ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে, সঙ্গে প্রবল দমকা হাওয়া, এর মধ্যে একটা ভুল হোটেলের সামনে আমাকে একা দাঁড় করিয়ে রেখে ট্যাক্সিচালক চলে গেছে। চালকের নাম সাঈদ। মরক্কোর মানুষ, তবে তেত্রিশ বছর ধরে সুইডেনে বাস তার। ট্যাক্সি চালাতে চালাতে অনেক গল্প করছিল সে। ‘ওহ্ বাংলাদেশ! কান্ট্রি অব ফ্লাড! ওয়াটার এভরি-হয়ার’— এই হলো বাংলাদেশ সম্পর্কে সাঈদের প্রাথমিক জ্ঞান। পথে আসতে আসতে সে আমাকে সুইডেনের পার্লামেন্ট ভবন, নোবেল প্রাইজ বিতরণের হল, নোবেল বিজয়ীদের গ্র্যান্ড ডিনারের হোটেল, ওদের শহরের সবচেয়ে বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আরও কত কী দেখাতে লাগল! প্রায় এক ঘণ্টার ঝকঝকে মসৃণ রাস্তা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সি এসে পৌঁছাল গামলা স্থানে, যেখানে আমার জন্য হোটেল ঠিক করে রেখেছে সুইডিশ ইনস্টিটিউট। গামলা স্থান স্টকহোমের পুরনো শহর। পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় স্থান। ১২৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ শহরটিকে সুইডিশরা রেখে দিয়েছে অবিকল আগের মতোই। প্রাচীন দালান, সরু পাথর বসানো রাস্তা, চিকন গলি, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে আর স্যুভেনিরের দোকান রয়েছে এখানে, গামলা স্থানে হেঁটেই চলাচল করতে হয়, কোনো গাড়ি ঢোকে না এখানে।
এয়ারপোর্ট থেকে যখন ট্যাক্সিতে চড়েছিলাম, তখন দিব্যি রোদ্দুর ছিল, এখন যখন নামলাম তখন দেখি বেশ বৃষ্টি, সাঈদ মূল রাস্তায় ট্যাক্সি থামিয়ে কিছুদূর হেঁটে এগিয়ে দিল আমায়, আঙ্গুল তুলে বলল, ওই যে দালানটা দেখছ, ওটাই তোমার হোটেল। ওর নির্দেশনা অনুযায়ী এসে দেখছি এটা আমার হোটেল নয়। কাগজপত্র দেখে রিসিপশনের মিষ্টি মেয়েটি হাসিমুখে একটা ম্যাপে দাগ কেটে বলে দিল, মাত্র দুটো রাস্তা পেরুলেই নাকি আমার আসল হোটেলটা পেয়ে যাব। ফলে ওই বৃষ্টিতেই পিঠে ব্যাকপ্যাক, হাতে একটা ট্রলি আর একটা ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে আমি এ রাস্তা থেকে ও রাস্তায় লর্ড নেলসনকে খুঁজতে থাকলাম, কারণ তার নামেই হোটেলের নাম। দুজন ফরেনারের সঙ্গে কথা হলো, তারা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল কোথায় যেতে হবে। কিন্তু আমার তো দিকভ্রম করার ব্যারাম আছে, প্রায়ই ডান বাম আর উত্তর-দক্ষিণ গুলিয়ে ফেলি। ফলে আবারও আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। বাদামি গায়ের রং, মাথার ছোট ছোট চুলে জেলমাখা ছেলেটা হাসিমুখে বলল, ‘বাংলাদেশ থেকে আসছেন? আমিও তো বাংলাদেশি।’
তারপর দেশি ভাই নিজ দায়িত্বে আমার ব্যাগ নিজেই টেনে লর্ড নেলসন হোটেলে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে তবে ক্ষান্ত হলো। পরদিন সকালে মানি এক্সচেঞ্জে ডলার ভাঙাতে গেছি, কী আশ্চর্য, দেখি কাউন্টারে বসা ছেলেটা আমার সঙ্গে দিব্যি বাংলায় কথা বলা শুরু করেছে। সুইডেনে বর্তমানে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ হাজার বাংলাদেশি বাস করে। বেশিরভাগই স্টুুডেন্ট ভিসায় আসে, তারপর ধীরে ধীরে তাদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ মেলে। অনেকেই এখানে বেশ প্রতিষ্ঠিত। বাড়ি, গাড়ি করে দিব্যি আছেন, বাকিরা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত।৩ আগস্ট সকালে হোটেল লবিতে দেখা হলো আমার হোস্ট সুইডিশ ইনস্টিটিউটের মিডিয়া রিলেশন ম্যানেজার ইতালিয়ান মেয়ে লিভিয়া পডেস্টার সঙ্গে। একে একে পরিচিত হলাম, অন্য দেশ থেকে আসা সাংবাদিকদের সঙ্গেও, ভিয়েতনামের লাম ফাম তুং ও বুই কুওক লাপ, কসভোর গেজেটা এক্সপ্রেসের সাংবাদিক আর্তান হারাকিজা, রাশিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক বেলা র্যাপোর্ট ও কেসনিয়া লিনোভাসহ মোট ১২ জনের দল। হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে সুইডিশ ইনস্টিটিউটের অফিসের দিকে যেতে যেতে কথা হলো জিম্বাবুয়ের সাংবাদিক ডেফনি জেনার সঙ্গে। ডেফনি বলল, ক্রিকেটের ভক্ত না হলেও বাংলাদেশিরা যে ওর দেশে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল তা সে জানে। আমাদের প্রথম মিটিং ছিল ভিজিট স্টকহোম প্রোগ্রামের সাবিন ডুবরেইলের সঙ্গে। তিনি জানালেন, নরডিক দেশগুলোর মধ্যে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের জায়গা সুইডেন। দেশ হিসেবে সুইডেনের শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও খোলা মনের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলেন তিনি। শুধু নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্যই নয় বরং সব ধরনের জাতি-গোষ্ঠী এমনকি যৌন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি প্রদান ও মানবাধিকার রক্ষায়ও তত্পর দেশটি। ভিজিট স্টকহোম, দেশটির অফিসিয়াল পর্যটন প্রচার সংস্থা। সুইডেনে বৈদেশিক পর্যটন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কাজ করেন তারা।
জানলাম, ১৭৩ হাজার বর্গমাইলেরও বেশি আয়তনের দেশ সুইডেনে লোকসংখ্যা টেনেটুনে মাত্র এক কোটি, যেখানে আমাদের ছোট্ট একটা শহর ঢাকাতেই প্রায় দুই কোটি লোক বাস করে। যেখানে মাত্র ৯৯ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে সুইডেন ইউরোপের অন্যতম কম জনসংখ্যার দেশ। জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত ছোট্ট আয়তনের বাংলাদেশের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। সুইডিশ ইনস্টিটিউট আমাদের জন্য অনেকগুলো সেশনের আয়োজন করেছিল। এর মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী সেশন ছিল অলিকা প্রকাশনী সংস্থার প্রতিনিধি কারিন স্যামসনের সঙ্গে আলাপচারিতা।
সুইডিশ ভাষায় অলিকা মানে ভিন্ন বা আলাদা। অলিকা শিশুদের জন্য সুইডিশ ভাষায় ভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করে থাকে। তারা মনে করে মেয়ে এবং ছেলে শিশু দুজনেরই বৈচিত্র্যপূর্ণ বই পড়া উচিত। যাতে শিশুরা উপলব্ধি করতে পারে, শুধু লিঙ্গগত পার্থক্যের কারণে কারও জীবন ও কাজ সীমাবদ্ধ হতে পারে না। অলিকা প্রকাশিত বইগুলো বালক-বালিকাদের ব্যক্তিত্বের ভিন্ন ধরন সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। যেমন, সাধারণভাবে মনে করা হয়, মেয়েরা হবে আবেগপ্রবণ, নিষ্ক্রিয়, মিষ্টি, সুন্দরী, অন্যদিকে ছেলেরা থাকবে শক্তিশালী, সাহসী, রাগী, লম্বা ইত্যাদি। আবার মেয়েরা থাকবে ঘরে আর ছেলেরা দাবড়ে বেড়াবে বাইরের পৃথিবী।
কারিন সালমান তার প্রেজেন্টেশনে সুইডেনের সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রবিষয়ক মন্ত্রী এলিস বাহ কুনকের একটা বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। সুইডেনের প্রাইড পার্কে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম আমরা। সেখানে দেখা হলো দাগেস্থানের মেয়ে রোকসানার সঙ্গে, ওকে দাগেস্থানি লেখক রসুল গামজাতভের কথা বলতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ। ‘তুমি জান তার নাম? কী আশ্চর্য! পড়েছ তার বই?’ বললাম বাংলা ভাষায় তার ‘আমার জন্মভূমি’ বইটি অনূদিত হয়েছে। রোকসানা হাসিমুখে বলল, ‘তোমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাই আমি, কারণ এই প্রথম বাংলাদেশের কারও সঙ্গে দেখা হলো আমার। তা ছাড়া তুমি আমার দেশের একজন সম্মানিত লেখকের বই পড়েছ।’
সুইডিশ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে নির্মিত স্টকহোমের সেন্ট জর্জ চার্চে। সেখানে পরিচিত হলাম নারী প্যাস্টর ক্রিস্টিনা লজুনগ্রেইনের সঙ্গে। স্টকহোমে সংক্ষিপ্ত সময়েই পরিচয় হয়েছে এরিকসনের আইটি কনসালটেন্ট হেদায়েতুল ইসলাম শেলী ও তার স্ত্রী ডা. মুন ইসলামের সঙ্গে। এক সকালে তাদের সঙ্গে ঘুরতে গেলাম বিখ্যাত ড্রোটিংহোম প্যালেসে। ড্রোটিংহোম হচ্ছে সুইডেনের রানীর প্রাসাদ। মূলত সুইডিশ রাজকীয় পরিবারের ব্যক্তিগত বাসস্থান এটি। ১৭ শতকে এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। যে কটা দিন স্টকহোমে ছিলাম, বেশিরভাগ দিনই চলাচল করেছি মেট্রোতে, বাসে আর হেঁটে। কর্তৃপক্ষ গণপরিবহন ব্যবহার করতেই উৎসাহিত করে নাগরিকদের। প্রাইভেট কার ব্যবহারকারীদের টোল পরিশোধ করে শহরে চলাচল করতে হয়। ফেরার দিনও এয়ারপোর্টে এলাম ট্রেনে, শহর থেকে মাত্র বিশ মিনিটে এক্সপ্রেস ট্রেন পৌঁছে দিল এয়ারপোর্টের সিঁড়িতে। স্টকহোমকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম প্রিয় বাংলাদেশে।