২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১০:১৪

একুশে'র আবেগে মিশে গেল দুই বাংলা

অনলাইন ডেস্ক

একুশে'র আবেগে মিশে গেল দুই বাংলা

পেট্রাপোল: তখন ভোর ৬টা।

বেনাপোল সীমান্তে হাজির ঢাকার পলি মৈত্র। সকাল ৮টা নাগাদ মিলল ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ ঢোকার অনুমতি। মুখে যেন বিশ্ব জয়ের হাসি!

উল্টোদিকে পেট্রাপোল সীমান্ত। একুশের ডাকে সেখানেও সকাল-সকাল চলে এসেছেন পার্থসারথি দে। বনগাঁর সাংস্কৃতিক কর্মী।
কেউ মুখে জাতীয় পতাকার ছবি আঁকাচ্ছেন। কারও চোখে জল। কেউ গান গাইছেন। কেউ আবৃত্তি করছেন।

ভাষা উৎসবের টানে রবিবার পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তে এবং ভারত-বাংলাদেশের ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ মিশে গেলেন দুই বাংলার মানুষ। পলির মতো ও পারের হাজার হাজার মানুষ যেমন সেখানে হাজির হয়েছিলেন, তেমনই ভিড় জমেছিল এ পার থেকেও। পলি তো বলেই দিলেন, ‘‘বহু দেশে ঘুরেছি। কিন্তু বছরের এই দিনে এখানে আসব না!’’ পার্থসারথিবাবুর কথায়, ‘‘যে ভাষায় কথা বলি সেই টানেই ছুটে আসি। আমাদের দেশে তো ভাষাটা এখন মৃতপ্রায়!’’

বেনাপোল সীমান্তে বাঁধা হয়েছিল মঞ্চ। নাম ‘দুই বাংলার মিলনমেলা মঞ্চ’। সামনের যশোহর রোডে তৈরি করা হয় বড় বড় তোরণ। সেখানে লেখা, ‘বিশ্বজুড়ে বাংলাভাষা ছড়িয়ে পড়ুক’।

ওপার বাংলার দূরদূরান্ত থেকে বড় বড় মিছিল আবেগ নিয়ে ছুটে আসছিল অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে। জাতীয় পতাকাও বিক্রি হচ্ছিল দেদার। মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে ‘ডিউটি’ করছিলেন যশোহর পুলিশ লাইনের কর্মী আসজাল। এ বারই প্রথম এখানকার ভাষা উৎসবে এসেছেন তিনি। উন্মাদনা দেখে প্রায় ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা স্কুলের পোশাক পড়ে সাতসকালেই সেখানে হাজির। তানিমা নামে এক স্কুলছাত্রীর কথায়, ‘‘সকালে উঠে প্রথমে স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাদের দেশের নিয়ম মেনে মাতৃভাষার অনুষ্ঠানের পর সোজা বেনাপোল।’’

মাঝে এই অনুষ্ঠানে রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছিল। সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠান থেকে। এ বার এ রকম আবেগ কেন? বনগাঁর পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য বলেন, ‘‘এটা তো কোনও রাজনীতির জায়গা নয়। মাতৃভাষা সমস্ত মানুষের আবেগ। তাই আমরা সব মানুষকে একত্রিত করবার চেষ্টা করেছি। অনুষ্ঠানের সাফল্য এ জন্যই।’’

এপার বাংলা থেকে ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বাংলাদেশের তরফে ছিলেন সাংসদ মাহাবুবুল আলম হানিফ ও বেনাপোলের মেয়র আশরাফুল আলম লিটন। কোরান পাঠ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। দুই বাংলার ভাষাপ্রেমীদের কাছে লিটনের আবেদন, ‘‘আসুন, শপথ নিই বিনা প্রয়োজনে সজ্ঞানে আমরা যেন অন্য ভাষা ব্যবহার না করি। আমি স্বপ্ন দেখি এমন একদিন আসবে, যে দিন বিশ্বের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতে পেরে নিজেদের গর্বিত মনে করবেন।’’

গোটা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর কথা নানা ভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কথায়,‘‘ এখানকার ভাষা উৎসব আমাকে অন্তর থেকে টেনে আনে। দুই বাংলার মানুষের হৃদয় কাঁটাতার দিয়ে যে বেঁধে রাখা যায় না, তা এখানে না এলে বোঝা সম্ভব নয়।’’

ঘণ্টা তিনেকের অনুষ্ঠান শেষে যশোহরের সেলিনা, তপনের মতো অনেকেই বাড়ি ফিরলেন তোখে জল নিয়ে। এসেছিলেন শুধু গান শোনাতে। কিন্তু মানুষের আবেগে মিশে গেলেন তাঁরাও। শিল্পীদের মধ্যে তীর্থ দাস বাউল তো বলেই ফেললেন, ‘‘পৃথিবীর অনেক প্রান্তে গান গেয়েছি। কিন্তু দু’দেশের মানুষ একই মঞ্চ থেকে গান শুনছেন এমন কখনও দেখিনি। ভাষাকে নিয়ে এতটা আবেগ থাকতে পারে, তা এই সীমান্তে না এলে জানতেই পারতাম না।’’

একুশের আবেগে ভেসেছে বনগাঁর পাশের মহকুমা বসিরহাটও। শনিবার রাত ১২টা বাজতেই পায়ে পা মিলিয়ে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে শহরের পথে নামেন বসিরহাটের মানুষ। মহকুমা ভাষা চর্চা পরিষদের উদ্যোগে বসিরহাট টাউন হল চত্বর থেকে মিছিলের আযোজন করা হয়। মানুষের গলায় ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ তখন রাতের আকাশ ভরিয়ে দিচ্ছিল। শহর পরিক্রমার পর মিছিল যায় শহরের রবীন্দ্রভবনের পাশে সূর্যকান্ত উদ্যানে। সেখানে গান-কবিতার মধ্যে দিয়ে ভাষা স্মারক স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

গোটা শহরের নানা জায়গায় দেখা গিয়েছে ভাষা দিবসের ব্যানার। মানুষের বুকে ব্যাজ, শহিদ বেদির ছবি। টাকিতে ইছামতীর পারে শহিদ বেদিতে মাল্য দান, গান, বক্তব্য, পত্রিকা-কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। ছিল প্রভাতফেরি। সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ভাষা দিবস পালন করা হয়। বসিরহাটের সাংবাদিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও টাউন হল চত্বরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

মহকুমা তথ্য সংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগেও অনুষ্ঠান হয়। এখানে মূলত লোক শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়। ইছামতীর পারে একুশে স্মারকের সামনে টাকি পুরসভার উদ্যোগে উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। উপস্থিত ছিলেন টাকির পুরপ্রধান সোমনাথ মুখোপাধ্যায় সহ বিশিষ্ট জনেরা। টাকি বিজ্ঞান চক্রের সদস্যেরা গান-কবিতায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সন্ধ্যায় টাকি পুর নাগরিক কমিটির উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়াও বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, মিনাখাঁ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ এবং হাড়োয়ার বিভিন্ন এলাকায় নানা সংগঠনের পক্ষে শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘অমর একুশে’ পালিত হয়।


সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর