বহুদিন পরে আবার ডায়েরি লিখতে শুরু করেছি আজ থেকে। গত বছর কয়েক মাস রোজনামচা লিখেছিলাম ওর প্রেরণায়। আমার ডায়েরি লেখা উচিত এ-কথা সে আমাকে বার বার বলেছে। কেন আমি এতকাল লিখিনি, এই প্রশ্ন বহুদিন করেছে আমাকে। আলসেমির জন্যই লিখিনি, লেখার তাগিদ অনুভব করিনি ইত্যাদি জবাব দিয়েছি ওকে। সে সন্তুষ্ট হয়নি। এবারও ডায়েরি লিখতে নিজেকে বাধ্য করেছি ওর অনুরোধে। জানি আমার এই পরিণামহীন শব্দাবলী কারও কোনো কাজে লাগবে না, এসবের কোনো স্বাধীন মূল্য আছে বলেও মনে করি না। একজনের মন রক্ষায় আমার এই অর্থহীন প্রয়াস।
কদিন ধরে ভীষণ গরম পড়েছে। এই গায়ে জ্বালা-ধরা তাপ আরও একমাস স্থায়ী হবে— এই ভবিষ্যদ্বাণী আবহাওয়া অফিসের। ভাবলেই আরও বেশি গরমবোধ করি সারা শরীরে। এই বেয়াড়া তাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে বিদ্যুতের লুকোচুরি। পাখা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায়, ঘাম ঝরে দরদর করে।
আজ ওর সঙ্গে বেশি কথা হয়নি। সকালের দিকে লোকজন এলে আমার অসুবিধা হয়। ছিন্ন হয় ওর সঙ্গে যোগাযোগ। আমার মেজাজটাই খিচড়ে যায়। কিন্তু হাসি মুখে অতিথিদের স্বাগত জানাই। আমাদের দেশে আগে থেকে ইত্তেলা না দিয়ে চলে আসাটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে এক ধরনের অস্থিরতা নিয়ে আছি, একটা বেদনাবোধ ঘুরে ঘুরে একা একা কথা বলছে সেই সঙ্গে একান্ত নিভৃতে। ওর অভিমান এবং যন্ত্রণা আমাকে স্পর্শ করে গভীরভাবে।আজকের প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রধান খবর ঢাকার খিলক্ষেত রেলক্রসিংয়ের কাছে ট্রেন দুর্ঘটনা। মহানগর ঊর্মি ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাশের বিলে পড়ে যায়। ফলে সাত যাত্রী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন শতাধিক। ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিল। দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। কেউ কেউ ত্রুটিপূর্ণ স্লিপারের কথা বলেছেন, কেউ কেউ আবার সাবোটাজের কথাও উল্লেখ করেছেন। কারণ যা-ই হোক, কয়েকটি মূল্যবান প্রাণ বিনষ্ট হলো এই ট্রেন দুর্ঘটনায়।
ছাপার শীতল হরফে আমরা সাত ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পড়লাম। কিন্তু এসব শীতল অক্ষরের আড়ালে রয়েছে হাসি-কান্না জড়ানো অনেক কাহিনী। গৌরীর কাছেই শুনলাম ওর এক বন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সদ্য বিবাহিত এক চটপটে যুবকের কথা। যুবকটি তার মৃত পিতাকে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্তানে কবর দিয়ে সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে ঢাকা ফিরছিল। বাড়ি পৌঁছার আগেই অপঘাতে মৃত্যু হলো ওর। সেই না-দেখা তরুণ আর তার বিচ্ছেদকাতর পরিণীতার জন্য শোকার্ত হলাম। কেন এমন হয়? কত ট্র্যাজেডি ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে, আমরা খোঁজ রাখি না, জানতে পারি না। আমার মধ্যে যে বেদনা, যন্ত্রণা ও হাহাকার রয়েছে তা-কি আমার কাছের মানুষেরা টের পায় কখনো। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে সব হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস, আর্ত অনুভূতিমালা সমাহিত হবে, কেউ জানবে না। জানলেই বা কী লাভ? বরং সে সব জ্ঞাত হওয়া মানেই বিড়ম্বনা, উপহাস।
আজ গৌরীর সঙ্গে কথা বলা গেল অনেকক্ষণ। নিরবচ্ছিন্ন এই আলাপে মন শরতের আকাশের মতো হয়ে গেল, আমি আমার মধ্যে স্নিগ্ধ রোধ, কয়েকটি দূরগামী পাখির ঝলসানি, সরোবরের টলটলে জল, সোনার ঘণ্টার ধ্বনি অনুভব করলাম। কথা শেষ হলে মনের ভিতর যে-স্তব্ধতার জন্ম হয় তা হয়ে ওঠে ভিন্ন কোনো সংলাপের শব্দহীন আলোড়ন। সেই স্তব্ধতা হৃদয়কে জাগিয়ে রাখে, হৃদয় হয়ে ওঠে অনন্তমুখী।
সন্ধ্যেটা কাটল সুন্দর এক স্বপ্নের মতো।
দুপুরে বৃষ্টি এলো অনেকগুলো ঘোড়ার সুর বাজিয়ে। দুঃসহ গরমে এই বৃষ্টি করুণা ধারার মতোই। ইচ্ছে হলো ঘরের বাইরে ছুটে গিয়ে বৃষ্টিধারায় স্নাত হই। গাছগুলোকে খুব সুখী মনে হলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রৌদ্রদগ্ধ ছিল ওরা, একটি পাতাও নড়েনি বহু ঘণ্টা। এখন ওরা নেচে উঠেছে আনন্দে, ওদের গা বেয়ে পড়ছে পানি। গৗরীর কথা মনে পড়ল। সে বৃষ্টি খুব ভালোবাসে। বৃষ্টি তাকে কখনো ক্লান্ত করে না।
অনেকক্ষণ থেকে ইলেকট্রিসিটি গায়েব। লোডশেডিং চলছে। বৃষ্টি না এলে এই একরোখা অত্যাচারী গরমে কী হতো ভাবলেও গায়ে জ্বালা ধরে। গৌরী এখন কী করছে? সে কি সোফায় গা এলিয়ে কোনো বই পড়ছে না কি গান শুনছে? কল্পনা করতে ভালো লাগে। ঘরে বসে আছি। আমার দৃষ্টি জানালার বাইরে ছড়ানো। হঠাৎ নয়না এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। ঘুম থেকে উঠে এসেছে সে, ওর হাতে এক পিস কেক। কেক খেতে খেতে সে প্রশ্ন করে, ‘দাদাভাই, তুমি কী ভাবছো? কী দেখছো?’ বিস্মিত হয়ে ওর দিকে তাকালাম। পাঁচ বছরের শিশুর পক্ষে প্রশ্নটি অসাধারণ। আমি ওর প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে না পেরে চুপ করে রইলাম। পরে বললাম, ‘তোমার কথা ভাবছি, এই গাছগুলোকে দেখছি।’ আমার উত্তর কী ঠিক ছিল?
প্রায় চার বছর পর অভিনেতা আলমগীরের স্ত্রীর বাসায় গেলাম জোহরা এবং আমি। আলমগীরের সঙ্গে খোশনূরের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে সম্প্রতি, এ খবর আমার অজানা ছিল। শুনতে পেলাম বেতার বাংলার সালাহউদ্দিনের কাছে। খবরটি শুনে খারাপ লাগল। একটি সংসার ভেঙে গেলে কার না দুঃখ হয়? আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল খোশনূরের ছেলেমেয়ের মুখ। খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত ওরা। বিশেষ করে তুলতুলের কথাবার্তা ও আচরণের মধ্যে সজীবতা এবং আন্তরিকতা সুপরস্ফুিট। সে যা ভাবে তা-ই বলে ফেলে, কোনো কিছু আড়াল করে না। অন্তত চার বছর আগে আমার তা-ই মনে হয়েছিল।
এবার এই ভাঙা পরিবারটিকে দেখে কষ্ট হলো। আমি আমার স্বভাব অনুযায়ী খুব কম কথাই বললাম। সামান্য দু-চারটি বাক্য উচ্চারণ করে বেশিরভাগ সময় নিশ্চুপ ছিলাম। খোশনূর, মনে হলো, তেমন মুষড়ে পড়েননি, যদিও একবার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কথাটা অবিশ্যি আলমগীরকে কেন্দ্র করেই। এবারও আমাদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হলো না। তুলতুল একগুচ্ছ রজনীগন্ধা দিয়ে স্বাগত জানাল আমাকে, জোহরাকে। ওর মাকে জোহরাও আলিঙ্গন করে পাশে বসিয়ে গল্প করলেন অনেকক্ষণ। ওর ছেলে, আলমগীরের চেয়েও লম্বা, অনেকগুলো ছবি তুলল আমাদের সবার। তুলতুল আমার সঙ্গে আলাদাভাবে ছবি তোলার আগ্রহ প্রকাশ করল চার বছর আগের মতোই। আঁখি গান শোনাল ওর মধুর কণ্ঠে।
খোশনূরের পাঠানো মোটরকারেই ওদের উত্তরার বাসায় গিয়েছিলাম, ফিরেও এলাম একইভাবে। খোশনূর এবং তার ছেলেমেয়ের কল্যাণ হোক। আলমগীরের প্রতি কেন জানি বিরূপ হতে পারিনি। মনের জগতের আনাচে-কানাচে এত কিছু ঘটে, এত রহস্য জমে ওঠে যে চট করে কোনো মানুষ সম্পর্কে সব কিছু না জেনে কোনো রায় দেওয়া সমীচীন নয়।
সকাল এগারোটায় বাংলা একাডেমিতে গেলাম অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের স্মরণসভায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আমি স্মরণসভার সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই মোহাম্মদ নোমানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। বন্ধু আশরাফ আলীর উদ্যোগেই মোহাম্মদ নোমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। ওরা দুজন একই ক্লাসে পড়তেন। দুজনই আজ মৃত। মোহাম্মদ নোমান একজন খাঁটি সজ্জন ছিলেন। এই স্বল্পভাষী অথচ হৃদয়বান মানুষটির সাহচর্য ভালো লাগত আমার। তিনি আমার কবিতার অনুরক্ত পাঠক ছিলেন এবং আমার কবি জীবনের আদিপর্বের কবিতাবলীর তারিফ করতেন সুনিশ্চিত ভাষায়। উৎসাহিতবোধ করতাম এই রোমান্টিক, প্রেমিক মানুষটির আলোচনা শুনে। তিনি নিজেও একটু-আধটু কবিতা লিখতেন। একবার আমাকে তার একটি কবিতা শুনিয়েও ছিলেন, মনে পড়ে। মোসলেমা খাতুনকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এই স্নিগ্ধ, রুচিশীল ব্যক্তিটির বিবাহিত জীবন সুখময় ছিল।
দুপুরে বাড়ি ফিরে এলাম। আজকের দুপুর ও বিকাল কাটল গৌরীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে। ওস্তাদ বেলায়েত খাঁর সেতারের সুরের মতো কেটে গেল সারা দুপুর এবং বিকালের কিয়দংশ। গৌরীর সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল আমরা দুজন রমণে লিপ্ত। সংলাপও যে কখনো কখনো সঙ্গমতুল্য হয়ে ওঠে, আজ প্রথম অনুভব করলাম।
সন্ধ্যেবেলা জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত ঋত্বিক ঘটক বিষয়ক সেমিনারে অংশ নিলাম সভাপতি হিসেবে। মূল প্রবন্ধ পাঠ করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। সমৃদ্ধ, সুলিখিত প্রবন্ধ। আলোচনা করলেন তানভীর মোকাম্মেল এবং জাহিদুর রহিম অঞ্জন। এই দুজনের আলোচনা শুনে মনে হলো, আমাদের এখানকার চলচ্চিত্র-সমালোচনা অত্যন্ত পরিণত এবং ধনী।
পারভিনের মেয়ে আদিবার জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখলাম। আদিবার জন্মদিনে কবিতাটি উপহার দিলাম। এই উপহার পেয়ে আদিবা, ওর মা পারভিন এবং বাবা মকবুল হোসেনের মন আনন্দে ঝলমল করে উঠল জন্মদিনের আসরের মতোই। অনেক অতিথি এসেছিলেন। পারভিনের পিতা-মাতা, ভাই এবং বান্ধবীরা এসেছিলেন। আদিবার বান্ধবীদেরও উত্ফুল্ল সমাগম হয়েছিল। দুজন সচিব এসেছিলেন সস্ত্রীক।
পারভিনের বাবা ক্রীড়া জগতের নানা খুঁটিনাটি জানেন। এই বয়সেও ক্রিকেটের ধারা বিবরণী শোনেন, মন দিয়ে টেলিভিশনে দেখেন দেশ বিদেশের খেলা। যৌবনে ক্রিকেট এবং টেনিস দুটোতেই বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন। এখন তিনি আশি ছুঁই ছুঁই। তবে বয়স তাকে পরাজিত করতে পারেনি। একটু-আধটু শারীরিক অসুবিধা আছে, বড় রকমের কোনো ব্যাধি তাকে কব্জা করতে পারেনি। তার স্বাস্থ্য আমার চেয়ে ঢের ভালো এখনো। আমার আব্বার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল, যদিও তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।
পারভিনকে আজ অন্যরকম মনে হচ্ছিল। ওর সাজে কোনো আতিশয্য ছিল না, ছিল উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য। ভালো লাগছিল দেখতে। ওর চেহারা স্নিগ্ধ সুন্দর।