শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সততার অনন্য দৃষ্টান্ত

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

সততার অনন্য দৃষ্টান্ত

ব্রিটেনের স্বনামধন্য লেখক ডগলাস এভ্রেট তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘‘There are some people who live in a dream world, and there are some who face reality; and then there are those who turn one into the other.’’ যার বাংলা অর্থ এমন- “কিছু মানুষ স্বপ্নের জগতে বাস করে। কিছু মানুষ বাস্তবে বাস করে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে।” আমাদের সেই বিজয়ের স্বপ্ন দেখানো মানুষটিই হলেন বঙ্গবন্ধুকন্য শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ৫টি প্যাকেজ ছিল। যথা- মূল সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, নদীশাসন এবং পরামর্শক নিয়োগ। মূল সেতু প্রাক যোগ্যতা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ১১টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। ডিজাইনের আংশিক পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পুনরায় দরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী কার্যক্রম শেষে দেখা যায়, পূর্বের ৫টি প্রতিষ্ঠানই পুনরায় দরপত্রের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়।

এই প্রক্রিয়া চলাকালীন অযোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির প্রাক যোগ্যতা দরপত্র বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পুনর্বিবেচনার পরামর্শ থাকায় মূল্যায়ন কমিটি অনুরোধটি আমলে নিয়ে পরপর দুবার প্রতিষ্ঠানটিকে সুযোগ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতা নির্ধারণে প্রকৌশলীদের যে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিবরণ দিয়েছিল; তা যাচাইকালে ভুল ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অনুমিত হয়। সেতু নির্মাণে অভিজ্ঞতার কথা বলে তারা যে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিয়েছিল, তার প্রমাণ আদতে তাদের কাছে ছিলই না। সেতু নির্মাণে মূল্যবান উপাদান হ্যামারের যে বর্ণনা তারা দিয়েছিল, তা অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সান ফ্রান্সিসকোতে ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে যাচাইকালে ধরা পড়ে। এ অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে তারা সদুত্তরও দিতে পারেনি; বিধায় তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। অবশেষে তারা প্রাকযোগ্যতার আবেদন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এজেন্সিশিপ বাতিল করে দেয়। এতে রাগান্বিত হয়ে ওই কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট জনৈক ক্যাপ্টেন রেজা সেতু কর্তৃপক্ষকে ‘ভবিষ্যতে খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে’- এই হুমকি দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান।

পরবর্তীতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী চায়না রেলওয়ে ফিফটিন গ্রুপ করপোরেশনের বরাত দিয়ে এর স্থানীয় এজেন্ট জনৈক হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে সাঁকো ইন্টারন্যাশনাল নামে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ‘সাইলেন্ট এজেন্ট’ নিয়োগ দেওয়ার শর্তে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কথিত চিঠির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, এ ধরনের কোনো পত্র তারা পাননি এবং হেলাল উদ্দিনের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো পত্রও প্রেরণ করেননি। হেলাল উদ্দিন জানান, তার কাছে মূল কপি নেই; পত্রটি তিনি মেইলযোগে পেয়েছেন। তবুও তিনি কথিত প্রাপ্ত কপি জমা দেননি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে বারবার তল্লাশি চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, প্রিন্সিপাল অর্থাৎ চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ করপোরেশন পত্রের বিষয়টি সম্পূর্র্ণ অস্বীকার করে এবং বিস্মিত হয়। পত্রের কপি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সৃজিত প্যাডে স্বাক্ষর সুপার ইম্পোজ করে পত্রটি তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগের সমর্থনে কোনো দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্য না থাকায় বিশ্বব্যাংকের আনীত প্রথম অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। এ অধ্যায় শেষ হতে না হতেই বিশ্বব্যাংক থেকে অভিযোগ করা হয়- পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি অভিনব অভিযোগ। কেননা দুর্নীতির জন্য কখনো ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয় না।

স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রম শেষে ৪-৯-২০১৪ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়; যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়। দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার প্রতিবেদন দাখিলে প্রায় এক বছর পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে ফলাফলের সঙ্গে একমত হয়ে কানাডার অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিজ একই বিষয়ে তাদের কাছে প্রেরিত অভিযোগে রায় প্রদান করেন। রায়ে তারা সুস্পষ্টভাবে জানান যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগটি ছিল অসত্য গালগল্প ভিন্ন অন্যকিছু নয়। ওই আদালতও মামলাটি খারিজ করে দেন।

পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের বিচার-বিশ্লেষণে এবং বিশ্বব্যাংকের সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিলে ব্যর্থতার কারণে এটা সহজেই অনুমিত হয় যে, তথাকথিত ঘুষ লেনদেনে অভিপ্রায় সংবলিত অদৃশ্য নোটপ্যাড, সাইলেন্ট এজেন্ট নিয়োগের পত্র প্রেরণসহ সবকিছুই ছিল সৃজিত, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; এর পেছনে ছিল অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী তাঁর অঙ্গীকার ও ঘোষণা অনুযায়ী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশে^ বাংলাদেশকে মর্যাদার উচ্চতর আসনে আসীন করেছেন।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং চেয়ারম্যান, প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি, সাবেক কমিশনার, দুদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর