিমফুলের মিষ্টিঘ্রাণ নাকে ঠেকিয়ে বিভোর করে দেয় আমাকে। তাই বাংলোকে আড়াল করে রাখলেও গাছটিকে কাটতে দেইনি, বাঁচিয়ে রেখেছি। আর অপরাজিতা ঝোঁপের পাশ থেকে পশ্চিমে হাসনাহেনার সারিবদ্ধ কয়েকটি গাছ। মৌসুমে হাসনাহেনা ফুটলে ভুরভুর করে গন্ধ ছড়িয়ে সমস্ত অফিসপ্রাঙ্গণ সৌরভে ভাসিয়ে দেয়। সেই মায়াময় মনোহরণকারী গন্ধে কেমন জানি উতলা হয়ে পড়ি। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সেও আমি নেশাগ্রস্তের মতো হয়ে উঠি। বিভোর হয়ে পড়ি প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে, মন আকুলিবিকুলি করে তার কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু ছুটে যে যাব, কোথায় যাব? তিনি যেখানে আছেন সেখানে কী ইচ্ছে করলে যেতে পারব আমি! তিনি নক্ষত্ররাজ্যে ঘুমাচ্ছেন; ঘুমকাতুরে মানুষ ত, শুধু ঘুম আর ঘুম! আর একমাত্র মেয়ে তার বরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায় স্থায়ী হয়েছেন। আমাকে স্থায়ী করতে চেয়েছেন জামাই-মেয়ে মিলে, কিন্তু আমি রাজি হইনি। এই সবুজ প্রান্তরেই আমি ভালো আছি, পরম শান্তিতে আছি। এখানকার সোঁদামাটি, জলবায়ু, ফুল-ফল, গাছ-গাছালির কাছে আমার অনেক ঋণ, অনেক; বলে শেষ করার নয়। এখানে আমার রোজ ঘুমভাঙ্গে দোয়েলের কিচিরমিচির মিষ্টি শিসে। ভুবন চিলের আর্তনাদে টেরপাই মধ্যাহ্ন গড়াচ্ছে। ডাহুকের ডাকে আভাস পাই রাতের আঁধার সন্নিকটে। আর কানকুয়ার প্রহরধ্বনি স্মরণ করিয়ে দেয় বিছানায় যাওয়ার সময় হয়েছে। প্রকৃতির স্বয়ংক্রিয় এই এ্যালার্ম আমি কোথায় পাব! কোথায় দেখব আমি আকাশ কাঁপিয়ে বেড়ানো শামুকখোলের ঝাঁক। কোথায় দেখব আমি জলাশয়ের কিনারে একপায়ে দাঁড়ানো ধবধবে সাদাবকের সারি। কোথায় শুনব আমি বসন্ত বউরির ‘টুক..টুক..’ ধ্বনি। মাঠপ্রান্তরে একাকী দৌড়ে বেড়ানো হট্টিটির দেখাই বা পাব কোথায়! আমি ভালো আছি, বেশ আছি, সন্তানকে বলে দিয়েছি তাই।
বাংলোর কামরা দু’টি আমার জন্য বরাদ্ধ হলেও একটিতে মহব্বত দয়ালকে থাকতে দিয়েছি। সে প্ল্যান্টের বাবুর্চি হলেও আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত। প্ল্যান্টের প্রত্যেক প্রহরীরাই আলাদা আলাদা দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। যেমন মহব্বত দয়ালকে দিনে রান্নাবান্না আর রাতে ম্যানেজারের নিরাপত্তা দিতে হয়, কোম্পানির নিয়ম এটি। আগের ম্যানেজারের নিরাপত্তার দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন মহব্বত দয়াল। মানুষ হিসেবে সে খুব বিশ্বস্ত, তাকে আমার খুব পছন্দও, তাই কাছাকাছি রেখেছি।
রাতে আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেও টয়লেটের ৮-১০ মিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে মহব্বত দয়াল। মাঝেমধ্যে খুব বিরক্ত হই তার এ পাগলামিতে। একদিন বললাম, ‘তোমাকে আমার সঙ্গে নিচে আসতে হবে না আর। উপরে যাও এখন।’
মহব্বত দয়াল কাতর কণ্ঠে বলল, ‘এই কথা আর কোনদিন বলবেন না বড়মিয়া। আগের বড়মিয়া মস্ত ভুল করেছেন আমাকে সঙ্গে না নিয়ে। তিনি একাই জঙ্গলে ঘুরতে বেরিয়েছেন। তারপর আর ফিরে আসেন নি।’ কথা শেষ করেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে দেয় সে।
বলি, ‘শান্ত হও তুমি। তার আত্মার জন্য দোয়া কর।’
সে বলল, ‘বড়মিয়া খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাকে কোনমতেই ভুলতে পারছি না আমি।’ কথা শেষ করে আবার কাঁদতে লাগল মহব্বত দয়াল।
বললাম, ‘কান্না করো না, তুমি আমার কাছেই থাকো, সমস্যা নেই।’
বলে রাখি, প্ল্যান্টের লোকজনের কাছে ম্যানেজার পদধারী হচ্ছে ‘বড়মিয়া’। সেসুবাদে সবাই আমাকে বড়মিয়া ডাকেন। এই সম্বোধনে আমি খুব শান্তি পাই, তৃপ্তি পাই। বাবার বড়ছেলে ছিলাম বিধায় এলাকাবাসি আমাকে বড়মিয়া ডাকতো, বাবাও। বাবা ডাকতেন 'শাস্তি' দেওয়ার অর্থে। কোন অন্যায় করলে মাকে ডেকে বলতেন, ‘তোমার বড়মিয়াকে সাবধান করো।’
এভাবে এলাকাবাসির কাছে আমি ‘মঞ্জুর আহম্মেদ’ বড়মিয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। আর বাবা-মায়ের দেওয়া নামটা এলাকায় হারিয়ে ফেলি এক সময়।
প্ল্যান্টের লোকজনের কাছে এই ডাকশুনে এখন আমি তৃপ্ত হই, পরান জুড়িয়ে যায় আমার। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। বাবার কথাও খুব মনে পড়ে।
মহব্বত দয়ালের কান্নায় আমি চুপসে গেলাম, তার আবেগে বাধা সৃষ্টি করিনি আর। অপরদিকে ভয়ে আতঙ্কে আমার শরীর হিম হয়ে এল, ম্যানেজার সালেহ দেওয়ানের করুণ পরিণতির ঘটনা মনে পড়তেই আমি আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। এই দ্বীপ বনের বুনো কুকুরই নয়, এখানকার অধিকাংশ প্রাণীই হিংস্র। কেউ কোরো চেয়ে কম নয়। তবে সবচেয়ে হিংস্র এবং খেপাটে হচ্ছে মহিষের পাল। ভীষণ ভয়ঙ্কর। মেজাজ বিগড়ে গেলে কারও রক্ষা নেই। বাঘের হিংস্রতাকে হার মানায়। গুলিবিদ্ধ করেও থামানো যায় না, আহত অবস্থায়ই বন-বাদাড় কাঁপিয়ে ছাড়ে। যেন প্রতিশোধ নেওয়া চাই-ই চাই। জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেও নিস্তার নেই, পেছন পেছন নেমে আসতে চায়। কী যে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার-স্যাপার তা বলে বোঝানোর নয়! এ ধরনের ঘটনা আমাদের এখানে অনেকবারই ঘটেছে। তবে এরা যখন তখন কাউকে আক্রমণ করে না; সামনে পড়লেও না। উত্যক্ত হলে কিংবা ক্রোধান্বিত হলেই কেবল মানুষের ওপর চড়াও হয়। মহিষগুলো ছোট-বড়দলে বিচরণ করে, তবে মাঝেমধ্যে দলছুট খেপাটে মহিষের কারণে প্ল্যান্টের গাছ-গাছালির ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং জীবন রক্ষায় শঙ্কিত হলেই কেবল প্ল্যান্টের দোনালা বন্দুক গর্জে ওঠে, তার আগে নয়।
মহিষ শিকার করা হলে প্ল্যান্টের স্টাফদের মাঝে রাতদিন আমোদ-ফুর্তি চলে। কোন ভেদাভেদ থাকে না সেদিন স্টাফদের মধ্যে। প্ল্যান্টের শ্রমিকরাও সেই আনন্দে অংশ নেয়। সবাই মিলে কাজ করে; চামড়া ছাড়ানো, মাংসকাটা, রান্নাবান্নাসহ সব ধরনের কাজ। সোজাকথা খুব আমোদ করে প্ল্যান্টের লোকজন। ঈদ উৎসবকেও সেই আমোদ হার মানায়। আমি তাদের আনন্দ ফুর্তিতে কখনো বাগড়া দেয় না বরং আমিও শরীক হই।
আবার রাতের উৎসব ভিন্ন। সেই দায়িত্ব মহব্বত দয়ালের ওপর। মহিষের মাংসে নানান ধরনের মসলারগুড়ো মেখে রাখে ঘণ্টা খানেক। তার পর মাংস শিকে গেঁথে পুড়িয়ে কাবাব বানিয়ে খাওয়ায় সবাইকে। সঙ্গে সরিষার তেলেভাজা পরোটা তো আছেই। এ ছাড়াও মহব্বত দয়ালের হাতে আরও পঞ্চপদ রান্না করা হয়। যার ঘ্রাণেই জিভে জল আসে, ক্ষিধে পেয়ে যায় খুব দ্রুত। খেতে খেতে পেট ভরে গেলেও আরও খেতে ইচ্ছে করে।
মহিষের মাংস মোটামুটি সুস্বাদু; তেলচর্বিও কম, কিছুটা স্বাস্থ্যসম্মত। আমিও খেতে পছন্দ করি তাই। তবে খুব বেশি খেতে পারি না, উচ্চরক্তচাপের উৎপাত রয়েছে। তা ছাড়া বয়সের বিষয়টিও মাথায় আসে।
একেকটা মহিষ অনেক ওজনদার হয়। আট-দশমণের কম নয় ওদের শরীরের মাংস; তারও অধিক হতে পারে। সব মাংস আমরা খেতে পারি না। তাই অবশিষ্ট মাংস শ্রমিকদের মাঝে বিতরণ করে দেই। তারা খুব খুশি হয়। বাজার থেকে তাদের আর কখনো মাংস কেনার প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য প্ল্যান্টের কারোই মাংস কিনতে হয় না। শুধু মাংসই নয়, কোন ধরনের মাছও বাজার থেকে কিনতে হয় না। কারণ এখানে বনপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় প্রচুর বন মোরগ-মুরগী। ওরা এখন গৃহপালিতের মতো হয়ে গেছে। প্ল্যান্টে এসেই খাবার খায়, রাত্রিবাসও আশেপাশে করে। আমি ওদের জন্য বাসস্থানও বানিয়ে দিয়েছি। আর তাছাড়া আমাদের পালিত হাঁস-মুরগীর সঙ্গে ওরাও দল বেঁধে বংশবিস্তার ঘটিয়েছে, প্রয়োজন হলে সেখান থেকে জবাই করি।
এখানে অভাব নেই মাছেরও। নদীতে কিলবিল করে অসংখ্য প্রজাতির মাছ; শুধু মাছ আর মাছ। শ্রমিকদেরকে দিয়ে মাছ ধরিয়ে নেই আমরা। এমনকি ইলিশ মাছও। মেঘনার মোহনার কাছে জালপেতে রাখলে দুই-চার-দশটা ইলিশ পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় কোরাল, পোয়া, কইভোলা, চেঁউয়া, বেলে, মেদ, মারসৃপারি আরও নাম না জানা হরেক মাছ। ভীষণ সুস্বাদু সেসব মাছ। আমাদের প্ল্যান্টে সবজিরও অভাব হয় না। নানান ধরনের সবজি চাষ করি আমরা, মৌসুমের সবজিগুলো মৌসুমের শুরুতেই খেতে পারি তাই। এইসব কখনো বিক্রি করি না আমরা। শ্রমিকদের মধ্যেই বিতরণ করি আর অতিরিক্ত সবজিগুলো মায়ারানীর জন্য বরাদ্ধ রাখি। দ্বীপ বনে আমাদের পোষা মহিষও আছে, ফলে দুধের অভাব হয় না কখনো। অভাব হয় না ফলপাকুড়েরও।
সত্যি বলতে প্ল্যান্টে বাধ্য হয়ে খেপাটে মহিষ শিকার করতে হয়, কারণ মহিষ খুব উপদ্রব করে। প্ল্যান্টের ছোট ছোট গাছগুলো খেয়ে ফেলে। বিশেষ করে গোল মরিচের লতাগুলো মুহূর্তেই শেষ করে দেয়। তারপরও আমরা যখন তখন শিকার করি না। তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি। শুধু খেপাটে হলে বাধ্য হই শিকারের চিন্তা করতে। তবে মহিষ ব্যতিত প্ল্যান্টে অন্যকোন বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, আমার কড়া নিষেধ। নিষেধ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আমি কার্পণ্যবোধ করি না। এই দিকে আমি সর্বদাই সজাগ ও নিষ্ঠুর। না হলে এতদিনে চিতা হরিণের সংখ্যা অনেকটাই হ্রাস পেত।
দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর চিতা হরিণের বাস; হাজার হাজার। তা-ও পাঁচ-দশ-বিশহাজার নয়, তারও অধিক। এরা সংখ্যায় এতই বেশি যে খাদ্যসংকটে পড়ে ছুটে যাচ্ছে লোকালয়ে। লোকালয়ে গিয়ে প্রাণীগুলোর নিস্তার নেই, বিপদে পড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বুনো কুকুরের শিকারে পরিণত হচ্ছে চিতা হরিণগুলো। বুনো কুকুরগুলো নিঃসংশয়ভাবে শিকার করছে হরিণগুলোকে। এত বেশি শিকার করছে যে হরিণের সংখ্যা তাতে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। আর বেঁচেথাকা হরিণগুলো খাদ্যসংকটে পড়ে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সেই তুলনায় দ্বীপ বনের হরিণগুলো ভালো আছে।
খাদ্য সংকটের বিষয়টি চিন্তা করে আমরা প্ল্যান্টে আরেকটি হাতি আনার চিন্তাভাবনা বাদ দিয়েছি। ইচ্ছে ছিল মায়ারানীর সঙ্গী জোগানোর, কিন্তু সেই ইচ্ছে বাস্তবায়ন করতে পারিনি, শুধু খাদ্য সংকট হতে পারে ভেবে। একেকটি হাতির দৈনিক ১৫০-১৬০ কেজির খাবারের প্রয়োজন, যা জোগানো সত্যিই কঠিন। আমাদের দুটি হাতির বড়ই প্রয়োজন, তাহলে দুই অফিসের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হতো। প্ল্যান্টের ঘাসলতার অভাব নেই ঠিকই, কিন্তু দুটি হাতি থাকলে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। দ্বীপ বনের গাছ বা লতাগুল্ম ইচ্ছে করলেই হাতির খোরাক হিসেবে সরবরাহ করা যায় না। কারণ এই সব হচ্ছে ওষুধি গাছ। তাই মায়ারানীর জন্য আমরা কয়েক হাজার কলাগাছ লাগিয়ে বিশাল বাগান তৈরি করেছি। তাতে ওর খোরাকও হচ্ছে আবার গাছের কলাও খেতে পারছি আমরা। আবার অতিরিক্ত কলাগুলো মায়ারানীর জন্য বরাদ্দও রাখছি। নিয়মিত খাবার খেয়ে মায়ারানী বেশ সুস্থ সাবলীল আছে। ওর মেজাজমর্জিও সব সময় ভালো থাকে তাই। মাহুত ছাড়াও যে কেউ ওর কাছাকাছি গেলে অথবা পিঠে ছড়তে আবদার করলে ও নাখোশ হয় না। অবশ্য প্ল্যান্টের লোকজনকে এখন মায়ারানী চিনে ফেলেছে। তাই ও আমাদের দেখলে বা কাছাকাছি গেলে শান্ত থাকে। পিঠে চড়তে গেলে পেছনের পা বাঁকিয়ে দেয়। কখনো কোন ধরনের উৎপাত করে না সে, কষ্ট পেলেও না। খুব লক্ষ্মী মায়ারানী।
চলবে...
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা