শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
সা ক্ষা ৎ কা র

তোমারে লেগেছে এত যে ভালো

খ্যাতিমান গীতিকার কে জি মোস্তফার জন্ম ১ জুলাই ১৯৩৭ সালে নোয়াখালী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি লিখেছিলেন ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে এই গান আজও জনপ্রিয়। গুণী এই গীতিকার, কবি ও সাংবাদিক একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। বর্তমানে জাতীয় প্রেস ক্লাব সদস্যদের মাসিকপত্র ‘কবিতাপত্র’-এর সম্পাদক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

তোমারে লেগেছে এত যে ভালো

ছবি : জয়ীতা রায়

আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। কেমন ছিল সে সময়ের পরিবেশ?

 

আমি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আমাদের সময়ে বাংলা বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগে অত্যন্ত কীর্তিমান শিক্ষক ছিল। তাদের রুচি, পাণ্ডিত্য, পরিচিতি, মূল্যবোধ ছিল অনুকরণীয়। আমাদের সময় বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই। তিনি বিশিষ্ট শব্দবিজ্ঞানী। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. কাজী দীন মুহম্মদ, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। তারা এক একজন ছিলেন স্টার। তারা আমাদের ক্লাসে পাঠদানের মধ্যে জ্ঞানচর্চা সীমাবদ্ধ রাখতেন না বরং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মতত্পরতার মাধ্যমে জড়িত থাকতে উৎসাহিত করতেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যচর্চার সুন্দর পরিবেশ ছিল। বাংলা বিভাগের উদ্যোগে প্রতি মাসে নতুন লেখকদের লেখা নিয়ে একটি সাহিত্য আসর বসত। বাংলা বিভাগের সাহিত্য সমিতির আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। অধ্যাপক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন সভাপতি। তিনি আমার দুই বছরের সিনিয়র। তখন নামি লেখক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ডাকসুর উদ্যোগে একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতা হতো। সে বছর কবিতা লিখে আমি প্রথম হলাম। শরীফ স্যার ছিলেন ওই প্রতিযোগিতার বিচারক। তিনি ক্লাসে এসে বলতেন, কবিয়াল কই? স্যার ঠাট্টা করতেন। ছাত্রাবস্তায় এই যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা, আজকে তো চিন্তাই করা যায় না। আমার শিক্ষকদের নিয়ে এখনো গর্ববোধ করি। আমাদের শিক্ষকরা পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়ার পাঠ দিতেন।

 

 

সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন কখন?

আমি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। তখন আবুল বাশার নামে আমার এক বন্ধু বললেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করি। তারই উৎসাহে দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৫৮ সালে শিক্ষানবিস সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। আমার কাজ ছিল টেলিপ্রিন্টারে যেসব নিউজ আসত তার বঙ্গানুবাদ করা। লেখা ছাপা হলে আমি খুব গর্ব অনুভব করতাম। পরবর্তীতে পাকিস্তানের ফিরোজ খান নূনের উদ্যোগে দৈনিক মজলুম প্রকাশ হলে আমি সহ-সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পাই। ১৯৬৮ সালে তিনশ টাকা বেতনে সাপ্তাহিক জনতায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পাই। তখন ঢাকা শহরে থাকতে আমার খরচ হতো মাত্র ৬০ টাকা। ১৯৭০ সালে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা কফিলউদ্দীন চৌধুরীর প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করি।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঢাকাতেই ছিলাম। মগবাজারের একটি মেসে আমরা চারজন থাকতাম। কবি আবুল হাসান, শাহাজান চৌধুরী, আমি এবং সংবাদে চাকরি করত আমাদের এক বন্ধু (নামটা মনে করতে পারছি না)। কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার পাশের বাড়িতে থাকতেন। রেডিওতে যেতাম নিয়মিত। একদিন রেডিওর কর্মকর্তা মোবারক হোসেন খান আমাকে দেখেই মুখ কালো করে ফেললেন। তিনি তার অফিসারদের তুলে দিয়ে আমাকে গোপনে জানালেন, তুমি আজই জায়গা বদল কর। সেদিনই জায়গা পাল্টে পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে আশ্রয় নিলাম। তখন আমি ও পরিচালক আমজাদ হোসেন আটার ব্যবসা করতাম। নয় মাস খুব কষ্ট করেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের জীবন পাল্টে দিল।

 

স্বাধীনতার পর কোথায় কাজ করতেন?

স্বাধীনতার পর দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক স্বদেশ পত্রিকায় চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করি। কূটনৈতিক প্রতিবেদক ছিলাম দৈনিক জনপদে। নূপুর নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক প্রথম শ্রেণির রেডিও সার্ভিসের জন্য মনোনীত হয়েছিলাম কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য যোগ দিতে পারিনি। ১৯৭৬ সালে বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারভুক্ত হয়ে যোগ দেই সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরে সহকারী সম্পাদক হিসেবে। সেখানে ‘নবারুণ’, সাহিত্য মাসিক ‘পূর্বাচল’, সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ সময়’, ‘সচিত্র বাংলাদেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এখানে পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে সম্পাদক এবং পরে সিনিয়র সম্পাদক পদে উন্নীত হই। সেখানে আনন্দের সঙ্গে কাজ করেছি। অবসরে গেলাম ১৯৯৬ সালে।

 

গান লিখতে শুরু করলেন কখন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রিকায় আমি ছড়া, কবিতা লিখতাম। ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাকে ভীষণ সমালোচনা করতেন। তিনি সব সময় বলতেন, ‘তোমার কিছুই হচ্ছে না। কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ তারপর এখন কবি কে জি মোস্তফা।’ স্যার, আমার মন খারাপ করে দিতেন। একদিন আমার প্রতি তার মায়া হলো এবং তিনি আমাকে ডেকে নিলেন তার কক্ষে। তিনি বললেন, ‘তোমার লেখার মধ্যে একটা গীতিময়তা আছে। তুমি গান লিখলে বোধ হয় ভালো করবা।’ সেদিন আমার স্বপ্নের বীজ বপন হয়। তখন সিরিয়াসলি ভারত ও বাংলাদেশের বাংলা গান শুনতে শুরু করলাম। কাঁচা হাতে কিছু গানও লিখলাম। তখন আমার বন্ধু মোস্তফা জামান আব্বাসী, সৈয়দ আবদুল হাদী, খন্দকার নুরুল আলম, কাজী আনোয়ার হোসেন, ফেরদৌসী বেগম, নাজমুল হুদা বাচ্চু, খন্দকার ফারুক আহমদ আমার গান নিয়ে সুর করে গাইতে শুরু করলেন। তখন একমাত্র মিডিয়া ছিল রেডিও। সেখানে আমার গান প্রচার শুরু হলো, এতেই আমি ভীষণ আনন্দিত। 

 

‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ এই গানটি আপনি কখন লিখেছিলেন?

১৯৬০ সালে এহতেশাম ‘রাজধানীর বুকে’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন। রবীন ঘোষ ছিলেন সুরকার। তারা চাচ্ছিলেন একজন তরুণ গীতিকারকে দিয়ে গান লেখাবেন। উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদকে দিয়ে দুটো গান করাবেন। অভিনেতা আজিম আমার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। আমরা গুলসিতায় আড্ডা দিতাম। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। তারপর আমি বরীন ঘোষের ওয়ারির বাড়িতে গেলাম। সিনেমার গান লেখার টেকনিক আমি জানতাম না। সেখানে গিয়ে জানলাম, সিনেমায় আগে সুর হয় তারপর আমাকে কাহিনী বলে দেবে এবং সে অনুযায়ী গান লিখতে হবে। আমি তো অবাক। শখের বসে দু-চারটা গান লিখেছি, বন্ধুরা গায়— এখানে দেখি সব উল্টো। নার্ভাস হয়ে গেলাম। রবীন ঘোষ হারমোনিয়ামে সুর তুলছেন আর আমাকে কাহিনী বলছেন। আমি বললাম, ভাই আমি এসবের কিছুই বুঝি না। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল মানুষ। আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, তুমিই পারবে। এদিকে রাত ৮টা বেজে গেছে— ১০টার মধ্যে ফজলুল হক হলে ফিরতে না পারলে শাস্তি হবে। তখন আমি কবিতার ছন্দে দুটো লাইন লিখলাম—‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো/চাঁদ বুঝি তা জানে।’ রবীনদা, কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে পড়ে বললেন, গানের মুখ হয়ে গেছে। এর মধ্যে এহতেশাম এবং শিল্পী তালাত মাহমুদ তার বাড়িতে এলেন। তাদের চা, নাস্তা দেওয়া হলো। রবীনদা আমার লেখা কাগজটি এহতেশাম সাহেবকে দিয়ে বললেন, দেখ তো গানের মুখটা হয়েছে কিনা? এহতেশাম কোনো কিছু চিন্তা করবার সময় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল মুখে চেপে রাখতেন। আমি ধরে নিলাম, আমার গান পছন্দ হয়নি। হঠাৎ তিনি আমাকে বললেন—‘শালা’ তুই এদ্দিন কোথায় ছিলি। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তালাত মাহমুদকে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি উর্দুতে বললেন, বোম্বেতে এর মতো আনস্মার্ট একজন গীতিকার আছে। সেও খুব ভালো লেখে। তখন মনের মধ্যে সাহস ফিরে আসে। সারা রাত জেগে ওই গানটি লেখা শেষ করি। ভোরবেলা রবীন ঘোষ তার গাড়িতে বসিয়ে আমাকে নিয়ে বের হলেন। গুলসিতানে এসে আমরা মাঠা খেলাম। তিনি বাড়িতে চলে গেলেন আমি হলে ফিরলাম। গানটি একটি ইতিহাস হয়ে গেল। তারপর বহু সিনেমায় গান লিখেছি।

 

সাম্প্রতিক সময়ের গীতিকবিতার গুণগতমান নিয়ে আপনার মতামত কী?

সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কিছু কিছু গানে যুব সমাজের চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। তবে এগুলোকে বলা যেতে পারে ঝাঁঝালো সুরে বলা কথা। আগামী দিনের শ্রোতাদের কাছে যদি এ গান বেঁচে থাকে, তবে তা এক সাংঘাতিক সাংস্কৃৃতিক বিপর্যয় হয়ে থাকবে। আমাদের সংগীত এবং সাহিত্যকর্মে আমরা আধুনিক থাকব, তবে সেই সঙ্গে আমাদেরকে ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং বস্তুবাদী উন্নয়নের কারণে সাহিত্যের জনপ্রিয়তা কমছে বলে কেউ আশঙ্কা করেছেন। ইলেট্রনিক্স মিডিয়ায় টিভি-ইন্টারনেট এগুলো আমাদের মানসিকতাকে রাহুগ্রস্ত করে তুলেছে। কিন্তু সাহিত্যকর্ম ছাড়া মানুষের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি, আত্মসচেতনতা, আত্মোপলব্ধি তৈরি হয় না। মানুষ যন্ত্রদানবে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। যার পরিণামে মনুষ্যত্ববোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানবিক গুণ হারিয়ে যেতে পারে। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার কাছে মানুষ হার না মানুক, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার ফুল ফুটুক, লেখক ও পাঠকের বন্ধন ও মুক্তি একই সঙ্গে সূচিত হোক— এটাই আজকের দিনের সচেতন মানুষের কাম্য।

 

শেষ কবে গান লিখেছেন?

বছর তিনেক আগে পাকিস্তানের এক বাঙালি শিল্পী আলমগীরের জন্য গান লিখেছি। সে গানটি হলো ‘সব কথা সব সুর একদিন ঝরে যাবে।/ পৃথিবী তোমার কাছে রেখে গেলাম শেষ গানখানি।’ সম্প্রতি মামুন জাহিদ আমার গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করছে।

 

আপনার গানের কোনো সংকলন বের হয়েছে?

আমি মনে করি, সংগীত একটি জাতির আত্মার পরিচয়। কিন্তু আমার অনেক গান আজ হারিয়ে গেছে। সব গান সংকলন করা সম্ভব হয়নি। কবিতার বই বের হয়েছে সাতটি, গানের বই দুটি, ছড়ার বই তিনটি, চারটি গদ্যগ্রন্থ এবং চারটি গানের সিডি ও অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। অচিরেই আরও দুটো বই বের হবে।

 

এখন কীভাবে সময় কাটান?

আমি তো দীর্ঘদিন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করি। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ঘরে বসে না থেকে হোমিওপ্যাথি অনুশীলনে মন দেই। প্রেস ক্লাবের সদস্য। এখানে এই ছোট্ট কক্ষে বসে চিকিৎসা, লেখালেখি, আড্ডা দিয়ে সময় পার করি।

সর্বশেষ খবর