শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিকান্দার আবু জাফর সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর

শুভ্র আহমেদ

সিকান্দার আবু জাফর সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর

রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, বাঙালির এই যে নবজাগরণ এখানে বাঙালি মুসলমানের স্পর্শ-অংশ সামান্যই। তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণে ধরে নেওয়া চলে বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের প্রস্তুতির (১৮৭১-১৯২০) পর বাঙালি মুসলমান প্রকৃতই নবজাগরণের রোদ-বৃষ্টিতে, পুষ্পে-পল্লবে, হাসি-আনন্দের যাত্রাপালায় কাটিয়েছে পরবর্তী (১৯২১-১৯৭০) অর্ধশতক।

নবজাগরণের এই পুরোটা সময় সাহসী-সৎ-যুক্তিবাদী ও অসামপ্রদায়িক মননের সম্পূর্ণ মানুষ সিকান্দার আবু জাফর (৩১ মার্চ ১৯১৯-৫ আগস্ট ১৯৭৫) সাহিত্যের সব গলিমুখ-রাজপথ পেরিয়ে, নদী-সমুদ্র সাঁতরিয়ে মরুতৃষ্ণায় আভিজাত্যের চির উন্নত শিরে হয়ে উঠেছিলেন কবি। সম্পাদক, সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে নবজাগরিত সংস্কৃতির প্রধান প্রযোজক, পরিচালক। জীবন অন্বেষী, জীবনমুখী সিকান্দার আবু জাফর সাতরঙে অফুরন্ত জীবন ফোয়ারা ছুটিয়েছেন উপরোল্লিখিত নবজাগরণের সম্পূর্ণ উজ্জ্বল-বর্ণিল কালপর্ব জুড়ে।

অস্থির-চঞ্চল-জেদি-উচ্চকণ্ঠ সিকান্দারের পূর্বপুরুষ মসজিদের ইমামতির সূত্রে এ দেশে স্থায়ী আবাস স্থাপনের কারণে সিকান্দার হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রবল বাঙালি। অন্যদিকে ভারতীয় উদার সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রথম পাঠ তিনি পেয়েছিলেন পিতৃব্য, সিংহপুরুষ, কংগ্রেস রাজনীতির মাঝিমাল্লার সৈয়দ জালাল উদ্দীন হাশেমীর কাছ থেকে। সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর সহচর ছয় দফার সমর্থক হয়েও সিকান্দার রাজনীতি অপেক্ষা ছয় দফা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের অর্কেস্ট্রায়নেই বেশি উদ্দীপ্ত হন, নিজেকে জড়িত করেন নাবিকের সাহসিকতায়।

রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রথম নবজাগরণে বাঙালির মুক্তি ঘটেছিল প্রথমত সাংস্কৃতিক কিছুটা অর্থনীতি এবং সামান্যই রাজনৈতিক। প্রচলিত ধর্মের সরোবরে জমে ওঠা আবর্জনা পরিষ্কার করে ধর্মের মহিমা এবং মানবিকতার ইস্পাত কুসুম সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক জ্ঞাত করাই ছিল এই নবজাগরণের অন্যতম গৌরব, তাৎপর্য। কিন্তু বাঙালি মুসলমান মৌল এবং মুখ্যতই জেগে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক চিন্তার রৌদ্র মেঘে জড়াজড়ি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃৃতিক-সামাজিক মুক্তির চাঁদ সূর্য স্পর্শ করার চেষ্টায়। সিকান্দার আবু জাফরের যাপিত জীবনের বিপুল বিচিত্রিতা এবং সৃষ্টিকর্ম বিশ্লেষণে আমরা উপরোক্ত প্রভাব কণার তীব্রতায় উষ্ণতার অনুভব করি।

কবি-গীতিকার, কথাশিল্পী, নাট্যব্যক্তিত্ব, অনুবাদক, সাংবাদিক-সম্পাদক প্রভৃতি সত্তার নির্মোহ শৈল্পিক সস্ফিনি বাজিয়েছেন তিনি, নতুন সমাজ, নতুন সংস্কৃৃতি বিনির্মাণের চেষ্টায়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরোধী সিকান্দার মুখ ও মুখোশের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের সঙ্গে সংগ্রামরত জনতার প্রাণপণ যুদ্ধে সর্বদাই ছিলেন জার্মান কবি হাইনের মতোই সহযোদ্ধা।

‘কর্মে-সংগ্রামে-সাধনায় মানুষ এক ঐতিহাসিক সত্তা।’ ১৯৩৯ সালে কলকাতার মিলিটারি অ্যাকাউন্টস বিভাগে চাকরি, ১৯৪২ এ সিভিল সাপ্লাই অফিস, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘গ্লোব নিউজ এজেন্সি’র চাকরি পর্ব সিকান্দারের জীবনে জপমালার মতো অস্থির আবেগতাড়িত বৃত্ত-অধিবৃত্তের সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে। কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ায় পূর্ব পর্যন্ত এই দশকের সামাজিক রাজনৈতিক নানা পালাবদল সিকান্দার মানসে গভীর ছাপ ফেলেছিল, তার প্রভাবেই আমরা পেয়েছিলাম ‘প্রসন্ন প্রহর’র বেশকিছু সমাজমনস্ক কবিতা। এ প্রসঙ্গে আলোচনার আগে জেনে নেওয়া যাক পালাবদলের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। অবশ্য এসব আলোচনার আগে একবার মান্নান সৈয়দের স্মরণ নেওয়া কর্তব্য। মান্নান আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন দশকওয়ারী বিভাজনে সিকান্দার মূলত চল্লিশের কবি এবং চল্লিশের প্রধান কবিদের মতোই সিকান্দারের উত্থান, প্রাথমিক বিকাশও নগর কলকাতায়। চল্লিশের অন্যসব কবির মতোই সিকান্দারও মুখোমুখি হয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের শোষণ, নািস-ফ্যাসিস্ত অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রী সোভিয়েতদের প্রাণপণ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ সংগ্রামের খবর, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সিদ্ধান্তের বলি দেশ বিভাগের অগ্রসর হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, বাস্তুছিন্ন বিপুল মানুষের স্রোত ইত্যাদি। সিকান্দার অবশ্য মনে করতেন এইসব নষ্ট সম্পর্কের মূলে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির মন্দ ইচ্ছা, বেলেল্লাপনা। সিকান্দার ১৯৫০ সালে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর ঢাকা বেতারের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু মাত্র তিন বছর পরে বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সাংবাদিকতা। প্রথমে দৈনিক ইত্তেফাক, পরে মিল্লাত ও শেষে সংবাদে। স্থাপত্য এবং চলচ্চিত্র ব্যবসার নিরলস প্রচেষ্টায়ও কাটিয়েছেন কিছুটা সময়। তার সম্পাদনায় ‘সমকাল’ (১৯৫৭-১৯৭০) প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত এই যে অস্থিরতা এর পেছনে কী কেবল সিকান্দারের ব্যতিক্রমী অনন্য মানস যাকে আমরা ‘সিকান্দার মানস’ বলে শনাক্ত করতে পারি তাই দায়ী নাকি সিকান্দার একান্তভাবেই দেশ-কাল-সংস্কৃতি সচেতন ছিলেন বলে অবচেতনেই বার বার অস্থির হয়ে উঠেছেন, ধাবিত হয়েছেন নিত্য নতুন বৃত্তি গ্রহণে। চল্লিশের এই উত্তাল সময়ে রচিত এবং ১৯৬৫ তে  প্রকাশিত ‘প্রসন্ন প্রহর’ কাব্যগ্রন্থে কবি অনেক বেশি দেশ-কাল চেতন। একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের অশুভ শক্তিরও বিরোধী তিনি। জনগণের প্রত্যাশা সমূহের সলিল সরোবরে অবলোকন অবগাহনের পাশাপাশি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কবি দৃঢ় সংকল্প। কবি দৃঢ় বিশ্বাসী, দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন হওয়ার পথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অফুরান বিনাশ হবে:

‘প্রভুত্বের ভিত্তিহীন যুক্তির কৌশলে/ সর্বস্ব বিলানো কভু হবে না বিফল,/ বংশানুগ পীড়নের রথচক্র তলে/ একদা বিচূর্ণ হবে দাসত্ব শৃঙ্খল।’

সমসাময়িক ঘটনাবলীকে কবিতায় রূপান্তর, শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা রচনা, পরিশেষে সিদ্ধি অর্জন সহজসাধ্য নয়। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতায় ইতিহাস বয়ানের আড়ালে মূলত কবি সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর রক্তলোলুপ থাবার শিকার মানুষের স্মরণ করেন। কবি স্বপ্নভঙ্গের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদের নতুন অবয়ব প্রত্যক্ষ করেন একই সঙ্গে স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে দেখতে পান প্রতিবাদী শোষণ পরাধীনতা থেকে মুক্তিঅন্বেষী অগ্রবর্তী মানুষের মুখ। ‘বৈরী বৃষ্টিতে’ কবি সাম্রাজ্যবাদের শোষণ যন্ত্রণার ছবি প্রত্যক্ষ করেন মূলত সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত কালপর্বে সিকান্দারের রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘কবিতা ১৩৭২’, ‘কবিতা ১৩৭৪’, ‘বৃশ্চিক লগ্ন’ এবং ‘বাঙলা ছাড়ো’।

প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে বাংলায় জাতীয় চেতনা বলে কিছু ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক শাসনের চাপ, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিচ্ছিন্ন জনপদের মধ্যেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুদৃঢ় সংযোগহীনতা শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে বাংলার শ্রেণিবিভক্ত মানুষের পক্ষে কৌম চেতনা থেকে বৃহত্তর জাতীয় চেতনার স্তরে উন্নীত হতে উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিশ শতকের ষাটের দশক রাজনৈতিক দিক দিয়ে ছিল উত্তাল। আবার এই রাজনৈতিক উজ্জীবনও ঘটেছিল উজ্জীবিত সংস্কৃতির হাত ধরে। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাংস্কৃৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে যে বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন ঘটেছিল তাই একসময় বৃহত্তর জাতীয় চেতনার স্তরে উন্নীত হয়। সিকান্দার আবু জাফর কালের হাত ধরে এগিয়ে গেছেন ধাপে ধাপে ক্রমপরিণতির দিকে। তার ‘সংগ্রাম চলবেই’ কবিতায় সেই উপলব্ধির কথা:

‘দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরও দেবো অস্থি

প্রয়োজন হলে দেবো একনদী রক্ত।’

বিক্ষোভ-বিদ্রোহ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় আত্মবিশ্বাসী কবি কখনো প্রত্যক্ষ উচ্চারণে, কখনো না সম্পূর্ণ রূপকের অন্তরালে ঘৃণার বাষ্পইঞ্জিনে বিতাড়িত করতে চায় সাম্রাজ্যবাদের শেষ শক্তি শেষ চিহ্নটিকে। তার কাব্যগ্রন্থ ‘বাঙলা ছাড়ো’ প্রকাশ হয় ১৯৭১ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে সংকট ও সম্ভাবনার সময়ে, সেখানে কবি গভীর প্রত্যয়ে নির্ভরশীল কণ্ঠে ভালোবাসার কথা শুনিয়েছেন। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী কবিতাটি ছাপতে সাহসী না হওয়ার পর তা সাত মার্চ ডেটলাইনে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় ছাপা হয়। সাত মার্চ সকালে পত্রিকার পাঠকরা প্রত্যক্ষ করেন সিকান্দারের তেজোদ্দীপ্ত সাহসী উচ্চারণ :

‘আমার হাতেই নিলাম আমার

নির্ভরতার চাবি;

তুমি আমার আকাশ থেকে

সরাও তোমার ছায়া

তুমি বাঙলা ছাড়ো।’

সাত মার্চ বিকেলে রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন পাকিস্তানের প্রতি চরমপত্র, স্বাধীনতার ঘোষণা, সংগ্রামের রোডম্যাপ। এর আগে ব্যস্ততার মধ্যেও ছয় মার্চ, বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ নিরিবিলি কথা বলেছিলেন তার বাল্যবন্ধু, পরম  হিতৈষী এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন, সমালোচক কবি সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে। কি কথা হয়েছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কবি সিকান্দার আবু জাফরের। এটি আমাদের অজানা। তবে ৭ মার্চ একই সঙ্গে আমরা কবিতা ও বক্তৃতার এমন এক যুগলবন্দী উপহার পেয়েছিলাম যা হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিরল। কবি সিকানদার আবু জাফরের কবিতায় বৈচিত্র্য এনেছে তেমনি সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গ তাকে করে তুলেছে সাহসী, মাটি ও মানুষের কাছাকাছি।

সর্বশেষ খবর