খরস্রোতা পদ্মার বুক চিরে উঠে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেতুটি শুধু নদীর দুই পাড়কেই এক করেনি, স্থাপত্যশৈলীতেও অনন্য নজির স্থাপন করেছে। ধূসর রঙের যে পদ্মা সেতু আজ দাঁড়িয়ে গেছে, তার তলদেশে রয়েছে ৪০ তলা ভবন সমান কাঠামো, যা বিশ্বে প্রথম। ভার বহন ক্ষমতা, দুর্যোগ সহনশীলতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিক দিয়ে পদ্মা সেতু একের পর এক রেকর্ডে পেছনে ফেলেছে বিশ্বের বড় বড় সেতুকে।
সেতু সংশ্লিষ্টরা জানান, খরস্রোতা পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এমন গতির পানিপ্রবাহ বিশ্বে একমাত্র আমাজন নদীতেই আছে। এ কারণে পদ্মায় সেতু নির্মাণ ছিল অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিস্ময়কর। পদ্মার তলদেশ এতই দ্রুত পরিবর্তনশীল, যে কোনো মুহূর্তেই সেখান থেকে মাটি সরে গিয়ে ২১ তলা ভবন সমান গভীর খাদ তৈরি হতে পারে। ফলে ধসে পড়তে পারে সেতু। এ চ্যালেঞ্জ জয় করেই পদ্মার ওপর দাঁড়িয়েছে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল সেতু। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান অবকাঠামো প্রকৌশলী অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের চেষ্টা আর কারিগরি চ্যালেঞ্জ সামলাতে গিয়ে বিশ্বের সামনে বেশকিছু নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
পাইলিংয়ে নজির : সেতুকে টেকসই করতে নদীর অংশের খুঁটির নিচে চীন থেকে আনা তিন মিটার ব্যাসার্ধের ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত ইস্পাতের পাইল বসানো হয়েছে, যা ৪০ তলা ভবনের সমান। বিশ্বে এত গভীরে ও মোটা পাইল কোনো সেতুতে বসানো হয়নি। প্রতিটি পিয়ারে বসেছে ৬টি পাইল। পাইলের মাথায় মাটি নরম থাকায় ২২টি পিয়ারে পাইল দেওয়া হয়েছে ৭টি করে। কিছু জায়গায় সবচেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যরে পাইল দিয়েও মাটির নিচে শক্ত স্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে স্কিন গ্রাউটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বসানো হয় এসব পাইল, যে প্রযুক্তি বিশ্বের কোথাও প্রয়োগ হয়নি, এমনকি কোনো পাঠ্যবইয়েও নেই।ব্যবহৃত হয়েছে কংক্রিট ও স্টিল : পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে, যা সেতুকে করে তুলেছে কয়েক গুণ শক্তিশালী। বিশ্বের অন্যান্য সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলে।
সবচেয়ে বড় বিয়ারিং : ভূমিকম্প প্রতিরোধে পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে সবচেয়ে বড় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। একেকটি বিয়ারিংয়ের ওজন ধারণক্ষমতা ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এর আগে পৃথিবীতে কোনো সেতুতে এমন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে এ সেতুর। বিয়ারিংগুলো চীনে ভূমিকম্প পরীক্ষার পর ফের পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
সেতু রক্ষায় নদীশাসন : নদী শাসনে পদ্মার দুই পাশে ১৪ কিলোমিটার এলাকার তীর তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে ৮০০ কেজি ওজনের একেকটি জিওব্যাগ। নদীর তলদেশে ঢাল তৈরির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে আনা একেকটি ১ টন ওজনের পাথর। নদী শাসনে ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা এ কাজে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এ ছাড়া সেতুর জন্য ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন আর কোথাও নেই। এত গভীরে নদীশাসনও কোথাও হয়নি।
সর্ববৃহৎ ক্রেন : পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে, যার ওজন ৪ হাজার টন। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় আনা হয়েছে। ক্রেনটির দাম ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বড় হ্যামার : এই সেতুতে সাড়ে ৩ হাজার টন ওজনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার ব্যবহার হয়েছে।
ভূপেন হাজারিকা সেতুর সঙ্গে পার্থক্য : দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম সড়ক সেতু ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতু। সেতুটি দৈর্ঘ্যে পদ্মা সেতুর চেয়ে ৩ কিলোমিটার বেশি। তবে পদ্মা সেতুর প্রস্থ ৫.২৮ মিটার বেশি। পদ্মা সেতুর পাইল লোড ৮ হাজার ২০০ টন। আর ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইল লোড ৬০ টন।
অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, এক বছরে ২৫-৩০ ফুট পলি জমে পদ্মায়। সে কারণে নৌযান চলতে পানি থেকে ৭০ ফুট উঁচুতে সেতু করা হয়েছে। সেতুতে ব্যবহার করা কংক্রিটের বেশির ভাগই আনা হয়েছে ভারত, ভুটান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। বিশেষ কিছু রড আনা হয়েছে চীন থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য থেকে অ্যালুমিনিয়াম আনা হয়েছে।