২৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ২০:৪৭

বড় শিল্প ছাড়া উন্নয়ন হবে না, বললেন অমর্ত্য সেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বড় শিল্প ছাড়া উন্নয়ন হবে না, বললেন অমর্ত্য সেন

আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে বড় শিল্পের কোনও বিকল্প নেই, বললেন অমর্ত্য সেন। শনিবার সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে ‘কলকাতা লিটারেরি মিট’-এর আসরে তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মন্তব্য, ‘‘পৃথিবীতে এমন কি কোনও ধনী দেশ আছে, যেখানে বড় শিল্প নেই?... ভারী শিল্প ছাড়াও যে দেশের উন্নতি হয়, এ রকম কোনও বিকল্প কি কেউ দেখাতে পারবেন?’’ 

অমর্ত্য সেনের এই পর্যবেক্ষণ এ রাজ্যের শাসক কুলের কাছে শিক্ষণীয় হতে পারে। কারণ, তাদের জমি নীতির জেরে লগ্নিকারীদের কাছে একপ্রকার ব্রাত্যই হয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সরকারি নথিই বলেছে গত সাড়ে চার বছরে রাজ্যে বাৎসরিক গড় লগ্নির পরিমাণ ১৪০০ কোটি টাকারও কম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অবশ্য সদ্য সমাপ্ত শিল্প সম্মেলনে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা লগ্নি প্রস্তাব আসার দাবি করেছে। কিন্তু তার কতটা নতুন, আর কতটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে শিল্পমহলেরই সংশয় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকেই আশার আলো হিসেবে তুলে ধরতে চায় তৃণমূল সরকার।

কিন্তু রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর দাবি মতো সেটা যে ‘বিরাট ব্যাপার’ নয়, তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন অমর্ত্য সেন। তার কথায়, ‘‘পৃথিবীর কোনও দেশই শিল্পায়ন ছাড়া উন্নতি করতে পারেনি। বড় শিল্পের বিকাশের মাধ্যমেই আর্থিক উন্নতি এবং বৃদ্ধি ঘটিয়েছে বিভিন্ন দেশ। তা সে ইউরোপ হোক বা জাপান, কোরিয়া হোক বা হংকং, সিঙ্গাপুর বা লাতিন আমেরিকা।’’ তবে একই সঙ্গে রাজ্যের সীমায় আটকে না থেকে তাঁর আক্ষেপ, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে কখনও এই পরিস্থিতি তৈরি করা যায়নি।

একদা শিল্পে অগ্রণী রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বামপন্থীদেরও দায়ী করেছেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, ‘‘এ তল্লাটে (পশ্চিমবঙ্গে) মার্কসবাদী শাসনে শিল্পের উৎপাদন আর ট্রেড ইউনিয়নের বাড়বাড়ন্ত পাশাপাশি চলেছে। কিন্তু ইউনিয়নের দাপাদাপিতে ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার কারণে শিল্প বিদায় নিয়েছে।’’

অনেকেই মনে করেন রাজ্যে পালাবদলের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করা, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন তুলে না-দেওয়া, অথবা এসইজেড মেনে না-নেওয়ার সিদ্ধান্ত যে রাজ্যকে আরও পিছিয়ে দিয়েছে, তা মানছে প্রশাসনেরই একাংশ। পাশাপাশি, রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট রাজের রমরমার কারণে এ রাজ্যে যে প্রায় কেউই শিল্প করতে ভরসা পাচ্ছে না, নবান্নের একাংশ তা-ও মনে করে।

অমর্ত্য সেন অবশ্য এ সব বিস্তারিত তথ্যের মধ্যে না গিয়ে শিল্প-বন্ধ্যা রাজ্যের বাস্তব অবস্থা বোঝাতে বলেন, ‘‘এক সময় কলকাতা থেকে লন্ডনে সপ্তাহে ১৮টি উড়ান চলত। এখন একটাও চলে না। এখান থেকে ইউরোপের কোথাও যাওয়ার জন্যই কোনও উড়ান নেই। আমাদের দোহা, দুবাই, আবু ধাবি বা ব্যাঙ্কক হয়ে যেতে হয়। এটাই বাস্তব। আর এখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরার পক্ষে এটা যথেষ্ট।’’ তবে খাবার ও শিক্ষার অভাব থাকলে এবং স্বাস্থ্য ভাল না-হলে শিল্পায়নও যে সম্ভব নয়, তা জানান তিনি। তার কথায়, ‘‘অশিক্ষিত আর রুগ্‌ণ শ্রমিক দিয়ে কোনও কালেও শিল্পায়ন হবে না। সেই কারণে ভারসাম্যের এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকের স্কুলে যাওয়া এবং পড়াশোনা নিশ্চিত করতে হবে। সবার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে।’’

অমর্ত্য সেনের মতে, ঢিলেঢালা প্রশাসনিক পরিষেবা এবং অপর্যাপ্ত সামাজিক পরিকাঠামোই দেশের বৃদ্ধির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই দুই বাধা সরে গেলেই দেশ এগোবে বলে মনে করেন তিনি। গত কয়েক দশকের ঠিক কোন সময় ভারতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি দেখে তিনি আশাবাদী হয়েছিলেন? এক দর্শকের করা এই প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্যবাবু বলেন, ‘‘সে ভাবে কখনও আশাবাদী হইনি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি দেখে যতটা নিরাশাবাদী হয়েছি, তা আগে কখনও ছিলাম না।’’ এই নৈরাশ্যের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এক দিকে, ধর্ম ও জাতপাতের ভেদাভেদ। অন্য দিকে, শিক্ষার ব্যবস্থা, সকলকে স্কুলে পাঠানো, স্বাস্থ্য পরিষেবা, সামাজিক পরিকাঠামো ইত্যাদি কোনও ক্ষেত্রেই বর্তমান নীতি নির্ধারকদের কোনও সুস্পষ্ট নীতি নেই। তা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন সমস্যাগুলি দূর করার পরিকল্পনাও করা সম্ভব নয়। তাই নিরাশা গ্রাস করছে।

তবে এখানেই শেষ করেননি অমর্ত্য সেন। তার কথায়, ‘‘আমি দেশের উন্নয়নের জন্য সওয়াল করি। আমার ভাবনা চিন্তার কথা বলি, লিখি। ভাবি, যে সব কথা বলছি সে সব পরামর্শ শুনলে হয়তো দেশের কিছু উন্নতি সম্ভব। আর এই সওয়াল আশা নিয়েই।’’ 


সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


বিডি-প্রতিদিন/ ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর