৫ জুলাই, ২০২৩ ২০:৩৫

কৃষি কর্মকর্তার ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার পথ দেখাচ্ছে বেকারদের

আবদুর রহমান টুলু,বগুড়া

কৃষি কর্মকর্তার ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার পথ দেখাচ্ছে বেকারদের

ভাঙ্গা বোতল, মাটির পাত্রসহ ফেলনা পাত্রে বগুড়ায় ছাদ বাগান গড়ে তরুণদের আগ্রহী করে তুলতে হাতে কলমে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। বগুড়ার নন্দীগ্রামে ফুল, ফল, ক্যাকটাস এমনকি ওষুধি গাছ থেকে শুরু করে সবজির বাগান গড়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তা আদনান বাবু গড়ে তুলেছেন ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার। এই সেন্টার থেকে শতশত মানুষ বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছাদ বাগান গড়ে সফলতা পেয়েছেন।

জানা যায়, বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলাটি কৃষিতে সমৃদ্ধ এক জনপদ। প্রধান ফসল ধান হলেও পিছিয়ে নেই আলু, সরিষা, মরিচসহ অন্যান্য সবজি ও ফল ফসল উৎপাদনে। বোরো, আউশ ও আমন ধান উৎপাদনে বগুড়া জেলায় অন্যতম শীর্ষে রয়েছে এই জনপদ। উচ্চমূল্যের ফসল স্ট্রবেরী, ড্রাগন, সৌদি খেজুর, ক্যাপসিকাম, মিশ্র ফলবাগান, বারোমাসি তরমুজের আবাদ নন্দীগ্রামের কৃষিকে দিয়েছে এক ভিন্নমাত্রা। এরই মধ্যে নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আদনান বাবু ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। এই সেন্টারে ফেলনা পাত্রে নিজ পরিবারের জন্য সবজির যোগান ও ছাদ বাগান থেকে আয় করার বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনামূল্যে এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে যে কেউ। ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি তাদের ছাদে বাগান গড়ে সফলতা পেয়েছেন। 

বগুড়ার নন্দীগ্রামের কৃষি অফিসের ছাদে স্থাপিত ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টারটি গড়ে তোলেন উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আদনান বাবু। উদ্ভাবনী এই কৃষি উদ্যোগ স্থাপন করা হয় ২০২১ সালের অক্টোবরে। এই ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টারে বিভিন্ন ধরনের দেশী-বিদেশী ফল, ফুল, সবজি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাগানো হয়েছে। প্রতিটি গাছের নামসহ বিশেষ গুনাগুণ বৈশিষ্ট্যসহ নেম প্লেট লাগানো রয়েছে। যেখানে একজন দর্শনার্থী একা একা ঘুরে নানা কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারবেন। রয়েছে গাছ বা বাগান গড়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ কর্ণার। যে কোনো দর্শনার্থী খুব সহজেই বিভিন্ন উপকরণ সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানলাভ করতে পারবেন। এছাড়াও পরিত্যক্ত বোতলে পিয়াজ চাষ, খালি বস্তা ব্যবহার করে খুব সহজেই আদা, হলুদ চাষের অভিনব প্রযুক্তিগুলোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ছাদে রয়েছে সবজি কর্ণার, ফুলের কর্ণার এবং ফলের কর্ণার। সবজি কর্ণারে লাগিয়েছেন করলা, চিচিঙ্গা, টমেটো, বেগুন, মরিচ, লাউ, ঢেঁড়শ, পেপে, শসাসহ প্রায় ২০ রকমসবজি। এই সবজিগুলোর মাচা তৈরী করা হয়েছে একটুি ভিন্নভাবে। স্বাভাবিক মাচার পরিবর্তে এখানে ইংরেজি ‘এ’ প্যাটার্নের মাচা তৈরী করা হয়েছে। এতে করে অল্প পরিসরে জায়গাতেই অধিক সবজি চাষ করা সম্ভব হয়েছে। ফুলের কর্ণারে শোভা ছড়াচ্ছে পয়েনসেটিয়া, অ্যাজিলিয়া, সিজিয়াম, বেলী, সাদা নয়নতারা, গোলাপী নয়ন তারা,কমলা রঙ্গন, লাল রঙ্গন, লালজবা, সাদা জবা, কমলা জবা, স্থল পদ্ম, বাগান বিলাস, পাতাবাহার, ক্যাকটাস, পর্তুলিকাসহ শোভাবর্ধনকারী হরেক রকম গাছ। ফলের কর্ণারে রয়েছে বারমাসী আম, অগ্নিশ্বরকলা, থাই পেয়ারা, দেশী মাল্টা, আমড়া, কামরাঙ্গা, লেবু, কদবেল, জাম্বুরা, সুইট লেমন, সরিফাসহ নানা প্রজাতির ফলগাছ। বিদেশী ফলগাছের উপস্থিতি ও চোখে পড়ার মতো। রয়েছে ড্রাগন, কমলা, চাইনিজ কমলা, ভেরি গেটেড মাল্টা ইত্যাদি। ছাদকৃষির পাশাপাশি মাঠ কৃষিরও নানা প্রযুক্তি এখানে রয়েছে। পোঁকা দমন, হলুদ আঠালো ফাঁদের ব্যবহার করে সহজেই উড়ন্ত পোঁকা দমন ব্যবস্থারও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এই ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টারে কৃষকদের পাশাপাশি প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেকেই আসছেন এবং তাদের ছাদকৃষিসহ কৃষির নানা প্রযুক্তি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আদনান বাবু জানান, এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক সেবা গ্রহীতা সেন্টারটি পরিদর্শন করেছেন। তারা এই সেন্টারটি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন এবং নিজেরাও ছাদকৃষি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। নন্দীগ্রামে ইতোমধ্যে সরিষাবাদের রইচ উদ্দিন, বুড়ইল দক্ষিণপাড়ার সেলিম রেজা, বড় চাঙ্গুইরের পলক কুমার সাহার বাড়ির ছাদসহ ৩০টি বাড়ির ছাদে এই সেন্টারের আদলে ছাদ কৃষির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া আরো বেশ কয়েকজন ছাদ কৃষি করে সফলতা পেয়েছেন। 

তিনি জানান, ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার গড়ার কারণ হলো প্রতিটি ব্যক্তি যেন নিজ পরিবারের সবজি ও অন্যান্য ফল, ফুল ছাদ থেকেই পেয়ে থাকে। এতে করে অর্থ বাঁচবে। যোগান বাড়বে। আর যারা বেকার আছেন তারাও উৎসাহিত হয়ে ছোট্ট পরিসরে কৃষি উদ্যাক্তা হতে পারবে। পরবর্তীতে মাঠে গিয়ে সফল উদ্যাক্তা হতে পারবে। এছাড়া তরুণরা আসছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। 

বড় চাঙ্গুইরের পলক কুমার সাহা জানান, প্রথমে ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্নজাতের ফুল ও ফলের চারা সংগ্রহ করে বাগান গড়েছেন। তিনি তার ছাদে লাউ, বিভিন্ন প্রকার শাক, ঢেড়স, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করেছেন। সবজির বাগান থেকে যে ফলন পান তা দিয়ে পরিবারে দু'দিন চলে যায়। একদিনে ২০০ টাকা করে হলে প্রায় দেড় হাজার টাকার সবজি মাসে কিনতে হয় না। ছাদ বাগানে বেশি সময় দিতে হয় না। অল্প খরচেই সবজির যোগান পাওয়া যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় বিষয় সবজিগুলো তাজা ও দূষণমুক্ত। যেটি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখছে। 

বুড়ইল দক্ষিণপাড়ার সেলিম রেজা জানান, ছাদে তার শুরু থেকেই ফুল ফল ছিল। কিন্তু ভালো প্রশিক্ষণ না থাকায় তিনি সফল হতে পারছিলেন না। পরে ছাদ কৃষিলার্নিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়ির ছাদে পেপে, চিচিঙ্গা, টমেটো, বেগুন, মরিচ এবং ফল ও সবজির চাষ করে পরিবারের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বাগানের বিভিন্ন গাছে মাঝে মাঝে পাখিও বসে। 

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত

সর্বশেষ খবর