বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

আব্বুকে মনে পড়ে...

ফওজিয়া দেওয়ান

আব্বুকে মনে পড়ে...

বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান আমার বাবা। আমি তার মেজো মেয়ে। ছোটবেলা থেকে আমি আমার বাবাকে ‘আব্বু’ বলে ডাকি। আমার বড় বোন সুরাইয়া ইসলাম, ভাই ফাইজুর রাহমান, আমি ফওজিয়া দেওয়ান, মতিন (অকাল প্রয়াত) এবং সবার ছোট বোন সেবা রাহমান। আমরা ভাইবোনরা আব্বুর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলাম। বাবা হিসেবে তিনি সব সময় আমাদের আদর-স্নেহে রাখতেন।

কবি শামসুর রাহমান ছিলেন একজন সহজ-সরল, সদা হাস্যোজ্জ্বল, পরিপাটি ভদ্র মানুষ। ছোটবেলায় দেখতাম কোনো অতিথি আমাদের বাসায় এলে আব্বু সাধ্যমতো সমাদর করতেন। তার কাছে কেউ সাহায্য চাইলে তিনি খালি হাতে কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি আম্মুকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। অন্যদিকে সন্তানদের প্রতিও কোনো ত্রুটি করেননি। আমাদের পড়াশোনা, বেড়ে ওঠায় তার অসীম স্নেহ ছিল। আব্বুর মতোই আমার আম্মু জোহরা রাহমানও ছিলেন অদ্ভুত আন্তরিক, সরল ও শান্ত মানুষ। তার কাছেও কেউ সাহায্য চাইলে অনায়াসে তিনি দিয়ে দিতেন। তার কাছে ১০ টাকা থাকলে ছয় টাকা দান করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। অনায়াসে বিলিয়ে দিতেন নিজের পছন্দের শাড়ি। আব্বুর নিজের লেখালেখি, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালেও সংসারে সমান মনোযোগ দিতেন। সংসারের অনেক দায়িত্ব নিঃশব্দে পালন করেছেন আমার আম্মা। আব্বু লেখায় নিমগ্ন থাকলে আম্মুই আমাদের দেখভাল করতেন। আমাদের কোলাহলে তার লেখার যেন ক্ষতি না হয় সেদিকে সদা যত্নবান থাকতেন। আমরাও যতটুকু সম্ভব নীরব থেকে আব্বুর লেখার পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয় সে জন্য সচেষ্ট থাকতাম। আম্মুর চাহিদা ছিল কম। আব্বুকে বাড়তি কোনো চাপ কখনো দিতেন না। তিনি সব সময় আব্বুকে লেখার জন্য উৎসাহিত করতেন। আমি বিশ্বাস করি, আব্বুর প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আম্মুর।

আম্মুর কাছ থেকে জেনেছি, জন্মের পর আমি জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। ওই সময় সারা রাত জেগে আব্বু আমার চিকিৎসাসেবা করেছেন। তার নিদ্রাহীনতার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারি আব্বু আমাদের কতটা ভালোবাসতেন! আব্বু ছিলেন নম্র ও অত্যন্ত কোমল মনের অধিকারী। ভাইবোনরা দুষ্টমি করলে তিনি গায়ে হাত দেওয়া দূরে থাক, কখনো রুষ্ট হননি। সময় পেলে আমাদের সময় দিতেন, গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন। তার স্নেহমমতার কোনো তুলনা হয় না। সবকিছুতে তার পরিমিতি ছিল। বিলাসবহুল জীবন তিনি বিশ্বাস না করলেও পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাওয়া-দাওয়ায় শৌখিন ছিলেন।

আম্মুর রান্নায় হাত যশ ছিল। প্রায়শই চমৎকার সব মেন্যু তৈরি করে আমাদের খাওয়াতেন। আব্বুও খাওয়া-দাওয়া খুব উপভোগ করতেন। আমি আব্বুর সঙ্গে খুব দুষ্টমি করতাম। আমি তখন বড় হয়েছি, একদিন আব্বু একটি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। আমার অপছন্দের অভিব্যক্তি জানালে আব্বু পাঞ্জাবিটি সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলেন। কথাটি মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। আব্বুর চমৎকার কিছু গুণ আমরা লক্ষ্য করেছি। মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখতেন। কাছের লোকদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অসীম। একটি অদ্ভুত ব্যাপার এখনো আমার মনে দোলা দেয়, সেটি হলো আমাদের ভাইবোনদের তিনি তার বলয়ে কখনো নিতেন না। তিনি চাইতেন তার সন্তানরা নিজেদের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক। একজন আদর্শ পিতা হিসেবে সব সময় কামনা করতেন আমরা যেন জীবনে সুখী হই। আমার শ্বশুরবাড়ি সুদূর সুনামগঞ্জ হাছন রাজার বাড়ি। ১৯৮২ সালে ওই ঐতিহ্যবাহী পরিবারে স্বনামখ্যাত সমাজসেবী মরহুম দেওয়ান আনোয়ার রাজার তৃতীয় ছেলে সাবেরীনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর আব্বু বলেছিলেন, ‘এক সুতোয় দুটো মালা’। অর্থাৎ দেওয়ান হাছন রাজা নিজে গীতিকবি হিসেবে বিখ্যাত, আব্বুও সবার প্রিয় কবি; এই দুই পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। আমার বিয়ের সুবাদে কয়েকবার সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন আব্বু। হাওর-বাঁওড়সমৃদ্ধ প্রকৃতির লীলাভূমি অবলোকন করে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। গল্পচ্ছলে বিভিন্ন সময় তা উল্লেখও করেছেন। পরবর্তীতে আমার ছেলেদের সান্নিধ্যে মুগ্ধ হয়ে আবেগপ্রবণ আব্বু আমাকে বলেছিলেন, আমি তোমার জন্য গর্ববোধ করি।

আমি পরিবারসহ দীর্ঘদিন আমেরিকায় বসবাস করছি। আব্বু দুবার বেড়াতে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। প্রথমবার ১৯৯০ সালে আমার বড় ছেলে সামেয়ীন ও মেজো ছেলে তাবেয়ীনের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছিলেন। ওই সময় আমার আম্মুও সঙ্গে ছিল। একই বছরের ডিসেম্বরে আমার তৃতীয় ছেলে জেহীন ভূমিষ্ঠ হয়। ১৯৯৫ সালে আব্বু ফ্লোরিডায় গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়। তখন জেহীন খুব ছোট। আব্বু জেহীনকে খুব আদর করতেন। আমি জেহীনকে স্কুল থেকে এনে আব্বুর সেবায় মন দিতাম। জেহীনের শিশুমন এটা সহ্য করতে পারত না। সে আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করত, নানু কখন দেশে যাবে? আমি দুষ্টমি করে বলতাম কাল যাবে। এতে জেহীন খুব উচ্ছ্বসিত হতো। আব্বুও মজা পেত। আমার স্বামী সাবেরীনকেও আব্বু ভীষণ স্নেহ করতেন। সে-ও আব্বুর জন্য যথাসাধ্য করেছে। তাকে একবার তিনি বলেছিলেন,  ‘ফওজিয়াকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ভুল করিনি। তুমি ছেলের চেয়ে বেশি করেছ।’

২০০৬ সালে শেষবারের মতো আব্বুর সঙ্গে নিবিড় সময় কাটিয়েছিলাম। অনেক বছরের তার মনে কিছু আকুতি ছিল। ওই সময় প্রায়শই তার মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন। আবেগ-আপ্লুত হয়ে বলতেন, তাবেয়ীনকে (আমার দ্বিতীয় ছেলে) পাঞ্জাবিতে কেমন মানাবে; এতে অনুমান করা যায় তার খেয়ালি মনের অভিব্যক্তি। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমাদের ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে বাংলাদেশে আসবে। তার সে আশা পূরণ হয়নি। আমরা তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে আমেরিকায় ফিরে যাই। মাঝে টেলিফোনে আলাপ হয়েছিল, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় আমরা একসঙ্গে আর মিলিত হতে পারিনি। ওই বছরই তিনি মারা যান। পরবর্তীতে এসে আম্মুর সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলাম। অবশেষে আম্মুও আমাদের ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এ দেশের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আব্বু গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। যেখানেই থাকি বুঝতে পারি কবি শামসুর রাহমানকে দেশের মানুষ গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ঢাকায় আমার বড় ছেলের বিয়ে হয়। সামেয়ীন একজন ফার্মাসিস্ট। পুত্রবধূ নূসা ফারীন পেশায় একজন ডাক্তার। অত্যন্ত ভালো মেয়ে। আব্বু, আম্মু থাকলে ওদের বিয়ে দেখতে পেলে খুবই খুশি হতেন। শুধু আফসোস রইল যে আব্বু, আম্মু আমার ছেলের বিয়ের আগেই পৃথিবী থেকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সব সুখ-দুঃখ, আনন্দে আব্বুকে ভীষণ মনে পড়ে, বার বার মনে পড়ে।

লেখক : কবির মেজোকন্যা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর