শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা

যতীন সরকার

উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

গাঁয়ের একজন সরল মানুষ রেলস্টেশনে এসে স্টেশন মাস্টারের কাছে জানতে চাইল টেলিগ্রাফের তারের সাহায্যে কারও কাছে কোনো দ্রব্যসামগ্রী পাঠানো যায় কি-না। কারণ সে শুনতে পেয়েছে যে তারের ভিতর দিয়ে খবর পাঠানো যায়; তাই যদি হয়, তবে খবরের সঙ্গে অন্য কিছুও পাঠানো যাবে বলে তার মনে হয়েছে। লোকটির ছেলে থাকে দূরে কোনো এক গাঁয়ে; ছেলেটি দৈ খেতে খুব পছন্দ করে, তাই ছেলের কাছে এক হাঁড়ি দৈ পাঠানোর তার খুব ইচ্ছে। স্টেশন মাস্টার মশাই যদি দয়া করে টেলিগ্রাফের তারের মধ্য দিয়ে সেটি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন তো খুবই ভালো হয়।

স্টেশন মাস্টার তো আর গাঁয়ের চাষিটির মতো নিতান্ত সরল মানুষ নন। তিনি শিক্ষিত; তাই স্বাভাবিক নিয়মেই একান্ত চতুর ও কুটিল। শিক্ষা আমাদের দেশের মানুষকে কতখানি উন্নত করতে পেরেছে, সে বিচার পরে করা যাবে। তবে শিক্ষা যে আমাদের বেশ চালাক-চতুর বানিয়েছে, সে কথা তো আমাদের সবারই জানা। তাই অন্য সব শিক্ষিত মানুষের মতোই আমাদের এই স্টেশন মাস্টারটিও তার শিক্ষালব্ধ চতুরতা দিয়েই অশিক্ষিত লোকটির অজ্ঞাতজনিত সারল্যটুকু ধরে ফেললেন। পরম আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ‘অবশ্যই, অবশ্যই। তুমি এক্ষুনি দৈয়ের হাঁড়ি নিয়ে এসো, টেলিগ্রাফের তারের ওপর দিয়ে সেটি আমি পাঠিয়ে দেব, আর এক মিনিটের মধ্যে তোমার ছেলের কাছে তা পৌঁছে যাবে।’

লোকটি দৈয়ের হাঁড়ি এনে স্টেশন মাস্টারের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে গেল, আর স্টেশন মাস্টার মশাই তার ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেই চিনিপাতা দৈয়ের সদ্ব্যবহার করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। বেশ কিছুদিন পরে ওই লোকটি যখন কোনো এক সূত্রে খবর পেল যে, দৈয়ের হাঁড়িটি তার ছেলের কাছে পৌঁছায়নি, তখন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে স্টেশন মাস্টার মশাইয়ের কাছে তার কারণ জানতে এলো। স্টেশন মাস্টার মুখে একটা কৃত্রিম বেদনার ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘আহা, সে দুঃখের কথা আর বল না। টেলিগ্রাফের যে তারটির ওপর দিয়ে তোমার দৈয়ের হাঁড়িটি যাচ্ছিল, সেই তারের ওপর দিয়ে উল্টো দিক থেকে আসছিল একটা বেল। সেই বেলটি আমাদের পোস্ট মাস্টার মশাইয়ের ছেলে বিদেশ থেকে তার বাবার কাছে পাঠিয়েছিল। বেলের সঙ্গে টক্কর লেগে তোমার দৈয়ের হাঁড়িটা গেল ভেঙে। তাই, বুঝতেই তো পারছ...’

হ্যাঁ, অশিক্ষিত লোকদের শিক্ষিত লোকেরা যে-রকম বোঝাতে চায় তারা সে রকমই বোঝে। পুত্র স্নেহাতুর প্রতারিত পিতাও সেই রকমই বুঝে নিয়েছিল নিশ্চয়। শিক্ষিত লোকদের হাতে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয়েও অশিক্ষিত লোকেরা প্রতারক শিক্ষিতদেরই স্বার্থ রক্ষা করতে বাধ্য হয়।

গল্পের ওই স্টেশন মাস্টারটি শুধু কাল্পনিক গল্পে নয়, আমাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তবেও এখনো যথারীতি আসর জাঁকিয়ে বসে আছে। এখন বরং এরা বেড়ে এবং বহু প্রকার ও বহু বিচিত্র রূপ ধারণ করে, সমাজে প্রবল প্রতাপে বিচরণ করছে। স্টেশন মাস্টার পোস্ট মাস্টার থেকে স্কুল মাস্টার কলেজ মাস্টার হয়ে অনেক অনেক ধরনের শিক্ষিত লোক পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। স্কুল মাস্টার কলেজ মাস্টাররাই এদের শিক্ষিত বানায়, আর এরা উকিল, ডাক্তার, কন্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার, ফড়িয়া, দালাল, পুলিশ, কেরানি, মুহুরিসহ নানা জাতের সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী ইত্যাদি হয়ে সমাজের শীর্ষ দেশে অবস্থান নেয়। সংখ্যায় লঘু হয়েও গুরুত্বে এরাই অনেক উপরে, সমাজের সংখ্যাগুরু মানুষের এরা গুরু বা মাস্টার এবং সংখ্যাগুরু মানুষদের প্রতি গল্পের সেই স্টেশন মাস্টারটির মতো এদের অধিকাংশের আচরণ।

আমরা যখন বিভিন্ন সময়ে ‘উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা’ নিয়ে বাক বিস্তার করতে বসি, তখন সবার আগে আমাদের (অর্থাৎ আমরা যারা শিক্ষিত বলে গৌরব করি) আত্মসমালোচনা করে নেওয়া প্রয়োজন। আমরা যারা শিক্ষিত বলে পরিচিত, তাদের নিজেদের চরিত্রের স্বরূপ নিয়ে আলাপ-আলোচনা তথা আত্মসমালোচনা জরুরি এ কারণে যে, আমাদের দেখে নেওয়া দরকার; শিক্ষা সত্যি সত্যিই আমাদের জীবনকে উন্নত করতে পেরেছে কি-না। যদি তা না করে থাকে তো ‘উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা’ নিয়ে কিছু বলার আগে দশবার আমাদের ভাবতে হবে বৈকি। কিছুতেই ভুলে থাকতে পারি না যে, শিক্ষিত মানুষেরাই সমাজে উন্নত মানুষ বা শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে গৃহীত এবং অন্য সব মানুষের কাছে এরাই অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে প্রাচীন ভারতের গীতার বাণী- যদ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ। স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যা যা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তা-ই করে। তিনি যা কর্তব্য বলে গ্রহণ করেন, সাধারণ লোকে তারই অনুবর্তন করে।

এখন আমাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করতে হয়। আমরা শিক্ষিত লোকেরা কি সেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পেরেছি যার অনুবর্তন করে অপর সাধারণেরাও শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে? কিংবা আমরা কি এক ধরনের মেকি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েই সবাইকে বিভ্রান্ত করে চলেছি এবং আমাদের অনুবর্তন করতে করতেই সমাজজীবনে উন্নতির বদলে ক্রমাগত অবনতির অন্ধক‚পে নিমজ্জমান হচ্ছে? এমন যদি হয়েই থাকে, তাহলে দোষটা কার- আমাদের, না আমাদের শিক্ষার? না, উভয়েরই? দোষ থেকে মুক্তি লাভের কি কোনো উপায় আছে আমাদের সামনে?

দুই.

আত্মসমালোচনার নামে এ দেশের শিক্ষিত মানুষদের কেবল যে আত্মধিক্কারে জর্জরিত হতে হবে, তা অবশ্যই নয়। আত্মগৌরবে উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতোও অনেক কিছুই আছে আমাদের। উনিশ শতক থেকে শুরু করে দ্বিতীয় সহস্রাব্দ পেরিয়ে আসা অবধি আমাদের শিক্ষিত মানুষদের অনেকেই নিজেরা যেমন উন্নত জীবনের দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তেমনি শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে সমাজজীবনকেও উন্নত স্তরে তোলার প্রযত্ন গ্রহণ করেছেন। ওইসব মনীষীর প্রযত্নের ফলেই আমরা আত্মসচেতন হয়েছি। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আমাদেরও শ্রেষ্ঠত্ব লাভের অনুপ্রাণিত করেছেন, তাদের চিন্তা ও কর্মের অনুসরণেই আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি, পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে স্বাধীন আবাসভ‚মি গড়ে তুলেছি এবং রক্তের মূল্যে অর্জিত যে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রের সংবিধানে শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্বে বিধিবদ্ধ করেছি। অন্ন-বস্ত্র-স্বাস্থ্য আবাসের মতোই শিক্ষা লাভের অধিকারকেও প্রতিটি নাগরিকের একান্ত মৌলিক অধিকার বলে আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা যাতে কোনোমতেই সমাজে কোনো সুবিধাভোগী শ্রেণি সৃষ্টি করতে না পারে, সবার জন্য একই পদ্ধতির উন্নত শিক্ষা প্রাপ্তির যাতে নিশ্চয়তা থাকে, সেদিকটিতেও আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তির জীবন যাতে উন্নত হয়; এবং ব্যক্তিসমূহের সমবায়ে গঠিত যে-সমাজ, উন্নত হয় সেই সমাজ-জীবনও,- তেমন শিক্ষাই কাম্য বলে আমাদের সংবিধানে নির্ধারিত হয়েছিল। সংবিধান-নির্ধারিত সেই মূলনীতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উপায় সন্ধানের জন্য গঠিত শিক্ষা কমিশন (কুদরত-ই-খুদা কমিশন’ নামে যা খ্যাত)-এর প্রতিবেদনে উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষার রূপরেখাই অভিব্যক্তি পেয়েছিল। ওই প্রতিবেদন জনমনে বিপুল প্রত্যাশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু অচিরেই একান্ত প্রত্যাশা জাগানিয়া ওই প্রতিবেদনটির কী পরিণতি ঘটল, তা তো আমরা সবাই জানি। শুধু ওই একটি বিশেষ প্রতিবেদনের কথাই-বা বলি কেন? আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রায় সব অর্জনই কীভাবে লুণ্ঠিত ও অপহৃত হলো, তাও কি আমাদের জানা নেই? মুক্তি সংগ্রামের অর্জন শুধু নয়, তার আকাক্সক্ষাগুলো পর্যন্ত বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত ও বিলীন হয়ে যেতে লাগল ক্রমাগত। শ্রেণিহীন-শোষণহীন সমাজের মহৎ স্বপ্নকল্পনাটিই যেন নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

তার বদলে ব্যক্তিক স্বার্থপরতা, শোষণ-সহায়ক শ্রেণি বিকাশ, প্রগতি-বিরোধী ভাবাদর্শ-এ সবেরই চাষবাস হতে লাগল। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষণ-প্রণালিতেও পড়ল এ-সবেরই স্পষ্ট প্রতিফলন। সেই প্রতিফলনই দেখতে পাই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হরেক রকম বিন্যাসের মধ্যে। একদিকে আলিশান ইমারতে চোখ-ধাঁধানো জাঁকালো সব উপকরণের মধ্যে অর্থবান, ভাগ্যবান মানুষদের সন্তানদের জন্য অভিজাত শিক্ষা প্রদানের সাড়ম্বর আয়োজন, অন্যদিকে জীর্ণ-শীর্ণ দীন কুটিরে একান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপকরণের অভাবকেই সঙ্গী করে নিয়ে অর্থ-সম্পদ বঞ্চিত ভাগ্যহীনদের ছেলেপুলেদের অতি সাধারণ শিক্ষালাভের করুণ প্রয়াস। শিক্ষায় আশরাফ-আতরাফ বিভেদ আজ বড় বেশি বিশ্রী হয়ে উঠেছে। শিক্ষা ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত হলে এ-রকমটি তো হবেই। যার অর্থের শক্তি আছে, শিক্ষা রূপ পণ্যও হবে তারই অধিগত; অর্থ ক্ষমতার তারতম্য অনুসারেই শিক্ষা-পণ্যের মানেরও তারতম্য হবে নির্ধারিত। এভাবেই শিক্ষা কিনে নেওয়ার প্রচুর ক্ষমতা যাদের আছে, সেই বিত্তবান ও উচ্চবিত্তরাই যাবে অভিজাত শিক্ষা-বিপণিতে, - অর্থাৎ কিনে আনবে কিন্ডারগার্টেনের, এ-লেভেল ও-লেভেলের, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষা।      [ চলবে ]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর