শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা
উইলিয়াম শেকসপিয়র

প্রয়াণের চারশ বছর

সুলতানা জামান

প্রয়াণের চারশ বছর

বিশ্বখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়র (ব্যাপ্টিজম ২৬ এপ্রিল, ১৫৬৪—মৃত্যু ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬) এ বছর মৃত্যুর চারশ বছর অতিক্রম করছেন। ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেকসপিয়র চার শতাব্দিব্যাপী সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন। তার নাটক বিশ্বসাহিত্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তাকে ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি এবং বার্ড অব অ্যাভন (অ্যাভনের চারণকবি) নামেও অভিহিত করা হয়। শেকসপিয়রের যে রচনাগুলো পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে ৩৮টি নাটক, ১৫৪টি সনেট, দুটি দীর্ঘ আখ্যানকাব্য ও কিছু কবিতা। কয়েকটি লেখা শেকসপিয়র অন্য লেখকদের সঙ্গে যৌথভাবেও লিখেছিলেন। তার নাটক প্রতিটি বিশ্বের প্রধান সব ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বসেরা যে কোনো নাট্যকারের রচনার তুলনায় শেকসপিয়রের নাটক অধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। উইলিয়াম শেকসপিয়রের পিতা জন শেকসপিয়র ছিলেন একজন সফল গ্লোভার ও অল্ড্যারম্যান। তার আদি নিবাস ছিল স্নিটারফিল্ডে। তার মা মেরি আরডেন ছিলেন এক ধনী ভূম্যধিকারী কৃষক পরিবারের সন্তান। তার জন্ম ইংল্যান্ডের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনে। ১৫৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল তার ব্যাপ্টিজম সম্পন্ন হয়। তার জন্মের সঠিক তারিখটি জানা যায় না। তবে ২৩ এপ্রিল অর্থাৎ, সেন্ট জর্জ’স ডে-এর দিনে তার জন্মদিন পালন করার প্রথা রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক গবেষক ভুল করে এই তারিখটিকে শেকসপিয়রের জন্মদিন বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরে তারিখটি জীবনীকারদের কাছে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে। কারণ, শেকসপিয়র মারা গিয়েছিলেন ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল।

তিনি তার পিতা-মাতার আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। সে যুগের কোনো লিখিত প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, অধিকাংশ জীবনীকার মোটামুটি একমত যে, শেকসপিয়র সম্ভবত স্ট্র্যাটফোর্ডের কিং’স নিউ স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৫৫৩ সালে এই মুক্ত বিদ্যালয়ের সনদ পায়। স্কুলটি শেকসপিয়রের বাড়ি থেকে পৌনে এক মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। তিনি বেশ সংগ্রাম করেই লেখাপড়া করেছিলেন বলে তার জীবনীকারদের দাবি। এলিজাবেথীয় যুগে গ্রামার স্কুলগুলোর মান সর্বত্র সমান ছিল না। তবে স্কুলগুলোর পাঠ্যক্রম সারা ইংল্যান্ডেই আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করা ছিল। এ কারণে মনে করা হয়, স্কুলে লাতিন ব্যাকরণ ও ধ্রুপদি সাহিত্যের বিস্তারিত পাঠ দেওয়া হতো। ১৮ বছর বয়সে শেকসপিয়র ২৬ বছর বয়সী অ্যানি হ্যাথাওয়কে বিয়ে করেন। তারা বিয়ের ছয় মাস পরে অ্যানি সুজানা নামে একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন। তাদের বিয়ের দুই বছর বাদে শেকসপিয়র দম্পতির হ্যামনেট নামে এক পুত্র ও জুডিথ নামে এক কন্যা জন্মায়। এরা ছিল যমজ। ১৫৮৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এদের ব্যাপ্টিজম হয়। হ্যামনেটের মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ১১ বছর বয়সে। তার মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। ১৫৯৬ সালের ১১ অগস্ট তাকে সমাধিস্থ করা হয়। যমজ সন্তানের জন্মের পর শেকসপিয়রের পরবর্তী ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫৯২ সালে লন্ডনের একটি মঞ্চদৃশ্যের বর্ণনায়। ১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ পর্যন্ত বছরগুলোকে বিশেষজ্ঞরা তাই শেকসপিয়রের জীবনের হারানো বছর বলে উল্লেখ করে থাকেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচলিত আর একটি গল্প হলো, শেকসপিয়র লন্ডনের থিয়েটার পৃষ্ঠপোষকদের ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে নাট্যশালায় কাজ করতে শুরু করেন।

উইলিয়াম শেকসপিয়র ১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ সালের মধ্যবর্তী সময় অভিনেতা ও নাট্যকার হিসেবে লন্ডনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লর্ড চেম্ব্বারলেইন’স ম্যান নামে একটি নাট্যকোম্পানির তিনি ছিলেন সহ-স্বত্বাধিকারী। এই কোম্পানিটিই পরবর্তীকালে কিং’স মেন নামে পরিচিত হয়। শেকসপিয়রের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নথিভুক্ত তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না। তার পরিচিত রচনাগুলোর অধিকাংশই মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৫৮৯ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তার প্রথম দিকের রচনাগুলো ছিল মূলত মিলনাত্মক ও ঐতিহাসিক নাটক। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তার দক্ষতায় এই দুটি ধারা শিল্পসৌকর্য ও আভিজাত্যের মধ্যগগনে উঠেছিল। এরপর ১৬০৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানত কয়েকটি বিয়োগান্ত নাটক রচনা করেন। এই ধারায় রচিত তার হ্যামলেট, কিং লিয়ার ও ম্যাকবেথ ইংরেজি ভাষার কয়েকটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। জীবনের শেষ পর্বে তিনি ট্র্যাজিক কমেডি রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই রচনাগুলো রোম্যান্স নামেও পরিচিত। এই সময় অন্য নাট্যকারদের সঙ্গে যৌথভাবেও কয়েকটি নাটকে কাজ করেন তিনি।

তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত নাটকগুলোর প্রকাশনার মান ও প্রামাণ্যতা সর্বত্র সমান ছিল না। ১৬২৩ সালে তার দুই প্রাক্তন নাট্যসহকর্মী দুটি নাটক বাদে শেকসপিয়রের সমগ্র নাট্যসাহিত্যের রচনাবলি প্রকাশ করেন। তার সমকালে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ সম্মানিত কবি ও নাট্যকার। কিন্তু মৃত্যুর পর তার খ্যাতি হ্রাস পেয়েছিল। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শেকসপিয়র সারা পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করেন এবং খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন। রোম্যান্টিকরা তার রচনার গুণগ্রাহী ছিলেন। ভিক্টোরিয়ানরা রীতিমতো তাকে পূজা করতেন; জর্জ বার্নার্ড শ’র ভাষায় যা ছিল চারণপূজা (bardolatry)। মূলত বিশ্ব নাট্যসাহিত্য ও নাট্য রচনায় শেকসপিয়র নতুনতর প্রেক্ষিত রচনা করেন। তার রচনার নিজস্ব কৌশল, আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্য নতুনতর প্রেক্ষিত যোজন করে। তিনি নাটক রচনায় নতুন এক জেনর আবিষ্কার করেন। যে রীতি কয়েক শতাব্দীব্যাপী পৃথিবীর অন্য নাট্যকাররাও অনুসরণ করে আসছেন। বিংশ শতাব্দীতেও গবেষণা ও নাট্য উপস্থাপনার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার রচনাকে পুনরাবিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়। আজও তার নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুচর্চিত। সারা বিশ্বের নানা স্থানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা আঙ্গিকে এই নাটকগুলোর মঞ্চস্থ ও ব্যাখ্যা হয়ে থাকে।

১৬২৩ সালে ফার্স্ট ফোলিওতে প্রকাশিত শেকসপিয়রের ৩৬টি নাটককে এক ফোলিওতে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো— মিলনাত্মক (কমেডি), ঐতিহাসিক (হিস্ট্রি) ও বিয়োগান্ত (ট্রাজেডি)। যে দুটি নাটক ফোলিওর অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেগুলো হলো দ্য টু নোবল কিনসমেন ও পেরিক্লিস, প্রিন্স অব টায়ার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দুই নাটকের অধিকাংশটাই শেকসপিয়রের রচনা। সে হিসেবে এই দুটি নাটককেও তার নাট্যসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে।  তবে তার কবিতার কোনো সংকলন প্রকাশিত হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এডওয়ার্ড ডওডেন শেকসপিয়রের শেষ জীবনের চারটি কমেডিকে রোম্যান্স নামে চিহ্নিত করেন। তার মিলনাত্মক নাটক যথাক্রমে অল’স ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, দ্য কমেডি অব এররস, লভ’স লেবার’স লস্ট, মেজার ফর মেজার, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর, আ মিডসামার নাইটস ড্রিম, মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং, পেরিক্লিস, প্রিন্স অব টায়ার, দ্য টেমিং অব দ্য শ্রিউ, দ্য টেমপেস্ট, টুয়েলফথ নাইট, দ্য টু জেন্টলমেন অব ভেরোনা, দ্য টু নোবল কিনসমেন ও দ্য উইন্টার’স টেল। ঐতিহাসিক নাটক— কিং জন, রিচার্ড দ্য সেকেন্ড, হেনরি দ্য ফোর্থ, প্রথম পর্ব, হেনরি দ্য ফোর্থ, দ্বিতীয় পর্ব, হেনরি দ্য ফিফথ, হেনরি দ্য সিক্সথ, প্রথম পর্ব, হেনরি দ্য সিক্সথ, দ্বিতীয় পর্ব, হেনরি দ্য সিক্সথ, তৃতীয় পর্ব, রিচার্ড দ্য থার্ড ও হেনরি দি এইটথ। বিয়োগান্ত নাটক— রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, কোরিওলেনাস, টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস, টিমন অথ অ্যাথেন্স, জুলিয়াস সিজার, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, ট্রলিয়াস অ্যান্ড ক্রেসিডা, কিং লিয়ার, ওথেলো, অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা ও সিম্বেলাইন। কবিতা— শেকসপিয়রের সনেট, ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস, দ্য রেপ অব লুক্রেসি, দ্য প্যাশনেট পিলগ্রিম, দ্য ফিনিক্স অ্যান্ড দ্য টার্টল, আ লাভার’স কমপ্লেইন্ট। হারিয়ে যাওয়া নাটক— লভ’স লেবার’স উইন ও কার্ডেনিও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর