শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ফারসি মহাকবি হাফিজ সিরাজি

সাইফ ইমন

ফারসি মহাকবি হাফিজ সিরাজি

হাফিজের মৃত্যুর ১০০ বছরের মধ্যে তাঁর কোনো জীবনী রচিত হয়নি। কাজেই তাঁর  জীবনের অধিকাংশ ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। কবি রয়ে গেছেন রহস্য পুরুষ হয়েই...

অসীমকে স্পর্শ করতে চান কবিরা। চোখের দৃষ্টিসীমার মতো মনের দৃষ্টিসীমাও অসীম। আর অসীমের পথে এ মহাযাত্রায় কেউ কেউ হয়ে ওঠেন মহাকবি। এমনই একজন মহাকবি ইরানের হাফিজ সিরাজি। যার কবিতায় রয়েছে জ্ঞানের অতুলনীয় রত্নভাণ্ডার। প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য বোখারা আর সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যিনি, তিনি মহাকবি হাফিজ সিরাজি। পুরো নাম খাজা শামস উদ্দীন মোহাম্মদ হাফিজ-ই-সিরাজি।

বিশ্ব প্রকৃতি ও মানবজীবনের গভীর রহস্য তাঁর কবিতার প্রতিটি বাক্যে ফুটে উঠেছে। আপনি যতই পড়তে থাকবেন ততই যেন জ্ঞানের গভীর থেকে গভীরে মিশে যাবে আপনার পাঠকযাত্রা। অনন্য রচনা ‘দেওয়ান-ই হাফিজ’ দুনিয়াজোড়া সাড়া জাগানো এক বই। কবি হাফিজ মূলত গীতিকবিতা লিখতেন। এর মধ্যে কোনোটা সনেট-জাতীয় আবার কোনোটা গজল। ‘দেওয়ান-ই হাফিজ’ এর কবিতা ও গজলগুলোকে প্রেমের অমর মহাকাব্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কবি জীবনকালে তাঁর লেখাগুলো একত্রিত করে যাননি। জনপ্রিয় গজল হিসেবে সেগুলো মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। তাঁর বন্ধু গুল আন্দাম সেগুলো সংগ্রহ ও সংকলন করেন। যা পৃথিবীর চিন্তা ও সৃষ্টিশীল মননকে যুগে যুগে নাড়া দিয়ে এসেছে। মহাকবি ও চিন্তাবিদ গ্যেটে বলেন, ‘হঠাৎ প্রাচ্যের আসমানী খুশবু এবং ইরানের পথ-প্রান্তর থেকে প্রবাহিত চিরন্তন প্রাণ সঞ্জীবনী সমীরণের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমি এমন এক অলৌকিক ব্যক্তিকে চিনতে পারলাম, যার বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব আমাকে আপাদমস্তক তার জন্য পাগল করেছে।’ হাফিজের প্রেমানুভূতি ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহাকবি গ্যেটে বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকাব্য ফাউস্ট (FAUST) রচনা করেন। যেটাকে পাশ্চাত্য দিওয়ান বলা হয়। বিশ্বের প্রায় সব ভাষাভাষী কবি-সাহিত্যিকদের কবি হাফিজ দারুণভাবে নাড়া দিয়েছেন। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও রয়েছেন এ তালিকায়। ১৯৩২ সালে ইরানের সিরাজনগরে কবির মাজারে উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসেন বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘আমি জানি যে হাফিজের ধর্মীয় দর্শন ও কবিতা আমার পিতাকে যতখানি অভিভূত করত, বৈষ্ণবদের দর্শন ও সংগীত ততখানি করতে পারত না। হাফিজ ছিলেন তাঁর ঐশ্বরিক আনন্দ। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন না। হাফিজের কবিতাই তাঁর সৃষ্টির আকাক্সক্ষাকে পূরণ করত। উপনিষদ তাঁর ক্ষুধা নিবারণ করত এবং হাফিজ তাঁর তৃষ্ণা মেটাত।’ গিরিশচন্দ্র সেন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, হরেন্দ্র নাথ দেবসহ  বিখ্যাত কবিরা কবি হাফিজের বহু রুবাইয়াৎ ও গজল অনুবাদ করেছেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হাফিজকে এত মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন যে তাঁর পুত্র বুলবুলের মৃত্যুশয্যায় বসেও তাঁর রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন। তিনি ফারসি থেকে ৭৩টি রুবাই সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করেন। প্রেম ও ভালোবাসা হাফিজের কবিতায় ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। অনেকে মনে করেন এ রহস্যমানব হয়তো কোনো সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন, আদর করে নামও দিয়েছিলেন শাখ-ই-নবাৎ। কিন্তু কখনো তাঁর কোনো লেখায় সে রমণীর পরিচয় জানা যায়নি। বিশ্ববিশ্রুত এ মহাকবি হাফিজ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের এক নিশাপুর (ওমর খৈয়ামের জন্মভূমি) ছাড়া আর কোনো নগরই সিরাজের মতো বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেনি। ইরানের প্রায় সব শ্রেষ্ঠ কবির লীলা-নিকেতন এই সিরাজ। এ নগরীতেই সমাধিস্থ মহাকবি হাফিজ।  যেখানে পাথরের ওপর খোদাই করে কবির বিখ্যাত কবিতা লেখা ‘সমস্ত জাহান সবুজে সবুজে ভরে আছে এটা তাঁরই (খোদার) কীর্তি সমস্ত মানুষের মনের মাঝে প্রেম লুকিয়ে আছে এটা তাঁরই কীর্তি।’

 

ইরানে অবস্থিত হাফিজ সিরাজির পাথরের ভাস্কর্য

মহাকবি গ্যেটের জোড়াভাই

জার্মানির জাতীয় কবি গ্যেটেকে বলা হয় পশ্চিমা বিশ্বের মহাকবি। মহাকবি হাফিজ পাঠে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলছেন- Hafiz! Lets share all joy and woe, as true twin brothers, one from two.

দেশ-কালের ব্যবধান এ দুই মহাকবির মধ্যে অনেক। অথচ মহাকবি হাফিজ তাঁর লেখনী দিয়ে অতিক্রম করেছেন কাল। সর্বকালের জন্যই তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। মহাকবি গ্যেটে কিছুটা বৃদ্ধ বয়সে অর্থাৎ ৬৫ বছর বয়সে হাফিজের অনূদিত লেখা পড়ে অভিভূত ও মোহবিষ্ট হয়ে পড়েন। হাফিজের দিওয়ান (Divan) তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।  যার আলোকে তিনি লিখেন ১২ খণ্ডের অনন্য সাহিত্যকর্ম West Eastern Divan (the parliament of East and West.) শুধু তাই নয়, হাফিজের অসাধারণত্ব প্রকাশে তিনি বলেন- Hafiz has no peer.

 

তৈমুর লংয়ের ঐতিহাসিক সাক্ষা

তৈমুর লংয়ের ফরাসি অভিযানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো- তাঁর সঙ্গে পারস্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হাফিজের সাক্ষাৎ। সিরাজনগরী দখলের পর তিনি হাফিজের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি ইতোপূর্বেই হাফিজের কবি-প্রতিভায় মুগ্ধ হন এবং তাঁর প্রখ্যাত বয়াত পাঠ করতেন। এ দুইয়ের সাক্ষাৎপর্ব ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। 

সিরাজনগরীতে অবস্থানকালে তৈমুর লং মহাকবি হাফিজকে দরবারে ডেকে পাঠান। ফারসি কবি নিতান্ত সাদাসিধে পোশাকে দারিদ্র্যের প্রতিমূর্তি গ্রহণ করে তৈমুরের সামনে হাজির হলেন। তৈমুর কঠোর স্বরে কবিকে জিজ্ঞাসা করেন- ‘আপনি কী লিখেছেন?’, লেখাটি ছিল- ‘আমার সিরাজ- বধূয়া যদি গো/ দিল্ পরে মোর হাত বুলায়/ তাহলে তার কপোলের একটি তিলের তরে / লুটিয়ে দেব গো সমরকন্দ আর বুখারা।’ হাফিজ জবাবে বলেন, এটা তাঁর কবিতা মাত্র। এমন জবাব শুনে তৈমুর রোষের সঙ্গে বললেন, ‘বহু বছর কঠোর সংগ্রাম করে এ তলোয়ারের বলে আমি বহু নগর ও জনপদ দখল করেছি শুধু আমার বাসস্থান ও রাজধানী সমরকন্দ এবং বুখারাকে সুসমৃদ্ধ করার জন্য। আর আপনি কিনা সিরাজের একটি নগণ্য মেয়ের কপোলের তিলের জন্য সমরকন্দ ও বুখারা বিলিয়ে দিতে চান।’ ঈষৎ হেসে কবি বলেন, ‘জাঁহাপনা, দেখতেই পাচ্ছেন, এ অমিতব্যয়িতার জন্যই তো আমার আজ এই দুর্দশা।’ এ ত্বরিত ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে তৈমুর লং খুশি হন এবং তাঁকে প্রচুর ধন-রত্ন উপহার দিয়ে বিদায় জানান।  অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন সম্ভবত মহাকবি হাফিজের সঙ্গে এ সাক্ষাতের কারণেই অপরাপর শহরের মতো সিরাজনগরীতে ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়নি।

 

এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত মহাকবি হাফিজ সিরাজি

শ্বেত পাথরের হাফিজের মাজার

ইরানের সিরাজনগরীতে কবি হাফিজের সমাধিস্থল। এটি হাফিজের মাজার নামেও বিশেষভাবে পরিচিত। এটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। হাজার রঙের ফুলের বাগান ঘিরে রয়েছে কবির সমাধিস্থলজুড়ে। বাগানের শুরুতেই কবি হাফিজের বুক পর্যন্ত ভাস্কর্র্য। মাথায় পাগড়ি, লম্বা বাবরি চুল পাগড়ির নিচ দিয়ে ঘাড় বেয়ে পিঠের ওপর গিয়ে পড়েছে। চাপদাড়ি ও গোঁফ। ভাস্কর্যটির পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে একটি সাইনবোর্ড। যেখানে ফারসিতে লেখা- ‘আরামগাহে খাজে শামস উদ্দীন মোহাম্মদ হাফেজ সিরাজি’। এখানকার প্রাকৃতিক শোভা মুগ্ধ করে সবাইকে।  মাজার প্রাঙ্গণের সব সিঁড়ি ও বারান্দায় রয়েছে বিভিন্ন রঙের ফুলের গাছ। আটটি গোলাকৃতি শ্বেতপাথরের খামের ওপর কালো ছাতার মতো পাথরের গম্বুজ। গম্বুজের ভিতরের অংশে লাল-নীল-সবুজ পাথরের অপূর্ব ইস্পাহানি নকশা। মর্মর পাথরে বাঁধানো কবির সমাধি।

সর্বশেষ খবর