শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলা সাহিত্যে শরৎ কাহিনী

তানভীর আহমেদ

বাংলা সাহিত্যে শরৎ কাহিনী

আজ বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকী। দরিদ্রতার কশাঘাতে তার জীবনে যেমন রয়েছে টানাপড়েন তেমন রয়েছে জীবনযুদ্ধে লড়াই করার অদম্য গল্প। কখনো কেরানি, কখনো হিসাবরক্ষক, ধানের ব্যবসার ব্যবস্থাপক, হোমিওপ্যাথির চিকিত্সক, কখনো জমিদারবাড়ির গাইয়ে-বাজিয়ে কত ধরনের পেশাতেই না জড়িয়েছেন তিনি। কখনো ঘর-সংসার ছেড়ে নিয়েছেন সন্ন্যাস জীবন। কখনো আড্ডা, অভিনয় আর খেলাধুলায় মেতেছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার সাহিত্যকর্ম জয় করেছে সময়কে। শ্রীকান্ত, দেবদাস, দেনা পাওনা, বড়দিদি, চরিত্রহীন, দত্তা, গৃহদাহ, বিপ্রদাস বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসে শরত্চন্দ্রকে করেছে অনন্য। এই বাংলার মধ্যবিত্তের সংসার জীবন চিত্রায়ণে গল্প ও অনুভূতির যে খেলা শরত্চন্দ্র তার উপন্যাস, গল্পে খেলেছেন তাতে বলাই যায়, তিনি এনেছেন বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব শরেবলা...।

 

দরিদ্রতার সঙ্গে ন্যাড়ার সখ্য

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাশিল্পী শরত্চন্দ্রের সখ্য ছিল দরিদ্রতার সঙ্গে। এই সখ্য তার নিয়তি। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ সেপ্টেম্বর এই কথাশিল্পীর জন্ম হয় হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। জাতে ব্রাহ্মণ এই পরিবারে ছিল চরম অর্থকষ্ট। বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মা ভুবনমোহিনী দেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে শরৎ ছিলেন দ্বিতীয়। শুধু দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। শরত্চন্দ্রের শৈশবও কেটেছে এখানে। শরত্চন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাড়া। ৫ বছর বয়সে দেবানন্দপুরের প্যারি পণ্ডিতের পাঠশালায় যাওয়া শুরু করেন শরত্চন্দ্র। পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমন ছিলেন দুরন্ত। জীবনযুদ্ধে বার বার ন্যাড়াকে দরিদ্রতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। ১৮৮৯ সালে বাবা মতিলালের চাকরি চলে যায়। তারই জের টানতে হয় শরত্চন্দ্রকে। স্কুলের ফি দিতে না পারার কারণে তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন তিনি। সে সময় পড়াশোনার খরচ জোগাতে তিনি তার মাতামহের ছোট ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরিন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়াতেন। তার বিনিময়ে অঘোরনাথ শরত্চন্দ্রের কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় টাকা দিতেন। কিন্তু সে টাকাও যথেষ্ট ছিল না। কলেজে পড়ার সময় শরত্চন্দ্র টাকার অভাবে কলেজের পাঠ্যবইও কিনতে পারেননি। সহপাঠী অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়তেন এবং সকালে বই ফেরত দিয়ে আসতেন। কলেজে এভাবে দুই বছর পড়েও টেস্ট পরীক্ষার শেষে এফএ পরীক্ষার ফি মাত্র কুড়ি টাকা জোগাড় করতে পারেননি। তাই এফএ পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার।

 

‘বড়দিদি’ পাল্টে দিল সব

১৭ বছর বয়স থেকে লেখালেখি করলেও সেসব প্রকাশ পায়নি। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘বড়দিদি’। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাগলপুরে বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্যের বাড়িতে কিছু গল্প-উপন্যাস রেখেছিলেন। শরত্চন্দ্রের বাল্যবন্ধু সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ভাগলপুর থেকে কলকাতা ফিরে যাওয়ার সময় শরত্চন্দ্রের অনুমতিতে সেই পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে যান। পরে এই খাতাগুলো বিভূতিভূষণকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার সময় তিনি ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি টুকে নিয়ে একটি কপি নিজের কাছে রাখেন। ভারতী পত্রিকার সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় সংখ্যায় তিন ভাগে ‘বড়দিদি’ প্রকাশ করেন। প্রথম দুই সংখ্যায় লেখক হিসেবে শরত্চন্দ্রের নাম ঊহ্য রাখা হলে এই লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিনা তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আষাঢ় সংখ্যায় বড়দিদির লেখক হিসেবে শরত্চন্দ্রের নাম প্রকাশ করা হয়। এরপরই লেখক হিসেবে শরত্চন্দ্রের সুনাম ও খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাহিত্যবোদ্ধারাও তার প্রশংসা করেন।

 

শরতের জীবনে শান্তি দেবী

শরত্চন্দ্রের ব্যক্তি জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। বার্মায় শরত্চন্দ্র রেলের হিসাবরক্ষণ অফিসে কেরানি হিসেবে চাকরি করতেন। তখন তার বেতন ছিল ৭৫ টাকা। কাজের সূত্রে তখন রেঙ্গুনের পোজনডংয়ে থাকতেন তিনি। পোজনডং এলাকাটি ছিল কল-কারখানার শ্রমিকদের আবাসস্থল। কারখানার মিস্ত্রিদের সঙ্গে তার ভালো সখ্য ছিল। তিনি যে বাসায় থাকতেন সেখানেই এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রি থাকতেন। ওই মিস্ত্রির শান্তি নামে একটি কন্যা ছিল। চক্রবর্তী এক প্রৌঢ় ও মাতাল মিস্ত্রির সঙ্গে তার কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করে। একদিন হুট করেই শরত্চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন তার মেয়ে শান্তি দেবী। কারণ তার বাবা মদ্যপ এক পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছেন। শান্তি দেবীকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে শরত্চন্দ্র তাকে বিয়ে করেন। এই সংসারে তাদের এক পুত্রসন্তানেরও জন্ম হয়। কিন্তু রেঙ্গুনের জীবনে শরত্চন্দ্র দুজনকেই হারান। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মারা যান। শরত্চন্দ্রের বিবাহিত জীবনের গল্প এখানেই ফুরিয়ে যায়নি। এরপরও আরেকবার তিনি বিয়ে করেছিলেন। মেদিনীপুরের ১৪ বছরের বাল্যবিধবা কন্যা মোক্ষদা ছিলেন তার দ্বিতীর স্ত্রী। শরত্চন্দ্র তার নাম রেখেছিলেন হিরন্ময়ী দেবী। হিরন্ময়ী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। বিয়ের সময় পর্যন্ত হিরন্ময়ী দেবী লেখাপড়া জানতেন না। পরে শরত্চন্দ্র তাকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন।

 

আড্ডাবাজ শিকারি

শরত্চন্দ্র আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তিনি ঘরোয়া বৈঠকে খুব গল্প করতে পারতেন। আড্ডায় তিনি রসিক মানুষ হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতেন। অতিথিদের সঙ্গে তিনি ছিলেন বন্ধুপরায়ণ। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে যেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করতেও তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। তিনি বরাবরই দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। সাপুড়েদের মতো অতি অনায়াসেই বিষধর সাপও ধরতে পারতেন বলে জনশ্রুতি ছিল। দরিদ্রতা কাটিয়ে ওঠে তিনি নিজের পোশাকে সৌখিনতার ছাপ ফেললেও কখনো বিলাসী ছিলেন না। আত্মপ্রচার করতেন না মোটেও।

 

অভিমানে বেছে নেন সন্ন্যাস

পরীক্ষার ফি দিতে না পেরে কলেজ ছাড়েন শরত্চন্দ্র। এ সময়টায় তিনি ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় কাটাতেন। সাহিত্য সভার আয়োজন করেন প্রতিবেশী বিভূতিভূষণে বাড়িতে। এখানে বসে দিন-রাত গল্প-উপন্যাস লিখতেন এবং পড়তেন। সাহিত্যচর্চার এই সময়টাতেই তিনি লিখে ফেলেন, ‘বড়দিদি’, ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং ‘অনুপমার প্রেম’, ‘আলো ও ছায়া’, ‘বোঝা’, ‘হরিচরণ’ ইত্যাদি গল্প রচনা করেন। সে সময়ও তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশ পায়নি। ওদিকে অর্থকষ্টে শরত্চন্দ্রের বাবা দেবানন্দপুরের ঘরবাড়ি বিক্রি করে ফেলেন। সংসার চালাতে এর-ওর কাছে ধার এনে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। শরত্চন্দ্র এই সময় বনেলী রাজ এস্টেটে অল্প কিছু-দিনের জন্য একটা চাকরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন পিতার ওপর অভিমান করে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন। সন্ন্যাসী সেজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কিন্তু সন্ন্যাস হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় একদিন খবর পান তারা বাবা মারা গেছেন। তিনি ভাগলপুরে ফিরে আসেন। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ধরেন বার্মার পথ।

 

এবার রেঙ্গুন যাত্রা

বাবার মৃত্যুর পর নতুন করে জীবন গোছানোর চেষ্টা করেন শরত্চন্দ্র। কলকাতায় এসে তিনি উপেন মামার দাদা কলকাতা হাই কোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন। হিন্দি পেপারবুকের ইংরেজি তর্জমা করার একটা চাকরি নেন তিনি। তার বেতন ধরা হয় ৩০ টাকা। এখানে ছয় মাস কাটান। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে কলকাতা ছেড়ে বার্মার পথে রওনা হন। সেখানে ছিলেন লালমোহনবাবুর ভগ্নিপতি। তার বাসায় থেকে রেঙ্গুনে রেলওয়ের অডিট অফিসে শরত্চন্দ্র যে অস্থায়ী চাকরি করতেন সেটিও দুই বছরের বেশি থাকল না। হঠাৎ অঘোরবাবুর মৃত্যু হলে শরত্চন্দ্রের রেলের কেরানির চাকরিটা চলে যায়। এবার তিনি চলে আসেন রেঙ্গুন থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে পেগুতে। এখানে এসে ওঠেন অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। অবিনাশবাবুর বাড়ি ছিল শরত্চন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরের অদূরে বৈদ্যবাটীতে। সে সূত্রে তার কাছে আশ্রয় নেওয়া। এরই মাঝে শরত্চন্দ্র নাঙ্গলবিনে কিছুদিন এক ধানের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ঘটনাক্রমে ডেপুটি এক্সামিনার মণিন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে শরত্চন্দ্রের একদিন পরিচয় হয়। মণিবাবু তাকে নিজের অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। শরত্চন্দ্র এই চাকরি পেয়ে পেগু থেকে রেঙ্গুন চলে আসেন। রেঙ্গুনের কল-কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে তার ভালোই দিন চলত। তিনি তাদের চাকরির দরখাস্ত লিখে দিতেন, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দিতেন। এ সময় তাদের অসুখে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা করতেন, বিপদে অর্থ সাহায্যও করতেন।

 

রেঙ্গুন থেকে লেখা...

রেঙ্গুনে অবসরে সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যেতেন শরত্চন্দ্র। শরত্চন্দ্র অফিসে এক মাসের ছুটি নিয়ে রেঙ্গুন থেকে দেশে আসেন।  সে সময় যমুনা-সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল তার কাগজে লেখা দিতে শরত্চন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন। শরত্চন্দ্র তাকে কথা দেন, রেঙ্গুনে গিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেবেন। তিনি সে কথা রাখেন। রেঙ্গুন গিয়ে তিনি ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন। ফণীবাবু এই গল্প তার কাগজে ১৩১৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশ করলে শরত্চন্দ্র আবারও আলোচনায় চলে আসেন। ‘বড়দিদি’ উপন্যাস প্রকাশ পাওয়ার পর ‘রামের সুমতি’ তাকে লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও পাঠকপ্রিয় করে তোলে। এরপর তার একের পর এক উপন্যাস-গল্প প্রকাশ পেতে থাকে।

 

দেবদাস কেন এত বিখ্যাত

বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘দেবদাস’ শরত্চন্দ্রের অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম। শরত্চন্দ্র ১৯০১ সালে এটি লিখলেও প্রকাশ পায় ১৯১৭ সালে। উপন্যাসটি প্রকাশের পরপরই বিপুল পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। গোটা ভারতবর্ষ জয় করে দেবদাসের প্রেমে মশগুল হন বিশ্বসাহিত্যপ্রেমীরা। বিভিন্ন ভাষায় দেবদাস অনূদিত হয়। বিভিন্ন সময় এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রগুলোও দর্শকনন্দিত হয়েছে।

দুটি নর-নারীর গভীর ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে ‘দেবদাস’র কাহিনী গড়ে উঠেছে। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সুনিপুণভাবে তাদের প্রেমগাথা রচনা করেন। জমিদারপুত্রের সঙ্গে সাধারণ ঘরের এক মেয়ের প্রেমের গল্প যুগ থেকে যুগ পেরিয়ে এখনো নতুন, আবেদন জাগানিয়া। দেবদাস-পার্বতীর প্রেম বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তিন দেশে শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘দেবদাস’ নিয়ে এ পর্যন্ত ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে আশির দশকে বুলবুল আহমেদ, কবরী, আনোয়ারা ও রহমানকে নিয়ে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করা হয়। সাদা-কালো যুগের এই ছবিটি দুই বাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯২৮ সালে ‘দেবদাস’ নিয়ে প্রথম ছবি নির্মিত হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে অভিনেতা-প্রযোজক-পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। ১৯৫৩ সালে তেলেগু ভাষায় ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন ভেদান্তম রাগাভাইশ। ১৯৫৫ সালে হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘দেবদাস’ ভারতের সব বিখ্যাত  প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। এই ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন বিমল রায়। এতে দেবদাস চরিত্রে তৎকালীন হিন্দি ছবির বরপুত্র দিলীপ কুমার এবং পার্বতী চরিত্রে রূপদান করেন বাংলা চলচ্চিত্রের সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা সেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানে ‘দেবদাস’ ছবি নির্মিত হয়। এটি পরিচালনা করেছিলেন সরফরাজ। ১৯৭৯ সালে দিলীপ রায় আবার কলকাতায় ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখার্জি, সুপ্রিয়া চৌধুরী এবং উত্তম কুমার (চুনিলাল) অভিনয় করেন। ২০০২ সালে শত কোটি টাকা ব্যয় করে শাহরুখ, ঐশ্বরিয়া রাই এবং মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে সঞ্জয় লীলা বানসালি ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। ছবিটি সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের ভালোবাসা, অপূর্ণতা, বেদনার ছোবল— সব মিলিয়ে পাঠক মনে তৈরি করে অনন্য এক অনুভূতি। যে কারণে শরত্চন্দ্রের দেবদাস কালজয়ী।

 

বিপ্লবে শরত্চন্দ্র

শরত্চন্দ্র রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে দেশবন্ধুর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ১৯২২ সালে সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাইলে দেশবন্ধু তা করতে দেননি। শরত্চন্দ্র অহিংস কংগ্রেসের একজন নেতা হলেও বরাবরই কিন্তু ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা সংক্ষেপে বিভি দলের সর্বাধিনায়ক প্রখ্যাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার আসামি বিপ্লবী শচীন সান্যাল প্রমুখ ছাড়াও বারীন ঘোষ, উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, চারু রায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতনামা বিপ্লবীর সঙ্গেও তার যথেষ্ট সখ্য ছিল। শরত্চন্দ্র বহু বিপ্লবীকে নিজের রিভলবার, বন্দুকের গুলি এবং অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক মহাবিপ্লবী সূর্য সেনকেও তিনি তার বৈপ্লবিক কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন।

 

 

 

 

শরৎ বাণী

>> অতীত মুছে ফেলার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে স্থান পাল্টানো

 

>> পক্ষপাতহীন বিচারকই ন্যায়বিচার করতে পারেন

 

>> বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়

 

 

 

 

শেষ দিনগুলো...

মধ্যবয়সে শরত্চন্দ্র হাওড়া জেলার পানিত্রাস গ্রামের মাটির বাড়িতে বাস করতেন। ১৯৭৮ সালের বন্যায় গ্রামের মাটির বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে শরত্চন্দ্রের মাটির বাড়িটা রক্ষা পায়। জানালা পর্যন্ত ভিতটা ইট-সিমেন্টে গাঁথা ছিল বলে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পড়ে যায়নি।

পরবর্তীতে শরত্চন্দ্র শিবপুরেও থাকতেন। ১৯৩৭ সালের পর থেকেই শরত্চন্দ্র প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। একটা-না-একটা রোগে ভুগছিলেনই। তিনি কিছুদিন জ্বরে ভোগেন। জ্বর ছাড়লে ডাক্তারের উপদেশে দেওঘর বেড়াতে যান। সেখানে তিন-চার মাস থাকেন। এ সময় তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরে এটি পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিত্সক তার অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন।

চিকিত্সার জন্য তাকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি শল্যচিকিত্সক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেহে অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টায় শরত্চন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

 

 

 

শরত্চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম

শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশিত লেখালেখির মধ্যে রয়েছে—

উপন্যাস : বড়দিদি, বিরাজবৌ, পরিণীতা, বৈকুণ্ঠের উইল, পল্লীসমাজ, চন্দ্রনাথ, অরক্ষণীয়া, পণ্ডিতমশাই, দেবদাস, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, নিষ্কৃতি, দত্তা, গৃহদাহ, বামুনের মেয়ে, দেনা পাওনা, নববিধান, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন, বিপ্রদাস, শুভদা ও শেষের পরিচয়। নাটক : ষোড়শী, রমা ও বিজয়া। গল্প : রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে, পথ-নির্দেশ, মেজদিদি, আঁধারে আলো, দর্পচূর্ণ, কাশীনাথ, ছবি, বিলাসী, মামলার ফল, হরিলক্ষ্মী, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ, অনুরাধা, সতী ও পরেশ। প্রবন্ধ : নারীর মূল্য, তরুণের বিদ্রোহ, স্বদেশ ও সাহিত্য, স্বরাজ সাধনায় নারী, শিক্ষার বিরোধ, স্মৃতিকথা, অভিনন্দন, ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য, গুরু-শিষ্য সংবাদ, সাহিত্য ও নীতি, সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি এবং ভারতীয় উচ্চসংগীত। শরত্চন্দ্রের উপন্যাস ও গল্প অবলম্বনে ভারতীয় উপমহাদেশে ৫০টির মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে দেবদাস অবলম্বনে বাংলা, হিন্দি ও তেলেগু ভাষায় আটবার চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়।

সর্বশেষ খবর