শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সুফিয়া কামালের সংগ্রাম

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সুফিয়া কামালের সংগ্রাম

কবি সুফিয়া কামাল [২০ জুন ১৯১১-২০ নএভজ্ঞঙ্কর ১৯৯৯]

‘অনন্যসাধারণ এই মানুষটি তার ৮৯ বছরের জীবনের প্রায় পুরোটা ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য অসত্য ও অসংগতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।’ কবি ও সংগ্রামী সুফিয়া কামালকে এভাবেই তার শুদ্ধা জানিয়েছেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট নাসিমা হক, তার ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও সুফিয়া কামাল’ প্রবন্ধে (চিরঞ্জীব সুফিয়া কামাল, মহিলা সমাচার, সুফিয়া কামাল সংখ্যা ২০০০ : ৪৭)। সুফিয়া কামাল অবশ্য সংগ্রাম করেছেন অনেকগুলো ক্ষেত্রে, অনেকগুলো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। গণতন্ত্রের পক্ষে তো অবশ্যই, তার সংগ্রাম ছিল নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের দাবিতে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের উদ্দেশ্যে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের লক্ষ্যে, সমাজ ও রাষ্ট্রে একাত্তরের চেতনার প্রতিফল যাতে নিশ্চিত হয় সেই অভিপ্রায়ে এবং সমাজের অধিকারবঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। এসব সংগ্রামের ক্ষেত্রগুলো যে সব আলাদা ছিল, তা নয়, একটি বরং ঢুকে গেছে অন্যটিতে। নারীর অধিকার রক্ষার সংগ্রাম বিস্তৃত হয়েছে অধিকারবঞ্চিতদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ তার সংগ্রামে। তারপরও সুফিয়া কামালের সক্রিয়তার অঞ্চলগুলো তাকে নিয়ে গেছে এক সংগ্রাম থেকে আরেক সংগ্রামে, এক প্রতিকূলতা থেকে ভিন্ন এক প্রতিকূলতার মোকাবিলায়। ৮৯ বছরের জীবন দীর্ঘই বলা যায়, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কিন্তু যত কাজ তিনি করে গেছেন, যত সংগ্রামে তিনি লিপ্ত হয়েছেন, সে বিবেচনায় তা মোটেও দীর্ঘ নয়। বলা যায়, তিন জীবনের কাজ তিনি এক জীবনেই করে গেছেন। এবং একটি পিছিয়ে পড়া, শিক্ষাহীন ও কুসংস্কারে সমর্পিত জাতিকে তিনি উজ্জীবিত করে গেছেন পরিবর্তনের মন্ত্রে। নিজের গড়ে ওঠার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের অন্তঃস্থিত পাঠগুলো গ্রহণ করে এবং পরিবারের প্রত্যেকের ভিতর এই পাঠগুলোর মর্মার্থ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। একইভাবে সমাজে ও রাষ্ট্রে যখন চোখ ফেলেছেন তিনি, একই পাঠগুলো যাতে সর্বত্র গৃহীত হয়, জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয়, সে চেষ্টাও করেছেন। নিজের ভিতরে তিনি কোনো বিরোধ রাখতে দেননি, সত্যকে সত্য বলে জেনেছেন, অসত্যকে অসত্য বলে এবং আজীবন এই পার্থক্যের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। ফলে সব সংগ্রামে তার অংশগ্রহণ ছিল সত্য ও সুন্দরের পক্ষে তার কিছু বিশ্বাসেরই প্রতিফলন।

২. নারী জাগরণে সুফিয়া কামালের অগ্রণী ভূমিকা সম্পর্কে এখন সবাই ওয়াকিবহাল। জীবনের শুরুতেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, একজন নারীকে বিকশিত হতে হয় একজন অর্ধ-মানব নয়, পূর্ণ মানব হিসেবেই। পুরুষের ক্ষেত্রে বিকাশের শর্তগুলো যা, নারীর ক্ষেত্রেও তা। পুরুষ-নারীর বিচরণ ক্ষেত্র সমাজ যেভাবে ঠিক করে দেয়, তাতে নারী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই অবরুদ্ধতা তার বিকাশের, জাগরণের পরিপন্থী। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ হলো আÍসচেতনতা, শিক্ষা, সাহস এবং কর্মক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুতি ও প্রত্যয়। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে যাতে এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়, সে লক্ষ্যে তিনি কাজ করেছেন। জীবনের শুরুতেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয়। ওই মহীয়সী সমাজ সংস্কারকের দর্শন ও কর্মোদ্যোগ সুফিয়া কামালকে প্রভাবিত করেছিল। অল্প বয়সের বৈধব্য তাকে অবরোধবাসিনী করতে পারেনি। বরং চাকরি নিয়েছেন কলকাতা পুরসভায়। সদস্য হয়েছেন রোকেয়ার গড়া আঞ্জুমানে খাওয়াতিন-ই-ইসলামের, যুক্ত হয়েছেন অল ইন্ডিয়া উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজে অংশগ্রহণ করেছেন, প্রান্তিক নারীদের কাছে সাহস আর সক্রিয়তার বাণী নিয়ে গেছেন, তাদের সাহায্য-সহায়তা করেছেন। ওই সময়ের নারী নেত্রীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তাকে তার পথ বেছে নিতে সাহায্য করেছে। ১৯৪৭ সালের পর তিনি মনোযোগী হয়েছেন বাংলাদেশের নারীদের শিক্ষা ও অন্যান্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে। সেই শুরু পঞ্চাশ থেকে নিয়ে সুফিয়া কামালের বহুমুখী সক্রিয়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল নারীর অধিকার সুরক্ষা। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদ ও পরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জš§ থেকেই এগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সুফিয়া কামাল। নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সুফিয়া কামালের প্রধান অবদান ছিল নারীর সার্বিক মুক্তির বিষয়টিকে একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক বাধ্যবাধকতার বিষয়ে পরিণত করা। এ সংগ্রাম স্লোগানসর্বস্ব ছিল না; কোনো একটি বিশেষ কারণে, বিশেষ সময়ে গড়ে ওঠা কর্মোদ্যোগও ছিল না। এটি ছিল একটি জাতীয় অবশ্যকর্তব্য। সেজন্য কোনো বিচ্ছিন্ন নারীবাদী চিন্তা অথবা রাজনৈতিক বিবেচনা এই সংগ্রামকে প্রভাবিত করতে পারেনি। সুফিয়া কামালের কাছে এই সংগ্রামের একটি সামূহিক রূপ ছিল। একটি চিরায়ত তাৎপর্য ছিল। যদি নারী শিক্ষিত, আÍসচেতন, অধিকার সচেতন এবং ঘরের বাইরে কর্মোদ্যমী না হন, তাহলে জাতি গঠনের কোনো পর্যায়ই সম্পূর্ণ হবে না। এ জন্য জাতি ও জাতির নানা আখ্যানের কেন্দ্রমূলে নারীর অধিকারের বিষয়টিকে তিনি স্থাপন করেছেন। এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশে যতটা সাফল্য এসেছে, তার পেছনে সুফিয়া কামালের অবদান ছিল একজন পথপ্রদর্শকের এবং নিরলস যোদ্ধার। জাগরণের যে মন্ত্রটি তিনি দিয়ে গেছেন তা নারীদের অনুপ্রাণিত করেছে। এতসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধতা সত্তে্ও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন, তা তার কিছু স্বচ্ছ দর্শন ও দিকনির্দেশনার কারণে।

৩. সুফিয়া কামালের সংগ্রামের একটি অবধারিত ক্ষেত্র ছিল সংস্কৃতি। সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালিরা ছিল ঊনজন; বাঙালির সংস্কৃতি ঊনসংস্কৃতি। পাকিস্তানিদের অবজ্ঞার পেছনে অবশ্য ছিল তাদের শঙ্কা এবং ভয়। তারা বাঙালি সংস্কৃতির শক্তি সম্পর্কে সজাগ ছিল। পাকিস্তানের এলিট শ্রেণি, জমিদার ও সিভিল-মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসি যে শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তা ছিল পশ্চাৎমুখী, রক্ষণশীল এবং চরমভাবে বিভাজিত। পাকিস্তান নামের যে অচলায়তন এদের ক্ষমতা ও বিত্ত অর্জনের জন্য আদর্শ ছিল, তা যে বাঙালি সংস্কৃতির স্পর্শে ভেঙে পড়বে এবং তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, এটি তারা সম্যকভাবে জানত। সেজন্য বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বারেবারে আঘাত হেনেছে। এর উদার বৈশিষ্ট্যগুলোও বিকাশে বাধা সৃষ্টি করেছে। সুফিয়া কামাল শুরুতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু বাঙালির সঙ্গে দেশটির শাসকদের উপনিবেশী আচরণ তাকে নিশ্চিত করল এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে। সংস্কৃতির লড়াইয়ে তিনি শামিল হলেন এবং ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পর্যন্ত তিনি প্রতিটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে ছিলেন সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা। সংস্কৃতির গভীর পাঠ পাকিস্তানিদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, পাকিস্তানের সংস্কৃতি তখনো এবং এখনো গণঅধিকার আদায়ের সংগ্রামে একটি চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালনে অক্ষম। এর কারণ এর ভিতরের রক্ষণশীলতা, শ্রেণি ও বিত্তগত বিভাজনের প্রভাব ও এর সর্বজনীন আবেদনের অভাব। ফলে পাকিস্তানি শাসকরা নির্দিষ্টভাবে বাংলাভাষা, রবীন্দ্রনাথ, ভাস্কর্য, নাটক এসব বিষয়ে কড়াকড়ি ও নিষেধের প্রাচীর তুলে বাঙালির সংস্কৃতিকে রুদ্ধ করতে চেয়েছিল। সুফিয়া কামাল সংস্কৃতির লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের কৌশলগুলো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। এ জন্য তিনি বাংলাভাষার শক্তি বৃদ্ধি, বাঙালি সংস্কৃতির ধর্ম, বর্ণ, জাতি-নিরপেক্ষ, উদারপন্থি এবং সর্বজনীন উপাদানগুলোর ব্যাপক চর্চা ও প্রসারে নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি জানতেন, যত এই শক্তিশালী সংস্কৃতির চর্চা, তত জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিশালী হওয়া। সুফিয়া কামাল এ জন্য সংস্কৃতিকে সব সময় সমাজতত্ত¡ ও জাতীয়তার বিবেচনায় দেখেছেন। বলেছেন, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশে বড় বাধা। রাষ্ট্রের বাধা সাময়িক; তা যত প্রবল হোক, এক সময় প্রতিরোধের মুখে তা গুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব হচ্ছে ভিতরের শত্র“, এই শত্র“কে শুরুতেই নিরস্ত্র করতে হয়। এটি কোনো অবাক হওয়ার কথা নয় যে, সুফিয়া কামাল সংস্কৃতির সংগ্রামের যত না সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিস্তারের কথা বলেছেন, তার থেকে অনেক বেশি বলেছেন শিক্ষা বিস্তারের কথা, গ্রামীণ উন্নতির কথা। প্রধান সমস্যাটা ওই জায়গায়, প্রধান বিরোধটাও ওই জায়গায়।

৪. সুফিয়া কামালের গণতন্ত্রের সংগ্রাম দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, যা ছিল বস্তুত মানুষের কল্যাণে তার নিবেদিতপ্রাণ সাধনার একটি প্রকাশ। এই সংগ্রামে তিনি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শকে সামনে নিয়ে আসেননি, এনেছেন গণমানুষের মুক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শটিকে। তার ঘটনাবহুল জীবনের দিকে তাকালে একটি বিষয় পরিষ্কার হবে যে কোনো সমস্যার প্রকৃত রূপ, সমস্যার প্রেক্ষাপট ও সমাধানের সম্ভাবনা সম্পর্কে তার স্বচ্ছ দৃষ্টি। মাত্র তিনটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। ষাটের দশকজুড়ে যে আইয়ুব তথা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল বাংলাদেশে, যার সবচেয়ে তীব্র প্রকাশ ঘটে ১৯৬৯ সালে এবং যার আঘাতে আইয়ুবের সিংহাসন উল্টে যায়, সে আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন সুফিয়া কামাল। সে সময় দেওয়া তার অনেক বক্তৃতা ও বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, এই আন্দোলনটি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য নয় অথবা শুধু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামও নয়; বরং এ সংগ্রাম গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য। শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ আন্দোলনের অভিঘাত হতো সীমিত। তা যেহেতু হয়নি এবং এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে, যার ভিত্তিও ছিল ওই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সুফিয়া কামালের অবস্থানটি তাতে প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় উদাহরণটি স্বাধীনতার পরপর সম্ভ্রমহারা নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গঠিত নারী পুনর্বাসন সংস্থার তার দায়িত্ব গ্রহণ। এই নারীদের রাষ্ট্র প্রকৃত তেমন সহায়তা দেয়নি। তাদের বীরাঙ্গনা বলে অভিহিত করে সামাজিক পুনর্বাসনের সম্ভাবনাটি তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু সুফিয়া কামাল জানতেন, আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় এসব অভিধার তেমন মূল্য নেই, এই নারীদের ওঠে দাঁড়াতে হবে এবং তা নিজের পায়ের ওপর। তিনি তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মনস্তাত্ত্বেক পুনর্বাসনের যেসব উদ্যোগ নেন, সেগুলো ছিল প্রকৃতই সময়োপযোগী। সরকারের নানা সীমাবদ্ধতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তার অনেকগুলো উদ্যোগ বাস্তবায়নের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার দিকনির্দেশনাগুলো ছিল সঠিক, ভবিষ্যৎমুখী এবং বাস্তবায়নযোগ্য।

তৃতীয় উদাহরণটি আশির দশকে শুরু হওয়া ঘাতক দালাল নির্মূল অভিযানের সঙ্গে তার সম্পৃক্তা। ঘাতক দালালদের গ্রেফতার ও বিচারের যে দাবি সে সময় উঠেছিল, তা খুব পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতেন সুফিয়া কামাল। বলতেন, এদের গ্রেফতার ও বিচার না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবে, একাত্তরের অর্জনকে আমরা ধরে রাখতে পারব না। তিনি জানতেন, অশুভের শক্তি অর্জন শুভের পক্ষে বিপদবার্তা। শুভ নির্ভর করে মানুষের বিবেক, সৌন্দর্যবোধ ও নীতিবোধের ওপর। অথচ অশুভের আছে সহিংসতার শক্তি। বাংলাদেশে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বে শুভের পক্ষে জনগণকে তিনি ডাক দিয়েছিলেন। যে দাবি তিনি ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তুলেছিল, তা এতদিন পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগে রূপ নিয়েছে। সুফিয়া কামাল জানতেন এবং সেই বিশ্বাস তার ছিল যে, এদেশের মানুষ অশুভকে পরাজিত করবে। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন জাগ্রত চেতনা। তার প্রয়োজনীয়তা তিনি নানা কাজে ও কথায় দেশবাসীকে বুঝিয়েছেন।

৫. এই জাগ্রত চেতনার একটি বড় প্রকাশ তার কবিতা এবং বলতে বাধা নেই, তার কবিতা ও তার সারাজীবনের সংগ্রামের একটি বিশেষ প্রকাশ। সুফিয়া কামাল গল্প, ভ্রমণকাহিনী, শিশুদের জন্য সাহিত্য লিখলেও তার প্রধান পরিচয় ছিল কবি হিসেবে। নয়টি কাব্যগ্রন্থে সাজানো তার কবিতার বিষয় প্রেম, প্রকৃতি ও সৌন্দর্য এবং একই সঙ্গে সমাজ ও মানুষ। শুরুতে তার কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির প্রাধান্য ছিল। কিন্তু শেষ দিকে অনেক কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের আর্তি ও তাদের মুক্তির প্রত্যয়। এ পরিবর্তনকে কোনো পালাবদল বলা যাবে না, যেহেতু শেষ দিকের কবিতাতেও প্রকৃতি আছে, স্বপ্নের বিষয় আছে। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন তার শেষ দিকের কবিতাকে করেছে সংগ্রামী। বলা যায় কবিতা ধারণ করেছে তার সংগ্রামী চিন্তাকে। তার একটি কবিতার নামে ‘একত্রিশে চৈত্র, ১৩৭৭’, যেখানে তিনি ‘বাংলার বুকে’ নানা ‘হত্যালীলার’ জন্য ক্রোধ প্রকাশ করেন এবং বলেন,

সন্তানের রক্তধারা বাংলা আর সবুজ অঞ্চলে

মুছাইতে পারেনাকো, বয়ে চলে নদী স্রোতধারে

নদী হতে সাগরে সাগরে।

সেই স্রোতধার

নিখিল মানবজনে দেয় উপহার।

এই কবিতার মূল চিন্তা প্রতিবাদের, প্রতিরোধের; হত্যাকারীর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা।

সুফিয়া কামালের সংগ্রাম শুধু বর্তমানকে নিয়ে নয়, ছিল ভবিষ্যৎকে নিয়েও। সেই ভবিষ্যৎ এখন আমাদের জন্য মূর্ত হচ্ছে, আগামীকাল এবং চিরকালও মূর্ত হতে থাকবে এবং মানুষের কল্যাণে সংগ্রাম করতে আমাদের শক্তি ও সাহস জুগিয়ে যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর