‘কান টানলেই মাথা আসে’— সেই টান উপেক্ষা করতে পারলাম না। ওই আপ্তবাক্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আর কিছুটা পরীক্ষামূলকভাবেই শুরু হলো আমাদের যাত্রা। এবারের ৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের পানে। ১১ থেকে ২২ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া চলচ্চিত্র বিশ্বের দরবারে সর্বাধিক সম্মানিত এবং ইউরোপ আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বে সর্বোচ্চ সমাদৃত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এই ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। কান শহরের সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্টটি নিস-এ। কানে পৌঁছতে হলে এই নিস এয়ারপোর্টে নেমে তারপর গাড়িযোগে আরও আধঘণ্টার মতো যেতে হয়। একটা শ্বেতশুভ্র ট্যাক্সিক্যাব ডেকে আমরা সবাই চড়ে বসলাম তাতে। ভারি চমৎকার রাস্তাটি। বসন্তকাল। দুই পাশে পাহাড়ের গায়ে গায়ে তৈরি ফুলে ফুলে সজ্জিত সারি সারি বিলাসবহুল ফুলেল ভিলা— ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের। সেগুলো পাশে রেখে সমুদ্রের কিনার ধরে একটি গর্বিত রাজহাঁসের মতোই এগিয়ে চলল আমাদের ট্যাক্সিবাহন। ‘আমরা যখন কানে পৌঁছলুম, তখন দুপুর। চতুর্দিকে চিক চিক করছে রোদ্দুর।’
সত্যি! রোদ চকচকে দুপুরে পৌঁছলুম প্রিয় কবিতার পঙিক্তর মতোই সুন্দর শহর ‘কান’-এ। ইংরেজিতে ‘ঈধহহবং’। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে যেন রোদ পোহাচ্ছিল উৎসবমুখর এই শহরটি। পুরো পৃথিবীর সিনেমাপ্রেমী অসংখ্য মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’-এ যোগদানের জন্য। তবে তাদের প্রতীক্ষা যে শুধু বিশ্বখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী দর্শনের জন্য কিংবা শুধুই ভালো ভালো চলচ্চিত্র উপভোগ করার জন্য তাই-ই নয়, মায়াকাড়া এই শহরটির লাবণ্যের টানও নেহাত কম শক্তিশালী নয়। উৎসবের সময়টিতে কানের বিভিন্ন পঞ্চতারকাখচিত আয়েশি-বিলাসী হোটেলগুলোতে থাকেন পৃথিবীখ্যাত যশস্বী ফিল্মস্টাররা— আর তাদের দেখতে সারা বিশ্ব থেকে ছুটে যান তাদের ভক্তকুল।
আগেই বলেছি কানের মায়া কাটানো কঠিন। আর সেই মায়ার ঘোর থেকে বাদ পড়েননি সেলিব্রেটিরাও। বিশেষ বিশেষ সেলিব্রেটির বিশেষ বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে কান শহরের বিশেষ বিশেষ হোটেল এবং রেস্টুরেন্টের প্রতি। যেমন— ‘ডু’ক্যাপ ইডেন রক’ হোটেলটিতে থাকতে পছন্দ করেন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এবং টম ক্রুজ। হোটেল ‘ম্যাজিসটিক ব্রারিয়ার’-এ বিভিন্ন সময় এসে থেকে গেছেন রবার্ট ডি নিরো। সিনেমাপাগল ফরাসিদের প্রাণের উৎসব এই কান উৎসব এখন সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রের সবচেয়ে প্রেসটিজিয়াস আলোচ্য ইভেন্ট। উল্লেখ্য, ‘সিনেমা’ শব্দটিও ফরাসি।কানের আসল জনসংখ্যা মাত্র সত্তর হাজার। উৎসবের সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ দশ হাজারের কাছাকাছি; মানে, এক্কেবারে তিনগুণ। তার ওপর এবার বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ফ্রান্সের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটিও ছিল দেখার মতো। কী সংখ্যায়, কী চরিত্রে। তবে এত নিরাপত্তার ভিতরও স্বতঃস্ফূর্ততার কিন্তু অভাব নেই কোনো। চারদিকে ঝাঁ-চকচকে সাজপোশাকে সজ্জিত হয়ে হাজারও উৎসাহী যুবনারী ও পুরুষ রেডিয়্যান্ট হীরার টুকরোর মতো সাজিয়ে দিয়েছে পুরো শহরটা।
এখানে একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদানের জন্য এক্রিডিয়েশনের প্রয়োজন হয়, যা সিলেকশনের ভিত্তিতে শুধু চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদের জন্য এক্রিডিয়েশন জোগাড় করা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। এক্রিডিয়েশনের বাইরে জনসাধারণের জন্য কিছু কিছু আকর্ষণীয় অংশ রয়েছে এই ফেস্টিভ্যালে। যেখানে টিকিট কিনে Critics’ Week and Directors’ Fortnight Section-এ নতুন নতুন ছবি দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। তবে তাতে করে মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাত্রা হয় সীমিত। বিভিন্ন সিনেমার প্রদর্শনী দেখতে আলাদা করে প্রয়োজন পড়ে আমন্ত্রণপত্রের। উৎসবস্থলের বাইরে অনেক যুবক-যুবতীকে দেখা যায় টিকিট চেয়ে প্লাকার্ড হাতে চাতক নয়নে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কাঙ্ক্ষিত ছবিটি দেখার আশায়।
অস্কার বিজয়ের আগে ১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের জন্য কান পুরস্কারে ভূষিত হন। এই পথিকৃৎ চলচ্চিত্রটি কান-এর সর্বোচ্চ সম্মানিত পুরস্কার ‘পাম ডি’ওর’-এ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নমিনেশন পায়, যদিও সে বছর পুরস্কারটি জিতে নিয়েছিল ফ্রান্সে নির্মিত `The Silent World’ নামক একটি ফিল্ম। আর এরপরে কান উৎসবে বাঙালি হিসেবে সবচেয়ে দৃঢ় পদচারণা বোধ করি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের। ২০০২-এ বাংলাদেশের সেই প্রখ্যাত চলচ্চিত্র— তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’। কানাডা থেকে কান উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিল ভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ ছবির প্রতিযোগিতা সেকশনে। সাল ১৯৬০-এ জমা দেওয়া ‘জাগো হুয়া সভেরা’ (ডে শ্যাল ডন) ছবিটি এ বছর কান উৎসবে সিলেক্টেড ক্লাসিক ছবি হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে। চলচ্চিত্রকার এ. জে. কাদের পরিচালিত এবং তৎকালীন পাকিস্তানের ওপর নির্মিত এ ছবিটির সঙ্গে প্রয়াত খান আতাউর রহমান যুক্ত ছিলেন।
এ বছর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বিএফডিসি)-এর ওপর একটি ফিচারও প্রকাশিত হয়েছে কান উৎসবের অফিশিয়াল প্রকাশনায়। এতে একজন তরুণ ফটোগ্রাফার ও প্রতিবেদক সরকার প্রতীক-এর চোখে বাংলাদেশের এফডিসির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। লেখাটিতে বলা হয়েছে এফডিসির নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে টাকার অভাবে অনেক সময় টেকনিশিয়ানরাই এক্সট্রা বা বিভিন্ন চরিত্রে (সাপোর্টিং রোলে) অভিনয় করে থাকেন। তাছাড়া প্রায়শ দেখা যায় মাসের পর মাস বহু প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। টাকার জোগাড় হলে তবেই সে ছবিগুলো পূর্ণাঙ্গ হওয়ার মুখ দেখে। এফডিসিতে নির্মিত অধিকাংশ সিনেমায় রঙের ব্যবহার তীব্র এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পটভূমি, সাজসজ্জা ও প্রপ্সগুলো বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ যেমন— অসঙ্গতিপূর্ণ সিনেমার প্রতিটি চরিত্রের আবেগের প্রকাশ ভঙ্গিমা আর মাত্রাবিহীন অতি-অভিনয়। তার ওপর রয়েছে বলিউডের সরাসরি প্রভাব— যা এসব সিনেমায় প্রবলভাবে প্রকট। এফডিসির ওপর এই ফিচার করতে গিয়ে প্রতিবেদকের অনুধাবন হচ্ছে এ ধরনের অধিকাংশ চলচ্চিত্রে দারিদ্র্যের চিত্রায়ণ ভয়ানক রকমের উজ্জ্বল এবং চটকদার— যদিও দারিদ্র্যরেখার নিচে যাপিত জীবন আদতে বর্ণহীন। এমনকি প্রাচুর্যে থাকা মানুষের জীবনও আদতে প্যাস্টেল রঙে ঘেরা। মহতী অনুধাবন সন্দেহ নেই— একবিন্দুও মিথ্যাচার নেই ফিচারটিতে। সত্যের বাস্তবতা তো এটাই। এভাবেই ধুঁকছে বাংলাদেশের এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমা জগৎ। কিন্তু কেবল এই-ই কী বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রের একমাত্র চালচিত্র! হায়!! হ্যাঁ! অন্তত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের সিনেমা সম্বন্ধে এর চেয়ে বেশি তথ্য আমরা অফিশিয়ালি পাইনি— কিন্তু সেখানে পৌঁছে প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি তীব্রভাবে বাংলাদেশের মৌলিক ধারার চলচ্চিত্রের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি।
ফিল্ম প্রডিউসার হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ আমন্ত্রণপত্র এসেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর এবং ডিরেক্টর মার্কেটিং ইবনে হাসান খানের নামে। সেই প্রেস্টিজিয়াস আমন্ত্রণপত্রে কান উৎসবের সব পর্যায়ে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া রয়েছে। এবারের ৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটিতে প্রদর্শিত হয়েছে উডি অ্যালেনের ‘ক্যাফে সোসাইটি’ ছবিটি। সেটি দেখারও আমন্ত্রণ হাতে এলো। তবে কি শুধুই ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের স্মৃতি হয়ে থাকবে এই আন্তর্জাতিক উৎসবটি? না, জনাব ফরহাদুর রেজা প্রবালের উৎসাহে আরও একটু অগ্রসর হলাম আমরা। মোদ্দা ফোকাস : বাংলাদেশের নাম কী করে যুক্ত করা যায় এ মহতী উৎসবটির সঙ্গে? উত্তর একটিই— অবশ্যই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে। নানা কিসিমের দোদুল্যমান অবস্থা এবং উদ্বেগ-উত্তেজনা নিয়ে শুরু হলো সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক আবহে হলেও উৎসবের প্রায় সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ফ্রেঞ্চ ভাষায়। তাহলে উপায়! এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন ফ্রান্স প্রবাসী স্বপন আহমেদ। প্রায় শখানেক ই-মেইল চালাচালির পর নিশ্চিত হলো কান উৎসবে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত হিউম্যান ট্রাফিকিং বিষয়টির ওপর নির্মিত অত্যন্ত মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা’, `THE UNNAMED’ এর প্রিমিয়ার। চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন নিশ্চিত হলো কান উৎসবের প্রধান ভবনে। মার্কশেদু ফিল্মের বাণিজ্যিক শাখায়।
যথাসময়ে প্রদর্শিত হলো ‘অজ্ঞাতনামা’। ভিন্নধর্মী প্লটের বিন্যাসের কারণে আর বিশেষ করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের একটি ঘটনাকে আপন দেশের দৃষ্টিভঙ্গি হতে তুলে ধরায় প্রশংসিত হলেন পরিচালক তৌকীর আহমেদ। আদতে এটিই তো এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য— নানা দেশের চলচ্চিত্র সম্বন্ধে জানা এবং নিজভূমির চলচ্চিত্রের ভাষা অন্যকে জানানো। সঙ্গে চলচ্চিত্রের বিপণন বা বাণিজ্যিক ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত অর্থাৎ নিজের সৃষ্টিকে প্রকাশ করার জন্য ছবির বাজার তৈরি করা। ক্রিটিকদের পাশাপাশি প্রডিউসারদেরও আগ্রহ জাগিয়ে তোলা।
তাই কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল ভবনের নিচতলাতেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নিজেদের প্যাভিলিয়নে নিজ নিজ দেশের চলচ্চিত্রের বিবিধ বিষয় তুলে ধরেছেন। তথ্য, প্রযুক্তি, যৌথ প্রযোজনার সুবিধা, বিক্রয়যোগ্য সিনেমা— যেগুলো তারা গ্লোবাল মার্কেটে তুলতে চান সে সবের তথ্য-সংবলিত ব্রোশিওর সাজিয়ে বসার চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন আয়োজকরা। বাংলাদেশের কোনো প্যাভিলিয়ন সেখানে ছিল না। এজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ খুব জরুরি। বুঝতে পারলাম, এই ধরনের সম্মানিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র স্থান করে নিতেই পারে।