শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের আদ্যোপান্ত

তানিয়া তুষ্টি

বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের আদ্যোপান্ত

স্বপ্নের স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু ১ মহাকাশ স্পর্শ করবে আজ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকাল চারটায় (বাংলাদেশ সময় ১১ মে, রাত ৩টা) মহাকাশের উদ্দেশে উড়াল দেবে। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে গত ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ এর ফ্যালকন ৯ রকেট ফ্লোরিডার কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চিং প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে নিয়ে মহাকাশের পথে উড়াল দেবে। 

এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আদ্যোপান্ত।

 

মহাকাশ জয়ে বাংলাদেশ

রচিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়ের গল্প। মহাকাশে নিজস্ব মালিকানার স্যাটেলাইট যাত্রার সব বন্দোবস্ত সমাপ্ত করেছে বাংলাদেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু ১। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হবে। উৎক্ষেপণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ সফল হলে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হবে বাংলাদেশ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ আরও বেগবান হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলাসহ যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তার নতুন মাত্রা যোগ হবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থান করা বাংলাদেশিদের মধ্যে এখন চলছে উৎসবের আমেজ। তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের একটি সরকারি প্রতিনিধি দল সেখানে অবস্থান করছে। আগামী ১৫ বছরের জন্য মহাকাশের স্থায়ী বাসিন্দা হবে ‘বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট’। বাংলাদেশ প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু করে ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনে ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। এরপর ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ এই স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে। জাতিসংঘের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্সের (ইউএনওওএসএ) হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা হয়েছে ৪ হাজার ৬৩৫। প্রতি বছরই স্যাটেলাইটের এ সংখ্যা ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এসব স্যাটেলাইটের কাজের ধরনও একেক রকমের। বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটটি বিভিন্ন ধরনের মহাকাশ যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ‘জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট’। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে এ স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহূর্তটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব কটি বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। দুর্লভ এ মুহূর্ত সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দেশের সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সও উৎক্ষেপণ মুহূর্তটি সরাসরি সম্প্রচার করবে। কেনেডি স্পেস সেন্টারের দুটি স্থান থেকে আগ্রহী দর্শনার্থীরা এই উৎক্ষেপণ দেখতে পারবেন। একটি স্থান অ্যাপোলো সেন্টার, উৎক্ষেপণস্থল থেকে দূরত্ব ৬ দশমিক ২৭ কিলোমিটার। উৎক্ষেপণের দৃশ্য কেনেডি স্পেস সেন্টারের মূল দর্শনার্থী ভবন (মেইন ভিসিটর কমপ্লেক্স) থেকেও দেখা যাবে। উৎক্ষেপণস্থল থেকে এটির দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের এ মুহূর্তের সাক্ষী হতে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কেনেডি স্পেস সেন্টারে উপস্থিত থাকবে।

 

বঙ্গবন্ধু ১ উৎক্ষেপণের ধাপ

বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট তৈরি হয়েছে ফ্রান্সের থ্যালাস এলিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিতে। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূস্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির। স্যাটেলাইটটি তৈরির পর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পর্যালোচনা ও হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের জন্য বেছে নেওয়া হয় বিশেষ কার্গো বিমান। বিমানটি কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চ সাইটে পাঠানো হয়। মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ পরিচালনা, সফল ব্যবহার ও বাণিজ্যিক কার্যত্রমের জন্য ইতিমধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কোম্পানিতে কারিগরি লোকবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। মার্কিন রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেইপ কেনাভেরালে কেনেডি স্পেস সেন্টারে স্পেসএক্সের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ নিয়ে উড়বে ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেট।

এই রকেটের রয়েছে চারটি অংশ। ওপরের অংশে থাকবে স্যাটেলাইট, তারপর থাকবে অ্যাডাপটর। এরপর স্টেজ ২ এবং সবচেয়ে নিচে থাকবে স্টেজ ১। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ ১ খুলে নিচের দিকে নামতে থাকবে। এরপর চালু হবে স্টেজ ২। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ ১ পৃথিবীতে এলেও স্টেজ ২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যাবে। উৎক্ষেপণ দেখতে আগ্রহীদের অপেক্ষা করতে হবে উৎক্ষেপণ স্থানের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে। সাত মিনিটের কম সময় রকেটটি দেখা যাবে। তার পরপরই উচ্চগতির রকেট চলে যাবে দৃষ্টিসীমার একদম বাইরে।

দুইটি ধাপে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া শেষ হবে। প্রথম ধাপটি হলো লঞ্চ অ্যান্ড আরলি অরবিট ফেইজ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে স্যাটেলাইট ইন অরবিট। এলইওপি ধাপে ১০ দিন এবং পরের ধাপে ২০ দিন লাগবে। উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে যাবে এই স্যাটেলাইট। ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ ২ খুলে যাবে। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্পট) স্থাপন করা হবে।

স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন লাগবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে। স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়।

 

স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কী

স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন বলতে সহজ ভাষায় বলা যায়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান। এই ব্যবস্থায় শূন্যে উৎক্ষেপিত বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় অবস্থান করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। তথ্যের আদান-প্রদান হয় স্যাটেলাইটের সঙ্গে পৃথিবীতে স্থাপিত কোনো আর্থ স্টেশনের। কোনো ডিভাইসের অথবা একটি স্যাটেলাইটের সঙ্গে আরেকটি স্যাটেলাইটের যোগাযোগ হয়। অর্থাৎ সাধারণভাবে যোগাযোগ বলতে আমরা প্রেরক এবং প্রাপকের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানকে বুঝি। প্রতিটি স্যাটেলাইটের জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারিত থাকে। এই সীমানার মধ্যেই স্যাটেলাইটটি ফোকাস করা থাকে এবং তার কাজের পরিসীমাও এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই সীমানাকে বলা হয় ফুটপ্রিন্ট। আবার কিছু স্যাটেলাইট তার সিগন্যালের দিক পরিবর্তন করে কাভারেজ অঞ্চল পরিবর্তনও করতে পারে। মহাকাশে নানারকম স্যাটেলাইটের অবস্থান রয়েছে। এর মধ্যে জিইও স্যাটেলাইট একটি নির্দিষ্ট গতিতে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে। এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০০ কিলোমিটার ওপরে থাকে। জিইও স্যাটেলাইটের গড় আয়ু তাই ধরা হয় ১৫ বছর। ব্যবহার করা হয় টিভি ও রেডিও ব্রডকাস্টিং, আবহাওয়ার খবর জানতে এবং পৃথিবীর টেলিফোন ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে।

এলইও স্যাটেলাইটটি ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে কাছে থেকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। হাই কোয়ালিটি টেলিফোন কমিউনিকেশন কোম্পানি এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে।

এই স্যাটেলাইট জিও স্টেশনারি এবং লোয়ার আর্থ স্যাটেলাইটের মাঝামাঝি উচ্চতায় থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা ১০০০০ কিলোমিটার। মাত্র ১২টি মিডিয়াম আর্থ স্যাটেলাইট দিয়েই পুরো পৃথিবীতে সংযোগ দেওয়া সম্ভব যা জিও স্টেশনারির চেয়ে বেশি হলেও লোয়ার আর্থের চেয়ে অনেক কম।

হম্যান স্যাটেলাইটগুলো উপবৃত্তাকার হয়। এটি মূলত জিও স্টেশনারী স্যাটেলাইট দ্বারা গন্তব্যের অরবিটে সিগন্যাল পাঠাতে ব্যবহৃত হয়।

লোয়ার আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটও এটি ব্যবহার করে।

প্রোগ্র্যাড স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিকেই ঘুরতে থাকে। এগুলোর অরবিটের সঙ্গে পৃথিবীর কোণ এক সমকোণের চেয়ে কম।

রেট্রোগ্রাড স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকে। এগুলোর অরবিটের সঙ্গে পৃথিবীর কোণ এক সমকোণের চেয়ে বেশি।

পোলার স্যাটেলাইট কেন্দ্রাভিমুখী বলের কারণে এবং সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণের কারণে ক্রমাগত স্যাটেলাইটের ক্ষতি হতে থাকে।

 

এক নজরে বঙ্গবন্ধু ১

দেশের প্রথম স্যাটেলাইটটির ওজন তিন দশমিক ৭ মেট্রিক টন। এটি মহাকাশে অবস্থান করবে ১৫ বছর। সর্বমোট খরচ ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মোট খরচে সরকারি অর্থ ১ হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং বিদেশি অর্থায়ন থাকবে ১ হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশকে এই ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। নিজস্ব কক্ষপথ ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপন করা হবে। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের পর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগবে প্রায় ২০ দিন। আমাদের স্যাটেলাইটে লেখা থাকবে বিবি এবং একটি সরকারি লোগো। বঙ্গবন্ধু ১ এর গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়। স্যাটেলাইট তৈরির পুরো কাজটি বাস্তবায়িত হয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এই কাজ হয়েছে। এগুলো হলো- স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি। বঙ্গবন্ধুু ১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে গত ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ এর ফ্যালকন ৯ রকেট ফ্লোরিডার কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চিং প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে নিয়ে মহাকাশের পথে উড়াল দেবে। স্যাটেলাইট তৈরি এবং ওড়ানোর কাজটি বিদেশে হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। আর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন।

 

বিশ্বের স্যাটেলাইট কাহিনী...

মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর উৎক্ষেপণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। উৎক্ষেপিত স্পুটনিক ১ নামের কৃত্রিম উপগ্রহটির নকশা করেছিলেন সের্গেই করালিওভ নামের একজন ইউক্রেনীয়। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক ২ উৎক্ষেপণ করে। স্পুটনিক ২ লাইকা নামের একটি কুকুর বহন করে নিয়ে যায়। অবশ্য উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে লাইকা মারা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা সফল হয় ১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার ১ এদিন মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়।

ভারতের প্রথম মহাকাশ উপগ্রহ অ্যাস্ট্রোসাট। আবহাওয়া সংক্রান্ত কৃত্রিম উপগ্রহ ভ্যানগার্ড ২। ১৯৫৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এটি উৎক্ষেপিত হয়েছিল। এটি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠাতে পারত। ১৯৬০ সালের ১ এপ্রিল টাইরোস ১ পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপিত হয়। এটি বিস্তারিতভাবে পৃথিবীর আবহাওয়া সংক্রান্ত ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়। ওই বছরই ২৩ নভেম্বর টাইরোস ২ পৃথিবী থেকে বিচ্ছুরিত ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মি পরিমাপ করে এবং আবহাওয়ার ছবিও সংগ্রহ করে। ১৯৬১ সালের ১২ জুলাই নিক্ষিপ্ত টাইরোস ৩ আটলান্টিক মহাসাগরের হারিকেন ইথার নামক ঝড় প্রথম আবিষ্কার করে। এক্ষেত্রে হারিকেনের কারণে যেসব অঞ্চল আক্রান্ত হতে পারে সেসব অঞ্চলকে আগেই সতর্ক করা হয়। এই ধারাবাহিক উপগ্রহমালার অনেক উপগ্রহ নিক্ষিপ্ত হয় যা তাপমাত্রা নির্ণয় করে মহাকাশে ইলেকট্রনের ঘনত্বের পরিমাপ করে। টাইরোস উপগ্রহমালার পর ঈসা এবং তারপর নিঃশ্বাস উপগ্রহমালা মহাকাশে নিক্ষিপ্ত হয়। ১৯৬৬ সালের ১৫ মে নিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস ২ উপগ্রহ পৃথিবীর উত্তাপের ভারসাম্য পরিমাপ করে। নিঃশ্বাস ১ হারিকেন ডেটার অনুসন্ধান দেয়। মানুষ জীবন ও ধনসম্পত্তির ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য আবহাওয়া সংক্রান্ত স্যাটেলাইটগুলো হারিকেন, বন্যা ও অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে আগেই সতর্কতা প্রদান করে থাকে। প্রায় সব স্যাটেলাইট মেঘের ফটোগ্রাফ গ্রহণ করে। ম্যাগনেটিক টেপে সংবাদ জমা করে এবং তারপর টেলিমিটার দিয়ে গ্রাউন্ড স্টেশনে রক্ষিত কম্পিউটারে সোজাসুজি প্রেরণ করে। পৃথিবীর ওপর সে সময় অবস্থানকারী মেঘের প্রণালীর ছবি পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। ২০০৯ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার কৃত্রিম উপগ্রহ ইরিডিয়াম ৩৩ এবং রাশিয়ার কসমস ২২৫১ উপগ্রহের ধাক্কা লাগে। ঘটনাটি ঘটে সাইবেরিয়ার ৭৮৯ কিলোমিটার ওপরে। কৃত্রিম উপগ্রহের সম্মুখ সংঘাতের ঘটনা এটিই প্রথম।

কৃত্রিম উপগ্রহ এমনভাবে পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘূর্ণায়মান হয়, যাতে এর গতির সেন্ট্রিফিউগাল বা বহির্মুখীন শক্তি ওকে বাইরের দিকে গতি প্রদান করে। কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একে পৃথিবীর আওতার বাইরে যেতে দেয় না। যেহেতু মহাকাশে বায়ুুর অস্তিত্ব নেই, তাই এটি বাধাহীনভাবে পরিক্রমণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বৃত্তাকারে পরিক্রমণ করে না, তার গতি ডিম্বাকৃতির। টিভি ও বেতারসংকেত প্রেরণ এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী কৃত্রিম উপগ্রহগুলো সাধারণত পৃথিবী থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। পৃথিবী থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য পাঠানো হয়, কৃত্রিম উপগ্রহ সেগুলো গ্রহণ করে এবং বিবর্ধিত করে পৃথিবীতে প্রেরণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহ দুইটি ভিন্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করে সিগনাল (তথ্য) গ্রহণ এবং পাঠানোর জন্য। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসা সিগনাল অনেক দুর্বল বা কম শক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাই প্রথমে ডিশ এন্টেনা ব্যবহার করে সিগন্যালকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং পরে রিসিভার দিয়ে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হয়।

কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর উৎক্ষেপণের সময়ই পর্যাপ্ত জ্বালানি গ্রহণ করতে হয়। কারণ মহাকাশে রিফুয়েলিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। তবে কিছু উপগ্রহ জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তি ব্যবহার করে। এদের গায়ে সৌরকোষ লাগানো থাকে, যা ব্যবহার করে থেকে সে সূর্য থেকে তার প্রয়োজনীয় শক্তি গ্রহণ করে। এদিকে বাংলাদেশের তিন শিক্ষার্থীর তৈরি করা প্রথম ন্যানো স্যাটেলাইট ‘ব্র্যাক অন্বেষা’ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে উৎক্ষেপণের পর পৃথবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ শুরু করেছে। ন্যানো স্যাটেলাইটটি পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার ওপরে অবস্থান করে। পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে সেটি সময় নেয় ৯০ মিনিটের মতো।

 

সাশ্রয় হবে ১৪ মি ডলার

আমাদের দেশে এখন প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারে আছে। এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, এসব চ্যানেলের জন্য বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ সফল হলে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ সাশ্রয় হবে। উপরন্তু বিদেশে ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা সম্ভব হবে বলেও জানিয়েছেন বিটিআরসি। এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে। পাঁচ হাজার কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধন নিয়ে ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করা হয়েছে। এই কোম্পানি স্যাটেলাইটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সংস্থার (আইটিইউ) ‘রিকগনিশন অব এক্সিলেন্স’ পুরস্কারও পেয়েছে।

সর্বশেষ খবর