ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে কৃষি খাতে। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের এখন মাথায় হাত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জমি চাষ, ফসল কাটা, পরিবহন, মাড়াই, ঝাড়াই ও সেচের জন্য ডিজেলচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে খরচ বৃদ্ধির ফলে ধান উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেচ খরচ এরই মধ্যে বিঘাপ্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। আসছে বোরো মৌসুমে বিপুল পরিমাণ ডিজেলচালিত সেচপাম্প ব্যবহারে এ খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন সেচ খরচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাবে পরিবহন খরচও। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের নায্য মূল্য পাবেন কি না তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে কৃষকদের ওপর। আর কৃষকদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা না গেলে তাদের ওপর চাপও পড়বে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যে, প্রতি বিঘা জমিতে সেচ ও চাষ দিতে দরকার হয় ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে এ বছর কৃষকের বিঘাপ্রতি ৩০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এতে মুনাফাও ৩ শতাংশ কমে যাবে। সাধারণত দেশের মোট চালের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। বোরো আবাদ অতিমাত্রায় সেচনির্ভর। ফলে এ ধান চাষে মোট খরচের প্রায় অর্ধেকই ব্যয় হয় সেচকাজে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এ বছর ৪৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর ৭০ শতাংশ বা ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর (২ কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার বিঘা) জমিতে সেচ দেওয়া হবে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে। এ হিসাবে কৃষকের বাড়তি খরচ গুনতে হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখের বেশি টাকা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলছে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ। আর কিছুদিনের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের জমিতে সেচ দেওয়া শুরু হবে। রাজশাহীর পবা উপজেলার কৃষক সরকার দুলাল মাহবুব। প্রতি বছর বোরো ধানের চাষ করেন। তিনবারের সেচে তার খরচ পড়ত ৮৫০ থেকে ১০০০ টাকা। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এখন সেই খরচ বেড়ে হবে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে সেচ, সার সবকিছুর দাম বাড়ায় ধান চাষে সেচের খরচ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।’ চারঘাট উপজেলার পশ্চিম ঝিকরার মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আগে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে ১০৫০ থেকে ১২০০ টাকা লাগত। এখন দিতে হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। প্রতি বিঘায় ২৫০ টাকা খরচ বেড়েছে।’ এলাকাভেদে সেচ খরচ বিঘাপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে এখনই। পুরো মৌসুম শুরু হলে তা আরও বাড়বে, বলছেন চাষিরা। বিশেষ করে বোরো চাষিদের এবার অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে শুধু সেচ খরচে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল ওয়াদুদ জানান, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানির ৬৫ শতাংশই ডিজেল। কৃষকদের একটা বড় খরচ সেচকাজ। সেখানে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। হঠাৎ দাম বাড়ায় প্রভাব পড়ছে শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদনে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে সরাসরি কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ ডিজেল ব্যবহার হয় পরিবহন ও কৃষিতে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে। এর সবগুলোরই দাম বাড়বে।
কৃষকদের বিগত বছরে প্রতি একরে বোরো আবাদে কমপক্ষে ৪ বার সেচ দিতে খরচ হতো ৪ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি হেক্টরে তাদের ব্যয় হতো ১০ হাজার টাকার কিছু বেশি। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি একরে খরচ হবে ৪ হাজার ৩০০ টাকা। প্রতি হেক্টরে ৩০০ টাকা বেশি খরচ হলে রংপুর অঞ্চলে ৮ লাখ হেক্টরে কৃষকদের সেচ বাবদ বাড়তি খরচ হবে ২৪ কোটি টাকার বেশি। এদিকে রংপুরের হিমাগারগুলোতে এখনো ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আলু মজুদ রয়েছে। দাম না বাড়লে এই আলুর ভবিষ্যৎ কী হবে কেউ বলতে পারছেন না। ডিজেলের দাম বাড়ায় আলু আবাদে কৃষকদের বাড়তি খরচ পড়বে ৯০০ টাকা। আলুর মৌসুমে কৃষকদের চারবার সেচ দিতে হয়। চারবার সেচে আগে এক একর আলু আবাদ করতে খরচ পড়ত ৬৬০ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে খরচ পড়বে ৮৪০ থেকে ৯০০ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি হেক্টরে বাড়তি খরচ পড়বে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। রংপুরের বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা জানান, প্রতি মণ আলু উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। তেলের দাম বাড়ায় তাদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। ফলে তাদের লোকসানের বোঝা বইতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, দেশের ১ কোটি ২৩ লাখ কৃষক ডিজেলচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে সেচকাজ পরিচালনা করেন। বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণে এ বিপুলসংখ্যক কৃষক উদ্বেগের মধ্যে পড়বেন। বিএডিসির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের প্রায় ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। এখনো জমিতে সেচ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগভীর নলকূপের প্রাধান্য রয়েছে। ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়েই জমিতে পানি সরবরাহ করা হয়। মোট সেচকৃত এলাকার ৪৭ শতাংশ জমিতে সেচ প্রদানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র। আর বাকি ৫৩ শতাংশ জমিতে পানি দিতে ব্যবহার করা হয় ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র। গোটা কৃষি খাতে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সেচকাজে। গত অর্থবছরে প্রায় ১৬ লাখ সেচযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ডিজেলে চলেছে ১২ লাখ ৪৪ হাজার। এ ছাড়া কৃষিপণ্য পরিবহনে ডিজেলের ব্যবহার রয়েছে। ফলে চলতি রবি মৌসুমে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আসছে বোরো মৌসুমে কৃষকরা জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রথম ধাক্কা খাবেন। এরই মধ্যে কৃষকদের আমন ধানে বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে। জমি চাষসহ নানা কাজে খরচও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে কৃষি উৎপাদনে ভর্তুকি দেওয়ার দাবি করছেন প্রান্তিক কৃষকরা। তাদের মতে, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বাড়বে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় ভর্তুকি না পেলে বহু কৃষকের চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ড. হুমায়ুন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে বিদ্যুতের প্রসার বৃদ্ধি পেলেও শ্যালো টিউবওয়েলের ৭০ শতাংশই ডিজেলচালিত। আবার যতগুলো ট্রাক চলে তার সবগুলোই চলে ডিজেলে। ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করায় ট্রাকের পাশাপাশি অন্য যানবাহনগুলোর ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রান্তিক কৃষকদের আমন মৌসুমে যে ঋণ পাওয়ার কথা তা পান বোরো মৌসুমে। ফলে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা না করায় তাদের ওপরও চাপ পড়বে। আর এই মূল্য বৃদ্ধি অর্থনৈতিকভাবেও কাম্য নয়। করোনাকালীন সময় সবকিছুর ওপর চাপ পড়লেও কৃষকরাই অনেক কিছু সচল রেখেছিলেন। এখনো ৭০ শতাংশ মানুষ যেহেতু কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এ জন্য জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অবশ্যই পড়বে আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। [প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী কাজী শাহেদ এবং নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর নজরুল মৃধা]
বিডি প্রতিদিন/এএম