বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

মহৎ মানুষ কবি শামসুর রাহমান

রবিউল হুসাইন

মহৎ মানুষ কবি শামসুর রাহমান

কবি শামসুর রাহমান জন্ম : ২৩ অক্টোবর ১৯২৯ মৃত্যু : ১৭ আগস্ট ২০০৬

জীবনানন্দ বলেছেন, কবিতার সামাজিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতা সুন্দরীর অক্ষিগোলকের পেছনের রক্তকণিকার মতো লুক্কায়িত থাকে। ৭৭ বছর বয়সের কাব্য-বর্ণাঢ্য জীবনে বাংলা আধুনিক কবিতার প্রাণপুরুষ কবি শামসুর রাহমানের কবিতা সৃষ্টির মূলে বোধকরি প্রাগুক্ত কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেলানো যায়। তাকে দেখা যায় প্রথম জীবনে শুদ্ধাচারী কবি হিসেবে, যেখানে তিনি আধুনিক জীবনের নানান অনুসঙ্গ— একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ, যোগাযোগশূন্যতা বা বিচ্ছেদচিন্তা, অস্তিত্বের জটিলতা ও সংকট, পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনীতির সহজ শিকার ইত্যাদি সমস্যায় পীড়িত হয়ে তার বিভিন্ন কবিতা রচনা করেছেন। তাই যে-কবিতা সে-সময়ের সংবাদ-সাহিত্য সাময়িকীতে একটি শব্দের পরিবর্তনসাপেক্ষে প্রকাশ করতে তিনি রাজি হননি, সেই একই কবিতা ‘রূপালি স্নান’ বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য প্রেরণ করেন, তা হুবহু ছাপার অক্ষরে দেখা যায় এবং কবিতা-বিশেষজ্ঞরা তখন বুঝতে পারেন যে, একজন প্রতিভাবান কালজয়ী কবি আধুনিক বাংলা কবিতা-জগেক দাপটের সঙ্গে শাসন করার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। পরে বাংলাদেশের জন্ম, তার আগে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ এবং পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন গণবিরোধী গণতন্ত্রহীন সামরিক-স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরূপতা কবির কবিতায় যেভাবে সাবলীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে অনিঃশেষ ফল্গুধারার এবং তা শিল্পগুণসমৃদ্ধ কবিতায় পূর্ণতা পেয়েছে, তা সেই অক্ষিগোলকের পেছনের রক্তকণিকার বাস্তবরূপের মতো। সামাজিক অবিচার বা অসাম্য এবং রাজনৈতিক অধিকার বা আন্দোলনের মতো উচ্চকিত মোটাদাগের বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করা খুব কঠিন, কিন্তু অনায়াসে তিনি সেই বাধা অতিক্রম করে বাংলা কবিতাতে নতুন শিল্পসুষমা যোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় এই যে, একটি বাঙালি কিন্তু উর্দুভাষী মুসলিম পরিবার থেকে স্বীয় প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে একজন কবি পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতা-শিল্পচর্চা করার অসামান্য সাহস ও প্রতিবেশ তৈরি করেছেন। প্লেটো বলেছেন যে, কবিতা ক্রিয়ার অনুকরণ, এর উদ্দেশ্য আনন্দ ও শিক্ষাদান। বহুলাংশে কবি শামসুর রাহমান এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরোপুরি একজন সফল কাব্যপুরুষ। তার আশপাশে জীবিত অবস্থায় যে-পরিবেশ বিরাজ করছিল, তার কবিতা সেগুলো নিয়ে কাব্যভাষায় অনবদ্যভাবে অনুকরণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে কবি সবাইকে আনন্দ ও শিক্ষাদান করেছেন নিজেকে উজাড় করে। পরিপূর্ণভাবে দুই বছর আগে কবি ২০০৪ সালে প্রকাশিত ৮৬টি কবিতা নিয়ে একটি কবিতা-সংকলন প্রকাশ করেন, শিরোনাম ‘গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহ্বান’। প্লেটোর কথানুযায়ী তার কবিতাগুলো অবশ্যই ক্রিয়ার অনুকরণ। চারপাশের পরিবেশ, দৈনন্দিন ঘটনাবলি, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা এবং ব্যক্তিগত, শারীরিক ও অবচৈতনিক প্রতিবেশ কবির মননে যেভাবে প্রতিঘাত সৃষ্টি করেছে, সেগুলোই তার কবিতায় অনুসরিত হয়ে কাব্যভাষা পেয়েছে। আকাশ-কুসুম অলীক-অসীম চিন্তা পরিহার করে বাস্তবতার সসীমে নিয়ে গিয়ে শব্দপুঞ্জের সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কবি এভাবেই আমাদের আনন্দ এবং শিক্ষাদান করেছেন। আনন্দ দিয়েছেন তিনি বহুদিন থেকে বহুভাবে। তার কবিতার পঙিক্ত যখন আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিতে এসে ভিড় জমিয়েছে, তখন আমরা আনন্দ পেয়েছি, মনে হয় এটা আমারই একান্ত অনুভূতি, কবি কী করে যেন আমার মনের কথা জেনে এবং তা অনায়াসে বলে ফেলেছেন। আবার তাকে দেখা যায়, রাজনৈতিক-সামাজিক দুঃসময়ে যেমন বর্তমান সময়টি অবলীলায় কৃষ্ণপক্ষের কাল, যা উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে— এমন করে সুনির্দিষ্ট এবং প্রকৃতরূপে অভিহিত করেন। এই সময়ের এই দুঃশাসনকালের চাপা ক্ষোভটিকে পঙিক্ততে রূপান্তরিত করে আমাদের মনের রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত-উন্মুল করে দেন। তার কবিতা-শিল্পে দেখা যায় এদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এমন কোনো ব্যক্তিগত বিষয়— প্রেম, আনন্দ, বেদনা, অবহেলা, প্রকৃতি, উৎসব, পালা-পার্বণ ইত্যাদি— নেই যা তার কবিতায় স্থান পায়নি। রবিঠাকুরের পর বোধকরি এমন বহুধাবিভক্ত, বহুতলবিশিষ্ট কবি বাংলা কবিতায় দেখা দেননি। তার কবিতা আমাদের সুপ্ত মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির যেমন একটি রূপ-ভাণ্ডার, তেমনি চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলির দিনপঞ্জি। সাংবাদিকসুলভ অন্তর্ভেদী এবং সর্বদিক-সঞ্চারী দৃষ্টি দিয়ে কবি সাধারণ বিষয়গুলোকে অসামান্য শব্দমঞ্জরি দিয়ে অসাধারণ করে তুলে আমাদের একদিকে যেমন আনন্দ দিয়েছেন, তেমনি অন্যদিকে দিয়েছেন শিক্ষা। সেই শিক্ষাটা হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও উদার মানবিকবোধ, যা মাটি, মানুষ ও দেশকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করে এবং প্রেরণা জোগায়, যা তিনি জীবনব্যাপী চিন্তা, দর্শন, জীবনযাপন ও কর্মে অনুসরণ করে গেছেন। এই আলোচ্য কবিতার বাইরে দেখা যায়, প্রায় কবিতা মৃত্যুবিষয়ক। মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে প্রকাশিত কবিতায় সুদূর দৃষ্টিসম্পন্ন একজন সংবেদনশীল কবির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। তিনি যে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করেছেন, তারই অনিবার্য রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এখানে কোনো আরোপিত অস্বাভাবিকতা নেই। তাই তিনি অনায়াসে লিখেছেন, ‘বয়স কম তো নয় উড়ছে মাথায়/এখনও সফেদ চুল, কোনও/ কোনও দাঁত নড়বড়ে। তদুপরি কফের ধমকে হামেশাই/বুক ফেটে যেতে চায়। তবুও কলম তার প্রায়শ চঞ্চল/... যিনি তাঁর কণ্ঠ ধীরে করে উচ্চারণ—/ তোমার লেখার ধার অস্তগামী, অবিলম্বে’, থামাও লেখনী।/ নয়তো বুকের রক্ত ঝরিয়ে হলেও/ খাতার পাতা ফের সাজাও প্রাণবেগ, সৃষ্টি করো।/... কবিতার খাতা খুলে তিনি/ রচনা করেন এক নতুন কবিতা,/ রূপ যার আকাশের তারার মতো জ্বলজ্বলে,— হাসি ফোটে/ কবিতার খাতায়, এমন হাসি আর/ ঝরায় নি ঝর্ণাধারা কোনও কবিতার পঙিক্তমালা।’

শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতি অনিরুদ্ধ ভালোবাসা ও শক্তিময়তা এমনই। আবার লেখেন, ‘তার অন্তরে-বাহিরে বলতেই থাকেন— কত কিছুই তো ঘটে অজান্তে কত বিজ্ঞ/জ্ঞাতসার ব্যক্তির অজ্ঞাতে। কখনও কখনও/ তিনি জানার ভান করেন বটে, অথচ/ তার অন্তরে একটি দুটি কীট কামড় দিতেই থাকে।/... আসেন না এই পথে ইদানীং, যদিও ভাবনা এবং লেখনী/ কিছুই থামেনি তাদের, চলছেই শিল্পীর তুলি, কবির কলম।’

কবির এই বইয়ের কবিতার মধ্যে অন্ধকার, অশরীরী কোনো অদৃশ্য প্রেতাত্মার ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা— এরকম বহু দুঃসময়ের আলেখ্য দেখা যায়। আচমকা, আচানক, সুনসান, বিরান, আখেরে, ঢের, সওয়াল, বেঘোরে, লহমা, জাঁহাবাজ, আসমানচারী, বেয়াড়া, বেখাপ্পা— এরকম সাধারণ আটপৌরে নিত্যব্যবহৃত শব্দ তার কবিতায় পাওয়া যায়। এসবের মধ্য দিয়ে কবির সরল, সহজ ও নিরাভরণ একটি স্বচ্ছ পরিষ্কার মন উঁকি মারে। এগুলো তার কবিতার বিশেষ গুণ, যা একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। এই সাধারণ সহজ রূপের আড়ালে জীবনানন্দের সেই সুন্দরীর অক্ষিগোলকের পেছনে লুকোনো থাকে যে সামাজিক, ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

এই সমাজ, এই দেশ, এই সংসার, কবির ভালোবাসা, আমি-তুমি-সে এবং আমরা-তোমরা-তারা, সেইসব প্রকাশিত হয়ে পড়ে কবিতার পঙিক্তমালার মধ্য দিয়ে। তাই কবি আদ্যোপান্তভাবে আগাপাছতলা দৈশিক, সামাজিক-সাংসারিক-পরিবেশগত আত্মমগ্ন অসহায় নিঃসঙ্গ একাকী এক মানবপ্রাণী এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাগতিক। যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করার এক দুর্লভ ক্ষমতা ছিল কবির। তিনি পাখি নিয়ে কবিতায় বলেছেন, ‘কত যে খণ্ডিত হই রোজ/ নিজেই জানি।... বস্তুত একলা নয়, দল বেঁধে চলে/ একত্রে আহার করে অবসর উপভোগ করে/ মিলেমিশে এক জায়গা নিজেদের/ মধ্যে মানুষের মতো খুনোখুনি করে না কখনও।’

প্রয়াত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের কবি ও লেখক হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছেন। একটিতে বলেছেন, ‘কোনওকালে মৃত্তিকায় বিলুপ্ত হলেও/যুগ যুগ জ্বলজ্বল রয়ে যাবে বাংলার দালান,/ কুটিরে, নদীর ঢেউয়ে। দেশপ্রেমী প্রতিটি প্রাণের/ আসনে হে কবি হুমায়ুন তুমি আজ অধিরাজ।’

কবির কলম প্রতিটি বিষয় স্পর্শ করতে চায়। কবিত্বশক্তি ভরপুর এত স্পর্শাকাঙ্ক্ষিত কবি হৃদয় বাংলার আধুনিক কবিতায় সত্যি খুব বিরল। জুতো নিয়েও তিনি কবিতা সৃষ্টি করেছেন। সম্পূর্ণটাই উদ্ধৃত করা যায়, ‘বসেছিলাম লেখার টেবিল-ঘেঁষা/ অনেকদিনের পুরনো চেয়ারে। হঠাৎ চোখ/ পড়লো কিয়দ্দুরে রোদ-পোহানো/ নিঃসঙ্গ ঢের ক্ষয়ে যাওয়া/ একটি জুতোর দিকে। কেমন যেন/ মায়া লাগলো। কার জন্য?/ আবার দৃষ্টি ছুঁলো হাতে-রাখা আধ-পড়া/ বইটির পাতায় মন বসলো না। দৃষ্টি গেলো পুরনো;/ বেখাপ্পা জুতোর দিকে। এক লহমায় কি মনে হলো/নিজের চেহারা দেখলাম আয়নায়। চমকে/উঠি রোদ পোহানো ক্ষয়ে-যাওয়া/ জুতোর সঙ্গে আমার মুখে মিল দেখে।’ এই রকম বহু সাধারণ দৃশ্য ও বিষয়কে অসাধারণ করে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি। কবিতার শিল্পমূল্যে সব কবিতা কালজয়ী গভীরতা নির্মাণ করতে পারে না, তবে সাধারণ ও তুচ্ছ বিষয়ের সঙ্গে যে শিল্পত্ব জড়িয়ে থাকে, তাকে আবিষ্কার করার সাবলীল ক্ষমতা অবশ্যই গভীর শিল্পশক্তির পরিচয় দেয়। শামসুর রাহমানের কবিতা সেই বিপুল সহজাত ক্ষমতায় বলীয়ান। কবির কবিতা বহুবিচিত্র পথে নিয়ত হেঁটে চলেছে। কিন্তু সর্বত্রগামী হওয়া যায় না কবিতাকে নিয়ে। প্রাকৃতিকভাবে তা সম্ভব নয়। সেই জন্য রবিঠাকুর বলেছেন, ‘আমার কবিতা, জানি আমি,/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’ তবে শামসুর রাহমানের কবিতা রবিঠাকুরের কবিতার মতো বহুবিচিত্র পথে প্রকাশিত হয়েছে এ কথা অনায়াসে বলা যায়। কবি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন অর্ফিক কবি অর্থাৎ জাত কবি তিনি বহুমুখী দত্তাবসার কবি ছিলেন, যিনি কবিতা-রচনার পাশাপাশি দেশ, সমাজ, সংগঠন, মাটি, সাধারণ-অসাধারণ— সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণত পূর্ণ। একজন কবি ও মানুষ।

সর্বশেষ খবর