শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমার শিল্পী জীবন

আবদুস শাকুর শাহ্

আমার শিল্পী জীবন

একদিন পত্রিকায় দেখলাম ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের একক সানাইয়ের অনুষ্ঠান হবে বরদা রাজার বাড়িতে। টিকিট সংগ্রহ করলাম তার সানাই শোনার জন্য। রাজবাড়ীতে গেলাম। বিরাট বাড়ি। তিনটা গেট পার হয়ে প্রবেশ করলাম দরবার হলে। শত শত মানুষের সমাগম। অনেকে বালিশ নিয়ে মেঝেতে বসে আছে রাজকীয় ভঙ্গিতে সানাই বাদন শোনার জন্য। সানাইয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলো রাত ৯টায়। খাঁ সাহেব দৃপ্ত ভঙ্গি মঞ্চে এলেন এবং সবাইকে সালাম জানালেন। ঘোষক এক সুন্দরী নারী অনুষ্ঠান শুরু করার ঘোষণা দিলেন। এরপর অনুষ্ঠান শুরু হলো। খাঁ সাহেব বাদন শুরু করলেন। অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। রাত তখন ১২টা হবে, আমার মনে হলো সমগ্র দরবার হলের সবাই একটা স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করেছে। সবাই নিশ্চুপ কেউ কথা বলছে না। পুরো দরবার হলে শুধু সানাইয়ের মধুর সুর এদিক ওদিকে ঘুরে আসছে। ভারতবর্ষে এত বড় ওস্তাদের অনুষ্ঠান সরাসরি উপভোগ করা ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। সত্যি সানাইয়ের মতো একটি বাদ্যযন্ত্রকে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছেন। এটি এমনই একটি বাদ্যযন্ত্র যা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনা প্রকাশ করে। ভারতবর্ষে এখন তো যে কোনো বিয়েতে বিসমিল্লাহ খানের সানাই বাদন শোনা যায়। তিনি এক মহৎ শিল্পী, সাধক।

১৯৭৭ সালে দিল্লিতে দেখতে গেলাম ইমক্সেসনিস্ট শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। শিল্পীদের মধ্যে ভ্যানগস, সিজাম পিসারো, দেলাক্রোয়ে কিংবা যেসব শিল্পীর শিল্পকর্ম আজও আমি দেখিনি তাদের ছবি। এ প্রদর্শনী আয়োজন করেছিল দিল্লি মর্ডান আর্ট গ্যালারি। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ১৯৭৭ সালে আহমেদাবাদে গিয়েছিলাম ভারতের জাতীয় প্রদর্শনী দেখার জন্য। প্রদর্শনীতে অনেক নামকরা শিল্পীর কাজ ছিল। শিল্পকর্মের প্রদর্শনী শেষে সেখানকার একটি মিনার দেখতে গেলাম। স্থানীয় লোকজন এর নাম দিয়েছেন ঝুলন্ত মিনার। মিনারটার উপরে উঠে নাড়া দিলে পুরো মিনারাটা নড়তে থাকে। অনেকের বিশ্বাস এ মিনারটা যিনি বানিয়েছেন তিনি একজন দরবেশ ধরনের লোক ছিলেন। এ ধরনের মিনার আমি আগে দেখিনি।

১৯৭৭ সালে মুম্বাই আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনীতে আমি নিজেই অংশগ্রহণ করি। আমার শিল্পকর্মের বিষয় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ৭৮তম বোম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনীর যে ক্যাটালগ বের হয় তার কভারে আমার শিল্পকর্মের ছবি ছাপা হয়। এটা আমার মতো একজন তরুণ শিল্পীর জন্য ছিল বিরাট সম্মানের। ছবিটা পরে মুম্বাইয়ের একজন শিল্প সংগ্রাহক কিনেছিলেন। ওই প্রদর্শনীতে ভারতে অনেক নামকরা শিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমার শিল্পকর্ম নিয়ে বরদার শিল্পী ও ছাত্ররা চমৎকার মূল্যায়ন করেছিল। ওই প্রদর্শনী উপলক্ষে বেশ কয়েকবার আমি মুম্বাই গিয়েছিলাম। প্রথমবার যখন ছবি জমা দিতে মুম্বাই যাই তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল মুম্বাই রেলস্টেশনে। ভোরে স্টেশনের রেস্টুরেন্টে জলখাবারের জন্য বসেছি। বুঝতে পারিনি লোকটা একটা চিটার। সে আমার কাছ থেকে মিথ্যা কথা বলে ২০ রুপি নিয়ে আর ফিরে আসেনি।

মুম্বাইয়ে বেশিরভাগ হোটেলে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কাজ করে। ওই সময় আমি তাজবাংলা হোটেলে একটি প্রদর্শনী দেখতে গেলাম, তখন হোটেলের একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে এত মধ্যপ্রাচ্যের লোক কেন? এরা কি কাজে আসে। জানতে পারলাম এরা এখানে ফুর্তি করতে আসে। আমার এক বন্ধু মুম্বাই আর্ট সোসাইটি সচিব Hares Roult : কে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার আঁকা Drawing সম্বন্ধে, সে খুব প্রশংসা করেছিল এবং বলেছিল এই ড্রইংটার  নতুন একটা মাত্রা পেয়েছে। তার মতে শিল্পীর বয়স অনেক বেশি। পরে তিনি জানতে পারেন আমি বরদা এমএইচ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্রাজুয়েট লেভেলের ছাত্র এবং বাংলাদেশ থেকে এসেছি। মুম্বাই জাদুঘরে অনেক নামি শিল্পীর কাজ আছে। বিশেষ করে টারনারে কয়েকটা জলরংয়ের ছবি। সে সময় একদিন সত্যজিৎ রায়ের ‘জন-অরণ্যে’ সিনেমাটা দেখলাম। জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে শিল্পী সিন্ধীয়ার একটা প্রদর্শন চলছিল। প্রতি বছরের মতো এবারও বিভাগ থেকে শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়। আমরা বরদা থেকে রবতলাম গেলাম সেখানে সাচি বুদ্ধের স্তুপ দেখতে। এভাবে একই ট্রেনে ঝাসিতে পৌঁছিলাম। ঝাসির রানীর রাজবাড়ীটা দেখে পরে বাসযোগে খাজুরা হোতে এলাম। সেখানে একটা আশ্রমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। পরের দিন আমরা সেখানকার বিখ্যাত মন্দিরগুলো দেখতে বের হলাম।

প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি সন্দিরে আবার কি দেখার আছে। গাইড যখন মন্দিরগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করল তাতে বুঝলাম এগুলো শত শত বছর আগে দক্ষিণ ভারতীয় এক রাজা তৈরি করেছেন। আমি মন্দিরগুলো দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম ড্রইং করব। তাৎক্ষণিক মন্দিরের সামনে বসে ড্রয়িং শুরু করলাম। আমি ড্রইংগুলো যখন করছিলাম তখন বিশেষ বিশেষ বিষয় আঁকছিলাম। এই মন্দিরগুলোর গায়ে স্থান পেয়েছে দেব-দেবী বা সাধারণ মানুষ, কামসূত্রের বিভিন্ন বিষয়। এছাড়া জীবজন্তু আর পাখি। সেখানকার স্থানীয় লোকদের থেকে জানা যায় রাজা যখন এই মন্দিরগুলো তৈরি করেন তখন এমন সব বিষয় মন্দিরের গায়ে রিলিফ করে যা গ্রামের সাধারণ মানুষ দেখে জৈবিক অনুভূতি ভুলে যায়। পরে শুদ্ধ মনে মন্দিরে প্রার্থনা করতে পারে। এখানে সর্বমোট ৮০টি মন্দির ছিল। রিলিফগুলোর মূল বিষয় ছিল পুরুষ মানুষের লিঙ্গ বড় আর মেয়েদের স্তন বড় দেখানো যা রাজার নির্দেশে শিল্পীদের করতে হয়েছে। বেশিরভাগ রিলিফে শৃঙ্গার দৃশ্য বেশি দেখানো হয়েছে। যেমনরাজা একাধিক নারীর সঙ্গে শৃঙ্গারে লিপ্ত আর অন্য নারীরা পাশে দাঁড়ানো। অনেক সময় রাজা যুদ্ধে জয় করলে সৈন্যদের স্বাধীনতা দেওয়া হতো। ফলে সৈন্যরা বিভিন্ন রকম শৃঙ্গারে লিপ্ত হতো। যেমন ঘোড়ার সঙ্গে। খাজুরা হো থেকে ফেরার পথে আমরা আগ্রায় গেলাম তাজমহল দেখতে। এই প্রথম আমার তাজমহল দেখা, ছোটবেলায় জানতাম পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা তাজমহল। সত্যিই এর ডিজাইন এবং নির্মাণ কৌশল দেখার মতো। তাজমহলটাকে চারদিক থেকে দেখলে একই রকম মনে হয়। সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি ভারতের প্রথম ‘স্মৃতিসৌধ’। অতঃপর আগ্রা ফোর্ট দেখার পর গেলাম মথুরাতে। শ্রীকৃষ্ণের জম্নস্থান। একটা মন্দিরে হিন্দু বয়স্ক লোকজন শ্রীকৃষ্ণের নামে কীর্ত্তন গাইছে। তাদের ভক্তিগীতি শুনে মন ভরে যায়। এরপর গিয়েছিলাম রাধা ও কৃষ্ণ লীলাস্থান দেখতে। তাদের লীলাস্থানে একটি দীর্ঘকায় বৃক্ষ ছিল, গাছটা এখনো আছে। সেখানে প্রতিদিন বানর ও ময়ূর দেখা যায়।

দক্ষিণ ভারতীয়দের তৈরি করা একটা মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করার সময় যথারীতি জুতা খুলতে হলো। সেখানে মাঝখানে একটা তালগাছ ছিল যা স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। মন্দিরের সেবায়েতদের কথায় জানা গেল এই তাল গাছ ৮ মণ স্বর্ণ দিয়ে বানানো হয়েছে। এক সময় ঠিক করলাম অজন্তা ইলোরা দেখতে যাব। আমি আর মমিনুল রেখা বের হলাম অজন্তা দেখতে। প্রথমে জলগাঁও গেলাম, সেখান থেকে বাসে করে গেলাম অজন্তাতে। সকালে নাস্তা করে দেখতে বের হলাম। প্রথমে যে গুহাটা দেখলাম তাতে বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের কিছু ছবি। একটা গুহাতে দেখলাম পদ্ম হাতে ধ্যানি বুদ্ধ। এ ছবিটার বৈশিষ্ট্য হলো যেদিক থেকে দেখা যাক না বুদ্ধ সেদিকে তাকিয়ে আছে।

একটার পর একটা গুহা দেখার পর মনে হলো এগুলো মানুষের দ্বারা তৈরি নয়। মনে হয় গুহাগুলো ঐশ্বরিকভাবে হয়েছে। এত বড় বড় গুহা কিভাবে শিল্পীরা তৈরি করল! মহৎপ্রাণ গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ও জ্ঞান সাধনারে ঐকতান আজও কানে বাজে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর