শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
সা ক্ষা ৎ কা র ►

বাংলা অত্যন্ত সুন্দর ও সুমধুর ভাষা

বাংলা অত্যন্ত সুন্দর ও সুমধুর ভাষা

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাবিজ্ঞানী ড. হানা রুথ টমসন লন্ডন ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ও আফ্রিকান স্টাডিজের সাবেক অধ্যাপক। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে তার একাধিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা তার বাংলা ব্যাকরণ চমকিত করেছে গবেষকদের। বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কিছু বইয়ের অনুবাদও করেছেন। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত আছেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন —শেখ মেহেদী হাসান

 

 

আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা জার্মানিতে। পড়াশোনার একটি পর্ব সেখানেই শেষ করেছেন?

আমার জন্ম হয়েছে জার্মানিতে। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। জার্মানির সর্বোক ইউনিভার্সিটি থেকে ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স করেছি। তখন আমি ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা নিয়ে গবেষণা করছিলাম। ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে আমার খুব ভালো লাগে। তারপর ইংরেজি মানুষ কিথ টমসনকে বিয়ে করেছি। বিয়ের পর আমাদের তিনটি সন্তান হয়। ওদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। ১৯৯১ সালে আমার স্বামীর চাকরি হলো বাংলাদেশে ইংল্যান্ডভিত্তিক একটি উন্নয়ন প্রকল্পে। আমরা বাংলাদেশে চলে আসলাম। এখানে এসে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়ে গেলাম। কি সুন্দর লাগছিল এই দেশ। এই দেশের মানুষ। বাঙালিদের মুখে অত্যন্ত সুন্দর ও সুুমধুর বাংলা ভাষা শুনে সিদ্ধান্ত নেই আমি বাঙালিদের মতো বাংলা ভাষা শিখব।

 

বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হলেন কীভাবে?

আমি প্রথম বাংলা শিখতে শুরু করি ১৯৯১ সালে।  এর আগে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কোনো ধারণা আমার ছিল না। আবার আমি যে বাংলা ভাষা শিখব, তা নিয়েও আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। তবে তখনো আমি আশা করিনি যে এই ভাষাটি আমার এত ভালো লেগে যাবে। বাংলা ভাষার যে সব শব্দ আমার আকর্ষণ করেছিল তার মধ্যে ‘প্রজাপতি’, ‘বৃহস্পতিবার’, ‘সাধারণত’, ‘দুর্ভাগ্যবশত’ ইত্যাদি। এর সাউন্ডগুলো কি সুন্দর! আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, বাংলা অনেক সুন্দর ও জীবন্ত একটি ভাষা। আমরা তখন গুলশান এক নম্বরে থাকতাম। সন্তানদের লালন পালন ছাড়া আমার কোনো কাজ ছিল না। ফার্মগেটের গ্রিন রোডে অবস্থিত একটি ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারে আমি বাংলা শিখতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রতিদিন চার ঘণ্টা বাংলা শিখতাম। কিন্তু তাদের নিয়ম আমার ভালো লাগেনি। কারণ ক্লাস রুম খুব ছোট ছিল। আমার সঙ্গে বুড়া দুজন মানুষ ছিল। তারা কখনো কোনো বিদেশি ভাষা শেখেনি। অন্যদিকে আমি ছিলাম ভাষা বিশেষজ্ঞ। তাদের সঙ্গে ভাষা শিখতে আমার একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আর শিক্ষাটা চলছিল খুব আস্তে আস্তে। দ্বিতীয় মাস থেকে ক্লাসের চার ঘণ্টার মধ্যে আমি দুই ঘণ্টা ক্লাসে আর বাকি দুই ঘণ্টা অন্য একজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাদাভাবে বসে কথা বলি। এভাবে মোটামুটি দ্রুতই বাংলা ভাষা শিখে যাই। বাংলা শেখা ও জানার মতো উপযুক্ত কোনো বই ছিল না। আমার আগ্রহ ছিল বাংলা ভাষার ভিতরকার সৌন্দর্যগুলো জানা। তখন রাস্তায়, দোকানে,   স্টেশনে, বাজারে—বিচিত্র জায়গায় সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাংলা শিখেছি অনেক বেশি।

 

বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণ বিষয়ে বই লেখার তাগিদ আপনার মধ্যে তৈরি হলো কী করে?

আমার ভাবনা ছিল বাংলা ভাষা শিখে একটা চাকরি ধরব। বাংলাদেশে আসার ছয় মাস পর এখানে বান্ধবী রুথের সঙ্গে আমি কাজ করতে চেয়েছিলাম। তখন সে আমাকে বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে কাজ করবে না। তুমি বরং একটা বাংলা অভিধান লিখে দাও। তুমি যত তাড়াতাড়ি বাংলা শিখেছ, তেমনভাবে আমরা কেউ পারিনি। আমাদের জন্য তুমি একটা অভিধান লেখো। একটা ব্যবহারিক বাংলা ভাষার অভিধান আমাদের খুব দরকার।’ এটা আমার জীবনে খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল। তখন আমি এতটা বাংলা শিখিনি যে একটি বই লিখব? রুথের  কথাটা ভেবে আস্তে আস্তে মনে হলো, আসলেই কাজটা আমি করতে পারি। কারণ নিজের জন্য আমি শেখার কিছু নিয়ম বানিয়েছিলাম। বাংলা ভোকবলারির বই ছিল। বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদ, সর্বনাম ইত্যাদি আলাদা করে লিখে রেখেছিলাম। মনে হলো, আমার নোটগুলো অন্যদের জন্য উপকার হবে।

 

তারপর বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে প্রথম গবেষণা গ্রন্থ রচনা করলেন?

রুথের কথায় আমি বাংলা ব্যাকরণ রচনায় আগ্রহী হলাম। বিষয়টি অন্যদের জানালে তারা পরামর্শ দিল রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে। অথচ আমি উচ্চমানের কোনো সাহিত্য করতে চাইনি, চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ। পরে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার প্রধান লেখকদের বই পড়েছি। বুদ্ধদেব বসুর ‘মনের মতো মেয়ে’ উপন্যাস জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছি। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে হয়। কারণ বাচ্চাদের পড়াশোনার সমস্যা হচ্ছিল। তারপর ইংল্যান্ডে বসে বাংলা ব্যাকরণ বইটি লিখি। ১৯৯৯ সালে আমার প্রথম বই ‘এসেনশিয়াল এভরিডে বেঙ্গলি’ প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে। বাংলা একাডেমির তত্কালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক মনসুর মুসা আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। যতটা জানি, আমিই ছিলাম তাদের প্রথম বিদেশি লেখক। বইটা এখন একটু পুরনো হয়ে গেছে, তবে এখনো অনেকের কাজে লাগে। বইটি লিখতে গিয়ে আমি টের পেলাম, বাংলা ভাষা নিয়ে আরও বহু কাজের অবকাশ আছে আর আমি সেটি করতে চাই। মানে বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে গবেষণা করতে চাই।

 

আপনি বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে উচ্চতর একাডেমিক গবেষণা করেছেন। সে বিষয়ে জানতে চাই।

বাংলা একাডেমি থেকে বইটি প্রকাশের পর আমি বাংলা ব্যাকরণের বই পড়তে শুরু করি। কিন্তু কোনো বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের মধ্যেই আমার অজস্র প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না। আমি যা জানতে চাই, তা নিয়ে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে বুঝে নিতে হচ্ছিল। তখন লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. উইলিয়াম রাদিচির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বললেন, তুমি আমার অধীনে পিএইচডি ভর্তি হয়ে যাও। ১৯৯৯ সালে ‘সিলেক্টিভ বাংলা গ্রামেটিক্যাল স্টাকচার’ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরু করি। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করব। আমার মাথায় বাংলা ভাষা ছাড়া আর কিছু ছিল না। চার বছর পর পিএইচডি ডিগ্রি হলো।

 

লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে শিক্ষকতা শুরু করলেন কখন?

পিএইচডি গবেষণার মাঝে আমি সোয়াসে বাংলা ভাষা শেখাতাম। ২০০২ সাল থেকে লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের নিয়মিত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করি। দশ বছর শিক্ষকতার পর কাজটি ছেড়ে দেই। তারপর আমার স্বামীর সঙ্গে ২০১২ সালে সিয়ারালিওনে চলে যাই। ওদের ভাষা নিয়েও একটি গবেষণা করি। সেখানে বাঙালিদের নিয়ে বাংলা আড্ডার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমরা সপ্তাহে একদিন বাঙালিদের নিয়ে বসতাম, বাংলা ভাষায় কথা বলতাম। পশ্চিম আফ্রিকার দেশে বসেও আমি বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছি।   

 

বিভিন্ন দেশের গবেষকরা যেখানে বাংলা ভাষা, প্রাচীন ও বাচনিক সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন আপনি ব্যাকরণ ও অভিধান বেছে নিলেন কেন?

বিদেশি অনেকেই বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন। অন্য কোনো ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে কাজ করার জন্য একটা বিশেষ রকমের সাহস দরকার। তা ছাড়া সাহিত্য আমার কাছে একটা সাগরের মতো। সাহিত্য নিয়ে সারা জীবন আলোচনা করা সম্ভব। এই সাগরের মধ্যে আমরা ডুবে যাই। পায়ের তলায় কোনো মাটি পাই না। ভাষা আর ব্যাকরণ নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি, নতুন কিছু ধরতে পারি, আমি যা বুঝতে পেরেছি, তা অন্যদের কাছে বুঝিয়ে বলতে পারি। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আমার বিদেশি ছাত্রদের জন্য কার্যকরী একটা বই লেখা, যাতে তারা ভালোভাবে বাংলা ভাষাটা শিখতে পারে। বাংলা শিখতে চাইলে যে পদ্ধতি বা নিয়মের প্রয়োজন হয়, তা আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। তাই নিজের বিবেচনায় আমি প্রচুর উদাহরণ সংগ্রহ করেছি, ভাষা বিশ্লেষণ করেছি, আর কাজটাকে আপন করে নিয়েছি। এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।

 

বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান রচনার সময় আপনি কী কী সমস্যার মুখে পড়েছিলেন?

সমস্যার। যেমন ধরা যাক, ‘নয়’ আর ‘নেই’-এর পার্থক্য কী? কেন আমরা বলি, ‘আমি চিঠিগুলো পাচ্ছি’, আবার একই সঙ্গে বলি, ‘আমার ভয় পাচ্ছে’? কেন বলি, ‘এই কাজ করা দরকার’, কিন্তু ‘এই কাজ করার দরকার নেই’? আমি জানি, প্রতিটি ভাষা আর তার ব্যাকরণের মধ্যে একটা যুক্তি আছে। বাংলা ভাষার মধ্যে সেই যুক্তিটা আমি বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আসলে এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে চেষ্টা, ধৈর্য আর অনেক সময় লাগে। নিজের ধারণাগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে সংশোধন করতে হয়; ঠিক করতে হয় নিজের ভুলগুলো। এভাবে ব্যাকরণের বেলায় যা অস্পষ্ট ছিল, আস্তে আস্তে সেটি স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সব সময় অবশ্যই সহজে উত্তর পাওয়া যায় না। তখন প্রশ্নগুলোকে ঘিরে একটা উপায় বানাতে হয়। সেসব বিশ্লেষণ করতে আমার খুব মজা লাগে।

 

আপনার নিজের লেখা বাংলা ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব কী?

আমার একটা সুবিধা এই যে আমি বাইরে থেকে এসেছি। ফলে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার ইতিহাস কিংবা সাধু ভাষা—এসব নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হয়নি। আধুনিক ভাষার মধ্যে কী আছে, আধুনিক বাংলা ভাষার গঠনটা কেমন—আমি শুধু সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছি। আর যাঁরা বাংলা শিখতে চান, তাঁদের জন্য আমি একটা উপায় ঠিক করতে চেয়েছি। বাংলা ভাষাটা তো আমি নিজেই শিখেছি। ফলে বাংলা ভাষা শিখতে গেলে কী কী সমস্যা হয়, কী কী প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়—তা আমি জানি। এই প্রেক্ষাপটটিই হয়তো আমার লেখা বাংলা ব্যাকরণের একটা বৈশিষ্ট্য।

 

বাংলাদেশের ব্যাকরণ চর্চা নিয়ে আপনার অভিমত কী?

বাংলাদেশে ব্যাকরণ বইয়ে উদাহরণগুলো অনেক বছর পুরনো। বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের চিন্তাগুলো কেমন একটা ফানুসের ভিতরে আটকে আছে। তাদের গবেষণা ঐতিহাসিক। তারা বাংলা ভাষা বুঝানোর জন্য সংস্কৃত থেকে উদাহরণ দেন। আমি মনে করি, স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের মাথায় সংস্কৃৃত থাকে না। ভাষা তো জীবিত একটা জিনিস। ভাষার ভিতরে পরিবর্তন হতে থাকে। সেই পরিবর্তন থেকে ব্যাকরণের বর্ণনা ও বিশ্লেষণে নতুন বিবেচনা নিয়ে আসতে হয়। নইলে জীবিত ভাষা ও ব্যাকরণের মধ্যে সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে। এখানে স্কুলের ব্যাকরণ বইয়ে সাধারণত দুটো অংশ দেখেছি ব্যাকরণ আর রচনা। রচনা অংশগুলোতে প্রতি বছর নতুন বিষয় ঢুকে পড়ে। কিন্তু ব্যাকরণ অংশে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তাই নতুন উপায় বের করতে হবে। বাচ্চাদের মুখের ভাষা নিয়ে ব্যাকরণ আরম্ভ করতে হবে। তা হলে বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে।    

 

বর্তমানে কোনো গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত আছেন?

বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকারের সঙ্গে একটি যৌথ গবেষণা করছি। বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা রাউটলেজ প্রকাশিত একটি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ করছি।

আপনাকে ধন্যবাদ।

 

সর্বশেষ খবর