করোনাভাইরাস নামক এক অদৃশ্য শত্রুর আঘাতে পুরো বিশ্ব আজ লণ্ডভণ্ড। আধুনিক প্রযুক্তি, মারণাস্ত্রের ভাণ্ডার, বিস্ময়কর জিডিপি, বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, চোখ ধাঁধানো মাথাপিছু আয়, আকাশ ছোয়া উঁচু উঁচু ভবন কিছুই কাজে আসছে না। চীনে উদ্ভূত এই মারাত্মক ভাইরাসটি সেদেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং শুধু চীন নয়; উত্তর কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান, ভারতসহ এশিয়ান দেশগুলোর সীমানা ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় প্রবেশ করে।
এছাড়া ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের দেশগুলোতে মৃত্যুর মিছিল চীনকেও ছাড়িয়ে যায়। আর আমেরিকাতে মৃত্যুর হার ইউরোপকেও হার মানায়। প্রান্তিক জনগণ থেকে শুরু করে বিশ্বনেতা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক কেউই করোনা ভাইরাসের ঝুঁকির বাইরে নেই।
বিশ্ব মিডিয়া করোনাকে নিয়ে যেভাবে ধারাবাহিক প্রচারণা চালাচ্ছে, সেই প্রচারণার সুবাদে আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি শুধু করোনা ভাইরাস না; যেকোন ভাইরাসের একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা হচ্ছে ভ্যাকসিন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সোস্যাল মিডিয়া ঘরে, বাইরে এমনকি আমলাপাড়া ও মন্ত্রীপাড়া সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে কবে আসবে করোনাভাইরাসের সেই কাঙ্ক্ষিত ভ্যাকসিন।
পৃথিবীর সর্বত্র আজ বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানীদের জয়জয়কার। তাহলে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বাজারে আসতে কেন এতো দেরি হচ্ছে। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীরা কি তাহলে করোনার ভয়ে গবেষণা বাদ দিয়ে ঘরে বসে ঘুমাচ্ছে? প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা ঘরে বসে নেই, তারা তাদের মনপ্রাণ দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে ভ্যাকসিন সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই আমাদের মানসপটে এরকম নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে। এই লেখার মাধ্যমে মূলত করোনা ভাইরাস এবং ভ্যাকসিনের খুঁটিনাটি সকল বৈজ্ঞানিক বিষয়কে সকল শ্রেণির পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে কয়েকটি ধাপে ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।
ভ্যাকসিন বিষয়টি বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে এন্টিজেন এবং এন্ডিবডি সম্পর্কে।
যখন বাইরে থেকে কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস বা অন্য কোন ক্ষতিকর বস্তু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই বাইরের বস্তুকে ধ্বংস করার জন্য এক প্রকার অস্ত্র তৈরি করে। এই অস্ত্রের নামই হচ্ছে 'এন্টবডি'। আর বাইরে থেকে যে ফরেইন পার্টিকেল আমাদের শরীরে ঢুকে তাকে বলা হয় 'এন্টিজেন'। ভ্যাকসিন বিষয়টি হয়তো যারা বিজ্ঞানের ছাত্র বিশেষকরে জীববিজ্ঞানের তারা খুব সহজেই বুঝতে পারেন কিন্তু যারা বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না তাদের বোঝার জন্য চলুন একটু সহজভাবে আমজনতার ভাষায় ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করি।
ধরুন একটি বাসায় অনেকগুলো ফ্ল্যাট এবং বাসার সামনে সিসি টিভি ক্যামেরা আছে কিন্তু কোন দারোয়ান না থাকার কারণে চোর এসে একটি ফ্ল্যাটে চুরি করে গেলো। এরপর বাসার মালিক সিসি টিভি ক্যামেরা দেখে চোরটিকে চিহ্নিত করে বুদ্ধি করে সতর্কতার অংশ হিসাবে বাসার সামনে একজন দারোয়ান বসিয়ে দিলেন এবং চোরের একটি ছবি দিয়ে দারোয়ান কে চিনিয়ে দিলেন, এখন যদি সেই চোরটি ওই বাসার অন্য ফ্ল্যাটে চুরি করতে আসে তাহলে কিন্তু দারোয়ান চোরটিকে খুব সহজে চিহ্নিত করে হাতেনাতে ধরে ফেলে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলতে পারবে। গল্প শেষ চলুন ভ্যাকসিন ব্যাপারটিকে গল্পের সাথে মেলানোর চেষ্টা করি। ভ্যাকসিন বিষয়টি ঠিক এভাবেই কাজ করে। অর্থাৎ যদি কারো ভাইরাসজনিত রোগ হবার আগে আমরা তার শরীরের ভিতর বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেই নির্দিষ্ট ভাইরাসকে রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম(inactivated) করে ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে কিংবা মুখ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি, কিংবা সেই ভাইরাস কে অকার্যকর (inactivated) করে অন্য কোন কৌশলে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি, তাহলে সেই ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢুকবে ঠিকই, কিন্তু যেহেতু আমরা ওই ভাইরাসকে রোগ তৈরিতে অক্ষম করে শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে তাই শরীরে কোনো রোগ তৈরী হবেনা, তবে ভাইরাসটিকে আমাদের শরীরের ইমুনো সিস্টেম এন্টিজেন হিসাবে চিহ্নিত করবে এবং সেই এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এক প্রকার এন্টিবডি (গল্পের দারোয়ানের ন্যায়) তৈরী হবে এবং মেমোরি সেল তৈরী হয়ে শরীরের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিনের জন্য থেকে যাবে। ভবিষ্যতে যদি পরিবেশ থেকে নাক দিয়ে কিংবা মুখ দিয়ে কিংবা অন্য যে কোনো উপায়ে ওই প্রজাতির ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে সেই ভাইরাস কোনো রোগ তৈরি করতে পারবেনা, কারণ ভাইরাস প্রবেশ করার সাথে সাথে পূর্বে তৈরি হওয়া এন্টিবডি আমাদের গল্পের দারোয়ানের ন্যায় মেমোরি সেলের সহায়তায় সেই ভাইরাস কে চিনে ফেলবে, এবং ভাইরাস কে ধ্বংস করে দিবে। রোগ তৈরী হতে দিবে না। সুতরাং ভ্যাকসিন হচ্ছে এক প্রকার জৈব রাসায়নিক উপাদান যা বিভিন্ন জীবাণুকে যথা ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়াকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম করে তৈরী করা হয়, এবং তা ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে কিংবা মুখে খাইয়ে শরীরে প্রবেশ করানো হয়, এবং তা ইমিউন সিস্টেম কে উত্তেজিত করে এন্টিবডি তৈরি করে, এবং সেই নির্দিষ্ট প্রজাতির ভাইরাস কিংবা ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে ভবিষ্যতে রোগ তৈরিতে বাধা প্রধান করে থাকে। এই ভ্যাকসিন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
যেমন ১. Live atteneuated vaccine অর্থাৎ জীবন্ত ভাইরাসকে দুর্বল করে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ২. Killed vaccine অর্থাৎ ভাইরাসকে অকার্যকর করে মেরে ফেলে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ৩. Subunit vaccine অর্থাৎ ভাইরাসের কোনো প্রোটিন অংশ কেটে দেহে প্রবেশ করানো হয়।
এই লেখাটি যখন লেখছি সেই সময় পর্যন্ত পুরো বিশ্বে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ৯০ টি বায়োফার্মা কোম্পানি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবের গবেষকরা বিভিন্ন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে ৪টি ভ্যাকসিন এর এনিম্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে। মার্কিন কোম্পানি Moderna সর্বপ্রথম মানব শরীরে ট্রায়াল শুরু করেছে। আরো বেশ কিছু ভ্যাকসিন এর হিউমান ট্রায়াল শুরু হতে যাচ্ছে শীঘ্রই। তথ্যগুলো জেনে হয়তো অনেকেই মনের আনন্দে ভাবতে শুরু করেছেন ভ্যাকসিন তো আবিষ্কার হয়েই গেছে তাহলে আর চিন্তার কী? ভ্যাকসিনের উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে যাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা নেই তারা হয়তো চিন্তামুক্ত হতে পারেন কিন্তু আমরা যারা এই পদ্ধতি সম্পর্কে মলিকুলার লেভেলের জ্ঞান রাখি তাদের দুশ্চিন্তা এখনো শেষ হয় নাই। কারণ একটা ভ্যাকসিন ল্যাবে আবিষ্কার হবার পর থেকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী হতে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক ধাপ পার হতে হয়।
প্রথম ধাপে যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরি করা হবে, ল্যাবে সেই ভাইরাসের এর প্রোটোটাইপ অন্য প্রাণী যেমন - ইঁদুর, খরগোশ, গিনিপিগ, বা বানর এর শরীরে পরীক্ষা করা হয়, বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় এনিমেল ট্রায়াল। এই ধাপে দু'টি বিষয়ের প্রতি কঠোর নজরদারি করা হয় - ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা অর্থাৎ কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কিনা এবং সেটি ওই প্রাণির শরীরে সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। যেসব ভ্যাকসিন এই ধাপ পার করতে পারে, তাদেরকে দ্বিতীয় ধাপে হিউমান ট্রায়াল এর জন্য নির্বাচিত করা হয়। হিউমান ট্রায়াল তিন ধাপে করা হয়। হিউম্যান ট্রায়ালের প্রথম ধাপকে বলে ফেজ ট্রায়াল (১) এই ধাপে সাধারণত কয়েক ডজন সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে ভ্যাকসিনটি ইঞ্জেক্ট করে দেখা হয় ভ্যাকসিনটি মানুষের শরীরে ব্যবহার করার জন্য সেফ কিনা এবং ভ্যাকসিনটি আমাদের শরীরে সঠিক ইমিউনো রেসপন্স তৈরী করছে কিনা। দ্বিতীয় ধাপকে বলা হয় ফেজ ট্রায়াল (২) এই ধাপে কয়েকশো সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে, আর তৃতীয় ধাপ অর্থাৎ ফেজ ট্রায়াল(৩) এ কয়েক হাজার সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে ভ্যাকসিনটি ইনজেক্ট করা হয়। সবগুলি ট্রায়াল ফেজে কার্যকারিতা এবং সেফটি প্রমাণিত হলেই বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের অনুমোদন মিলে। এই ধাপগুলি সম্পন্ন করতে কয়েক বছর থেকে শুরু করে কয়েক যুগের বেশি সময়ও লেগে যেতে পারে। যেমন - ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সর্বসাকুল্যে ৬ বছর, জিকা ভাইরাসের ক্ষেত্রে ৭৩ বছর, চিকেনপক্স ৪২ বছর, হেপাটাইটিস বি ১৬ বছর, সার্স ভাইরাস ১৭ বছর এবং মার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে সময় লেগেছিলো ৮ বছর।মহামারীর বিস্তার ঠেকাতে যদি শর্টকাট পদ্ধতির আশ্রয় ও নেওয়া হয় তাহলেও আমাদেরকে বেশকিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পাবার জন্য। জানি অপেক্ষার প্রহর গুলো নিদারুণ কষ্টের তারপরও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আসুন অপেক্ষা এবং আশায় থাকি করোনার ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের সেই সুদিনের। আর এই অপেক্ষার সময় টুকু যতোটুকু সম্ভব সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে ঘরেই থাকি, স্বাস্থ্যবিধি গুলো গুরুত্বের সাথে মেনে চলি-অন্তত নিজেদের জন্য না হলেও, নিজের পরিবারের জন্য, দেশের জন্য-দশের জন্য....।
লেখকঃ শিক্ষক, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি- গোপালগঞ্জ।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন