শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

লন্ডনে চিত্র প্রদর্শনী

ম নি রু ল ই স লা ম

লন্ডনে চিত্র প্রদর্শনী

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বেশকিছু বাঙালি ছাত্রছাত্রী পড়ত। তারা উদ্যোগ নিল আমার একক চিত্র প্রদর্শনী করার। ছবি পাঠানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রদর্শনীর ছবি আবার বিক্রয়যোগ্য নয়। তবে কয়েকটি গ্যালারির সঙ্গে সে সময় যোগাযোগ হয়। একটি গ্যালারির মাধ্যমে ওই শিল্পকর্মের কয়েকটি বিক্রিও করা হয়। সে সময় থেকেই বলা যায় স্পেনের বাইরেও আবার প্রদর্শনীর শুরু। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এমনি এমনি সব সাফল্য পায়ে এসে লুটায়নি। পোর্টফোলিও নিয়ে লন্ডনের লেন বাই লেনে অনেক হেঁটেছি। নিজেকে পরিচিত করিয়েছি। গ্যালারির তো শেষ নেই। কিন্তু অচেনা নতুন শিল্পীকে তারা সুযোগ দেবে কেন? হয়তো ১০টা গ্যালারির মধ্যে একটা আমার শিল্পকর্ম রাখতে রাজি হয়েছিল। তারপরও কত প্রশ্ন! বাংলাদেশের একজন শিল্পীকে তারা এত সহজে গ্রহণ করতে চায়নি। কিন্তু যখনই আমার ছবি বিক্রি হতে শুরু হলো, তখন লন্ডনের গ্যালারিগুলো আগ্রহ দেখাতে লাগল।

এক সময় তারা আমার বন্ধু হয়ে গেল। একই ঘটনা প্যারিসেও ঘটেছে। ১৯৮১-৮২ সালে আমি প্যারিসের ৮টি গ্যালারির জন্য কাজ করতাম। সে সময় ‘সাগা’ এবং ‘ফিয়াক’ নামে প্যারিসে দুটো বড় মেলা হয়। ফিয়াক হচ্ছে প্যারিসের সবচেয়ে বড় এবং বর্ণাঢ্য আর্ট ফেয়ার। এই উৎসবে শতাধিক গ্যালারি যোগ দেয়। সাগা এবং ফিয়াক-এ দুটো উৎসবে অংশগ্রহণ করা একজন শিল্পীর জন্য অত্যন্ত সম্মানের। কারণ এখান থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্ট গ্যালারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একজন শিল্পীর পরিচয় হয়। শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর কৌতূহলী হলে তার সঙ্গে গ্যালারি প্রদর্শনী কিংবা ছবি বিক্রির ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা করে নিতে পারে। এক সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শত শত শিল্পী পোর্টফোলিও নিয়ে ঘুরছে আর্টের তীর্থ প্যারিসের গ্যালারিতে গ্যালারিতে। অধিকাংশই পাত্তা পাচ্ছে না। আমাকেও কম তিক্ত কথা শুনতে হয়নি। এমনও হয়েছে, গ্যালারির লোকজন মুখের ওপর বলে দিয়েছে আমরা তো শিল্পকর্ম কিনি না, শুধু বেচি। কেউ কেউ যেন দয়াপরবশ হয়ে বলেছে, ঠিক আছে, রেখে যাও শিল্পকর্ম। বিক্রি হলে পয়সা পাবে। এই হচ্ছে বাস্তবতা। আমি তো কারও রেফারেন্সে যাইনি, সরাসরি নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে হাজির হয়েছি গ্যালারিতে। একই গ্যালারির আচরণ বদলে যেতে সময় লাগেনি। শিল্পকর্ম যখনই বিক্রি হতে লাগল, তখনই তারা হয়ে উঠেছে বন্ধু, তখন তারা ভিন্ন মানুষ। কত খাতির-যত্ন তখন। গ্যালারি অলারা ব্যবসা করতে বসেছে। ওদের চাইতে আর কে বেশি বোঝে যে, কোন শিল্পীর কী রকম চাহিদা। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া শিল্পীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার প্রয়োজন তারা বোধ করে না। বন্ধুত্ব তৈরি হওয়া খুবই কঠিন। ১০০ গ্যালারির সঙ্গে কাজ করলে দুটোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে। আমি সারা বছর ছবি এঁকে বিভিন্ন গ্যালারিতে দুই-পাঁচ-১০টা করে শিল্পকর্ম পাঠিয়ে দিতাম প্রথম দিকে।

১৯৮৩ সালে আমেরিকা থেকে একটা অফার এলো। এরই মধ্যে সানফ্রান্সিস্কোতে আমার শিল্পকর্ম বিক্রি হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন আর্ট রিসোর্স নামে আমেরিকার বোস্টনের একটি প্রতিষ্ঠান ‘হ্যানোভা ফাইন আর্টস’। সরাসরি প্রস্তাব দিল যে, বছরে ২০টি ছবির এডিশন দিতে হবে, তারা পে করবে আট হাজার ডলার। ২০টি ছবির ২০০টি প্রিন্ট দিতে হবে, আর পাব মাত্র আট হাজার ডলার? খুবই সামান্য দাম। তবু রাজি হয়ে গেলাম। কারণ ছবির মুক্তবাজারে প্রবেশের একটি ভালো সুযোগ এটি। তা ছাড়া গ্যালারি কর্তৃপক্ষ এসব শিল্পকর্মের প্রচারের জন্য ২০ হাজার ডলার ব্যয় করবে এক বছরে। শিল্পবিষয়ক দুটি জার্নালে বিজ্ঞাপন দেবে। আর্ট ইন আমেরিকা নামে একটি জার্নাল আছে যেটি পাঁচটি কন্টিনেন্টালের যাবতীয় গ্যালারি সাবস্ক্রাইব করে থাকে। ‘আর্টফ্ল্যাশ’ও একই মানের পত্রিকা। সেখানেও এক বছর আমার কাজের বিজ্ঞাপন থাকবে। বোস্টনের বিভিন্ন মিউজিয়ামে ওই কোম্পানিই আমার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করল। আমার নিজের পক্ষে যোগাযোগ করে ওইসব গ্যালারিতে ‘ওয়ান ম্যান শো’ করা সম্ভব হতো না। ফলে সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, আমি লাভবান না-ই হলাম। সে সময় প্রিন্ট করার কাজে আমাকে সাহায্য করত আমার স্ত্রী মেলাসহ চারজন। বলা যায় ফ্যাক্টরি ওয়ার্ক। তখন আমার বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ।

‘ফোক কামস অ্যান্ড গোজ অ্যাওয়ে’ নামে আমার একটি এচিং আছে। সানফ্রান্সিসকো এবং তাইওয়ান বিয়েনালে শিল্পকর্মটি পুরস্কৃত হয়। বোস্টনের আবার একটি প্রদর্শনীর প্রাইজ লিস্টে দেখলাম ছবিটির দাম ধরা হয়েছে তিন হাজার ডলার। ভাবতেই পারি না যে, এই প্রিন্টটি ওরা আমার কাছ থেকে মাত্র ২৫ ডলারে কিনেছে! গ্যালারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিও করতে হয় যে, গ্যালারিতে বিক্রির জন্য দেওয়া কোনো এচিংয়ের কপি আমি আমেরিকায় বিক্রি করতে পারব না। তবে স্পেনে বা অন্য কোথাও পারব। যেমন একটি ছবির ৮৫ কপি প্রিন্ট নেওয়া হলো। ওদের প্রাপ্য ৭৫ কপি, আমার ১০ কপি। এই ১০ কপি আমি আমেরিকার অন্য কোনো গ্যালারিতে বিক্রির জন্য দিতে পারব না। তবে স্পেনে পারব। একবার আমেরিকার একটি কোম্পানিতে আমার ৫০ হাজার ডলার জমা ছিল। কোম্পানিটি উঠে যায়, আমার টাকাও মার যায়। খুব একটা গায়ে লাগেনি। কারণ তখন আমি স্পেনে যথেষ্ট সচ্ছল।

আবার আমার জীবনে এমন অর্থাভাব হয়েছে যে, পাবলিক বাথে গোসল করতে হয়েছে, খাওয়ার জন্য কোনো বন্ধু বা বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছি। কিন্তু নিজেকে এতটুকু অসুখী বা দরিদ্র মনে হয়নি। কারণ একদিনের জন্যও আমি মানসিকভাবে আমার নিত্যনতুন কাজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নবোধ করিনি। হ্যাঁ, তখনো আমি সংসার করিনি, কিংবা দেশে আমাকে টাকা পাঠাতে হয়নি। ’৮০ সালে যখন দেশে ফিরি তখন ভাইয়ের জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছি, সুটকেস ভর্তি করে উপহার নিয়ে এসেছি, সংসারের জিনিসপত্রও এনেছি। তখন এত সুলভ ছিল এখানকার বাজারে বিদেশি আইটেম। আমরা নয় ভাইবোনই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। মায়ের জন্য কিছু পাঠানো জরুরি না। তবু প্রতিমাসে আমি মায়ের জন্য টাকা পাঠাই, কোরবানির সময় আলাদাভাবে ব্যবস্থা নিই।

একজন শিল্পীর মনোজগেক কখন কী স্পর্শ করবে, সে সম্পর্কে আগাম কিছু বলা যায় না। একজন শিল্পীর শিল্পকর্মের তুলনায় বেশি আকৃষ্ট করতে পারে তার মন্তব্য, অভিমত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রদর্শনীতে অংশ নিতে নিতে বিচিত্র মানসিকতার শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে। বিচিত্র ধরনের আর্টওয়ার্ক দেখারও সুযোগ তৈরি হয়। একজন শিল্পীর নিজস্ব কাজের ওপর তার কিছু না কিছু প্রভাব তো পড়তেই পারে। তুরস্কে আমার এক প্রদর্শনীতে এক নারী এসে বলেছিলেন, তোমার শিল্পকর্ম দেখে মনে হয় তুমি গভীরভাবে কোনো ধর্মীয় চেতনা দ্বারা প্রভাবিত, অথচ নিজের ধরনেই তুমি শিল্পকর্ম এঁকে যাচ্ছ। তিনি আমাকে ওখানকার একটি আখড়ায় নিয়ে গেলেন সেখানে মিস্ট্রিজিমের চর্চা হয়।

আমার দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ঠতম বন্ধু স্পেনের প্রবীণ ও খ্যাতিমান শিল্পী ৮২ বছর বয়স্ক অ্যান্থনিও লরেন্সের ভূমিকা আছে আমার কেরিয়ারের ব্যাপারে। তাকে গুরুর মতোই মানি, যদিও তিনি চান বন্ধু হয়ে থাকতে। একাই থাকেন তিনি। তার কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। তার গভীর জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য আমাকে প্রভাবিত করে। শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে তার রয়েছে গভীর অধ্যয়ন, সংগীত এবং নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কেও বিশদ ধারণা রাখেন। বই পড়ে শেখা যায়। কিন্তু আমার জন্য দরকারি বিদ্যার সারমর্ম যদি একজন ব্যক্তির বক্তব্য থেকেই পাওয়া যায়, তাহলে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বড়  মিউজিয়ামে ছবি দেখে দেখেই তো আমি জেনে গেছি শিল্পকলার বিবর্তনের ইতিহাস। তবে মিউজিয়ামে ছবি দেখতে গিয়ে আমি এটাও বুঝেছি, সব ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার কোনো মানে হয় না। প্যারিসের লুভ মিউজিয়ামে গিয়ে যেসব ছবি আমাকে টেনেছে সেসব দেখার পর ক্লান্ত লাগে। বাদবাকি ছবি দেখতে গিয়ে প্যাঁচ লেগে যায়। তখন মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগে।

আমি মিউজিয়ামে যাই দু-চারটে নির্দিষ্ট ছবি দেখার জন্য। ‘মোনালিসা’ ছবিটি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। আমি ‘মোনালিসা’ দেখার জন্য মিউজিয়ামে যাই না। একজন শিল্পী ছবি দেখে অন্যভাবে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অনেক ভালো ছবি আছে। যেমন পিকাসোর আছে গোয়ের্নিকা ছাড়াও অনেক ভালো ছবি। পিকাসো তার এই শিল্পকর্মটিকে মাস্টার পিস হিসেবে গণ্য করেননি। এটাকে তিনি একটি পোস্টার হিসেবেই দেখেছেন, তাই স্বল্প দামের ক্যানভাসে শিল্পকর্মটি আঁকেন।

লুভ বা প্রাদো বা অন্যান্য জগদ্বিখ্যাত মিউজিয়ামে কোনো বাঙালি শিল্পীর ছবি তো দূরের কথা, এশিয়ান কোনো শিল্পীরই ছবি নেই। শিল্পকলার ইতিহাস কারা রচনা করেছে? ইউরোপিয়ানরাই। ফলে এক ধরনের বৈষম্য বা পক্ষপাতিত্ব তো রয়েছেই। আফগানিস্তান তালেবানরা বুদ্ধের যে ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলল সে সম্পর্কে আমরা কি অবগত ছিলাম? তৃতীয় বিশ্বের শিল্পীদের তাত্পর্যপূর্ণ সব সৃষ্টিকর্ম আছে যেগুলো ওদের কাছে গুরুত্ব পায়নি কোনোদিন। জাপানের শিল্পী মাতা বর্তমানে আছে সাউথ আমেরিকায়। কোয়েবার, তলেদো—এরা প্যারিসে দীর্ঘদিন শিল্পচর্চা করেছে বলে ইউরোপিয়ান সমালোচকরা আর তাদের বাদ দিতে পারেনি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাঙালি শিল্পী অনিশ কাপুর, যিনি জন্ম অবধি আছেন ব্রিটেনে—তাকে ব্রিটিশ বলাই সঠিক। একমাত্র তিনিই একটা জায়গা করে নিয়েছেন বহির্বিশ্বে। গ্যালারিতে না, মিউজিয়ামে তার প্রদর্শনী হয়। আমারই সমসাময়িক শিল্পী তিনি। কিন্তু প্রচার-প্রসারে আমার চেয়ে বর্তমানে এগিয়ে আছেন এই শিল্পী। ওয়াশিংটন বা লন্ডনের বড় বড় মিউজিয়ামের আর্ট লাইব্রেরিতে আমার ছবি থাকলেও সেসব তো পাবলিক শোয়ের জন্য নয়। আগ্রহী দর্শকরা সেই শিল্পকর্ম দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অনিশ কাপুরের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক যে, বিশ্বের যত গ্যালারিতে আমার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে, যত দেশে প্রদর্শনী করেছি—সম্ভবত আর কোনো বাঙালি শিল্পীর পক্ষে ততখানি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। আমি সুযোগ খুঁজেছি, তৈরি সুযোগকে কাজে লাগিয়েছি। সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর