শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমার প্রিয় ছবি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমার প্রিয় ছবি

স্টি জোন দ্য ব্যাপিস্ট ব্রিং উইটনেস, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, (১৫০৬-০৭)

মোনালিসার ছবি আঁকতে দ্য ভিঞ্চি লিসাকে মডেল হিসেবে পেয়েছিলেন; বাইবেলের ওই ১৩ জন মানুষের কোনো মডেল তার কাছে ছিল না; কল্পনার সাহায্যে ছবিগুলো তৈরি করে নিতে হয়েছে, বাইবেলের কাহিনী অনুসরণ করে। ছবির ১৩ জনকে নাম ধরেই চেনা যায়। নামগুলো পাওয়া গেছে দ্য ভিঞ্চির নোটবুকে। বাঁ দিক থেকেই দেখা শুরু করার কথা, দ্য ভিঞ্চি বাঁ হাতে লিখতেন, এই ছবিটির ১৩ জনকে বাঁ দিক থেকে দেখাটাই স্বাভাবিক মনে হয়। যিশুর কাছে বসেছে তিনজনের যে দলটি, তার শেষ প্রান্তে রয়েছেন সন্ত জন, যিশুর সবচেয়ে কাছে। সবার চেয়ে কম বয়স্ক তিনি। যিশুর ঘোষণা শুনে তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে উল্টো দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তার সবকিছুতে নিষ্পাপ কোমলতা। কেউ কেউ এমনও বলেন, ওই ছবিটি পুরুষের নয়, একজন নারীর, যার সঙ্গে যিশুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ওই কাতর মানুষটির পাশে বসে আছেন পিটার, তার হাতে একটি ছুরি। টেবিল থেকে তুলে নিয়েছেন। এটা তার চরিত্রের সঙ্গে মেলে। তিনি আবেগপ্রবণ। বিশ্বাসঘাতকটিকে চিনতে পারলে তাকে খুন করবেন ভাবটা ওই রকমের। উদ্যানে গিয়েছিলেন তলোয়ার হাতে। সরকারি লোকেরা যখন যিশুকে আটক করে, পিটার তখন তলোয়ার খুলে দাসদের একজনের কান কেটে নেন। যিশু তাকে তলোয়ার সামলাতে বলেন এবং নিজের অলৌকিক ক্ষমতাবলে কানটি জোড়া লাগিয়ে দেন। টেবিলে বসা-সন্তদের একজনকে দেখা যায় তর্জনী উঁচিয়ে রেখেছেন। উম্মোচিত সত্যকে তিনি গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন। আরেকজন দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছেন হতাশায়। তৃতীয় ব্যক্তি যিশুর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, জানতে চান ঘোষণাটির তাৎপর্য কী। চতুর্থ দলটির একজন দুহাত দিয়ে যিশুকে দেখাচ্ছেন, অন্য দুজন যিশুর ঘোষণা নিয়ে কী ভাবছেন, সেটা জানতে চান, এই তিনজনকে দেখা যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন এই মাত্র যা শুনলেন তার অর্থ নিয়ে।

ছবির ভিতরে একটা চাঞ্চল্য। ভিঞ্চি চাঞ্চল্যকে স্থিরচিত্রে নিয়ে এসেছেন; কিন্তু একটা ছন্দ আছে সমস্তটা ছবিজুড়ে। আলো-আঁধার মিলেমিশে রয়েছে। মানুষগুলো স্বতন্ত্র, কিন্তু তারা একটি সম্পর্কের ভিতর আবদ্ধ। দ্য ভিঞ্চি ছন্দে বিশ্বাস করতেন। সমস্ত ছবিটা যেন একটা কবিতা। বাস্তবসম্মত, অথচ কল্পনাসমৃদ্ধ; স্থির, কিন্তু জীবন্ত। জানালাপথে জনপদ দেখা যায়। সেখানে এক ধরনের চলমানতা রয়েছে। জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলছে; ঘরের ভিতর কী ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রকৃতি ও বাইরের মানুষের কোনো অনুভূতি নেই।

শেষ সান্ধ্যভোজনের এই ছবিটি একটি দেয়ালচিত্র। সন্ন্যাসীদের খাবার ঘরের দেয়ালের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য আঁকা। দেয়ালের কারণে ছবিটি যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, শিল্পী তার জন্য যতটা সম্ভব যত্ন নিয়েছেন। তার ভিতর একজন বিজ্ঞানী ছিলেন; বিজ্ঞানমনস্কতাকে তিনি তার শিল্পকর্মে নিয়ে এসেছেন। মাত্রা, প্রেক্ষিতে, পরিসর সবকিছুই নিখুঁত। ছবিটি আঁকার আগে আর্দ্রতা ও উষ্ণতার প্রতিষেধক হিসেবে দেয়ালটির গায়ে তিনি পলেস্তরা করিয়ে নিয়েছেন। একটি নয়, দুটি। ছবির পেছনে যাতে একটি আভা থাকে, তার জন্য সীসার মতো রং বুলিয়ে নিয়েছেন। ছবির মানুষদের পোশাকের ব্যাপারে দ্য ভিঞ্চি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। লাস্ট সাপারেও সেটা দেখা যায়। পোশাকগুলো ইতিহাস সমর্থিত এবং রঙিন। ছবিটি ঘন রং ও তেল রঙে আঁকা। ছবিটি আঁকার আগে তিনি অনেকগুলো ড্রয়িং করেছেন, তার নোটবুকে যেগুলো পাওয়া গেছে, ছবির মানুষগুলোর নামও নোটবুক থেকে লিখে রেখেছিলেন তিনি। ছবিটিকে রক্ষা করা সহজ হয়নি। আবহাওয়া বিরূপ ছিল। পাঁচশ বছরে যুদ্ধবিগ্রহ বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক কিছু ঘটে গেছে, তবু যে ছবিটি রক্ষা পেয়েছে সেটি শিল্পকলা ও বোদ্ধাদের জন্য এক পরম সৌভাগ্য।

 

 

লাস্ট সাপারের স্রষ্টা সৃষ্টির চেয়ে কম মহৎ ছিলেন না। ইউরোপীয় রেনেসাঁর তিনি যোগ্য প্রতিনিধি। কেবল প্রতিনিধি নন, সেই ঐতিহাসিক এবং জগৎ বদলে দেওয়া ঘটনার মর্মচেতনা তার জীবন ও কর্মের ভিতর দিয়ে যেভাবে মূর্ত করে উঠেছে, তার দৃষ্টান্ত রেনেসাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাসেও বিরল।

রেনেসাঁ ছিল মানবমুক্তির আন্দোলন; ঈশ্বরের জায়গায় সে মানুষকে স্থাপন করেছে; ধর্মবাদিতার জায়গায় নিয়ে এসেছে ইহজাগতিকতাকে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভিতর ওই গুণটিই বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অধিকাংশ ছবি এঁকেছেন; প্রতিষ্ঠিত রীতি ছিল ওইটিই। কিন্তু তার কোনো ছবিই ধর্মীয় নয়। সব ছবিই ইহজাগতিক। সেখানে মানুষই প্রধান, ঈশ্বর নন। ঈশ্বর আছেন ঈশ্বরের জায়গায়, থাকুন তিনি সেখানে, কিন্তু মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়বে বোধটা ছিল এই রকমের। এই বোধ ধর্মনিরপেক্ষতার জম্ন দিয়েছে। মানুষের কৌত‚হল ও সৃষ্টিক্ষমতা মুক্তি পেয়েছে। সে বেরিয়ে পড়েছে বিশ্ব পরিভ্রমণে, কেমন জাহাজ নিয়ে তেমনি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার তাড়নায়। দ্য ভিঞ্চি তার নিজের মধ্যে এই বোধকে সৃষ্টিশীলরূপে ধারণ করেছেন। তিনি একাধারে শিল্পী ও বিজ্ঞানী। স্থাপত্য, ভাস্কর্যে ও সংগীতে তার আগ্রহ ছিল; মানুষের শারীরতত্ত¡ তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন; হাসপাতালে গিয়ে শব ব্যবচ্ছেদে অংশ নিয়েছেন, দেখেছেন মাংসপেশি ও শিরা-উপশিরার অবস্থান। সে জ্ঞানকে নিয়ে এসেছেন তার শিল্পকলায়। তার কল্পনাশক্তি বাস্তববাদিতাকে ধারণ করে অসাধারণত্ব পেয়েছে। রেনেসাঁ জ্ঞানের শক্তিতে বিশ্বাস করত এবং সব ধরনের জ্ঞানেই আগ্রহী ছিল। দ্য ভিঞ্চিও ছিলেন ওই চেতনারই ধারক।

দ্য ভিঞ্চির মধ্যে একজন সন্ত ছিলেন, খাদ্যাভ্যাসে তিনি ছিলেন নিরামিষাশী, তার প্রিয় শখের একটি ছিল খাঁচায় পোরা পাখিদের কিনে এনে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া। আকাশ তাকে ডাকত। উড়োজাহাজ উদ্ভাবনের ব্যাপারে তার চেষ্টা ছিল। অকৃতদার ছিলেন; কিন্তু ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। শিক্ষানবিশরা তার কাছে বন্ধুর মর্যাদা পেতেন; ওদিকে নৃপতি, ধর্মযাজক, ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার স্বচ্ছন্দ ওঠাবসা ছিল। শিল্পীর সমাজ-বিচ্ছিন্নতার ধারণা তার সময়ে ছিল না, সেটা পরে এসেছে, পুঁজিবাদের বিকাশের পথ ধরে এবং পুঁজিবাদের অভিঘাতে। তার আঁকা ছবি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়নি, সামাজিক সম্পত্তি হিসেবেই রয়ে গেছে। দ্য ভিঞ্চি শিল্পী, বিজ্ঞানী, সন্ত, আবার পুরোপুরি সামাজিক মানুষ। ছবিটি আঁকেন মানুষকে নিয়ে এবং মানুষের জন্য। কাজ করেছেন শহর রক্ষা ও নদীতে জল সরবরাহের উদ্যোগে। রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও। জম্ন তার এক গ্রামে, সেখান থেকে গেছেন ছোট শহর ভিঞ্চিতে, তারপর বড় শহর মিলানে, গেছেন আরও বড় শহর রোমে, গেছেন প্যারিসে ও হাঙ্গেরিতে। ব্যস্ত ছিলেন সর্বদা। রেনেসাঁর একটি বৈশিষ্ট্য মানুষের বহুমুখিতা, সেই গুণ অসাধারণ উজ্জ্বলতায় বিদ্যমান ছিল দ্য ভিঞ্চির জীবন ও কর্মে। তার এক শতাব্দী পরে এসেছেন উইলিয়াম শেকসপিয়র। শেকসপিয়রও অসামান্য; রেনেসাঁসের মর্মচেতনা তার ভিতরও কার্যকর; কিন্তু তাকে নাট্যকারই থাকতে হয়েছে, দ্য ভিঞ্চির মতো বহুমুখী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না; যুগের হাওয়া অনুক‚লে ছিল না; পুঁজিবাদ তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

ইতালিতে রেনেসাঁর চাঞ্চল্যকর বিশেষ রকমের প্রকাশ ঘটেছিল শিল্পকলায়। অসাধারণ তিনজন শিল্পীকে তখন পাওয়া গেছে। একজন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি; অন্য দুজন মাইকেল এঞ্জেলো ও রাফ্যায়েল। বয়সে দ্য ভিঞ্চি ছিলেন সবার বড়, তার জম্নোর ২৩ বছর পরে জম্নো মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, রাফ্যায়েলের জম্ন আরও আট বছর পরে। দ্য ভিঞ্চি এদের উভয়কেই প্রভাবিত করেছেন।

তার ছবিতে পৌরুষ আছে, কিন্তু ভিতরে আছে মাতার সংবেদনশীলতা। ধনবান পিতার বিবাহবহিভর্‚ত সন্তান তিনি, পিতার যত্ন এবং সম্পত্তির ভাগও পেয়েছেন, মা ছিলেন কৃষক পরিবারের মানুষ। কিন্তু তার কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে মাতার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তিনি বহন করতেন। মাতা মেরির ছবি তিনি অনেক কটি এঁকেছেন। মোনালিসাতেও মাতৃমূর্তির আভাস আছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিরা একবারই আসেন, লাস্ট সাপারও বারবার পাওয়া যায় না। যাবেও না।  [শেষ]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর