ঢাকা, শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

করোনায় হার্ড ইমিউনিটি ঝুঁকিপূর্ণ
ডা. কদরুল হুদা ডালটন
ডা. কদরুল হুদা ডালটন

হার্ড ইমিউনিটি (Herd Immunity) হচ্ছে এক ধরণের ‘কমিউনিটি ইমিউনিটি’, যখন সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে কোন সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি (Immunity) তৈরি হয়। ফলে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই কিংবা দুর্বল, তাদেরকেও ওই রোগ হতে পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেয়া যায়। এপিডেমিওলজিস্টের ভাষায়, এই পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি, যা হার্ড প্রটেকশন (Herd Protection) নামেও অভিহিত।

হার্ড ইমিউনিটি দুটো উপায়ে অর্জন করা সম্ভব। এক, প্রতিষেধক (Vaccine) নিয়ে এবং দুই, রোগাক্রান্ত হয়ে। হার্ড ইমিউনিটির আরও কিছু নাম আছে, যেমন হার্ড ইফেক্ট ( Herd Effect), সোশ্যাল ইমিউনিটি, পপুলেশন ইমিউনিটি ইত্যাদি। যদিও সফল ভাবে হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হলে তা’ জনগণকে নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগ হতে সুরক্ষা দিতে পারে কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোভিড-১৯ করোনা রোগের ক্ষেত্রে আদৌ সফল হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব কিনা!

করোনার বিস্তার যখন শুরু হয়, তখন বস্তুতঃ কারোরই ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না। কোন বাঁধা না পেয়ে রোগটি দ্রুত গতিতে এক অঞ্চল হতে আরেক অঞ্চল, এক দেশ হতে আরেক দেশ এবং চূড়ান্তভাবে বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেয়। কোন কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা বা প্রতিষেধক না থাকার কারণে রোগটির বিস্তৃতি রোধ করতে দরকার এক বিশাল জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন বা হার্ড ইমিউনিটি।

যেমন ধরুন, দেশের ৮০% জনসংখ্যা কোন এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউন (রোগ প্রতিরোধী) হলে, প্রতি পাঁচজনের চারজনই রোগীর সংস্পর্শে এলেও ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হবে না। ফলে রোগ বিস্তার হবে না। একই ভাবে যারা ইমিউন নন, তাঁদেরও রোগীর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। কারণ এক বিশাল অংশ ইতোমধ্যে ইমিউন। এভাবে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য সংক্রমণ-প্রবণতার উপর নির্ভর করে ৫০% - ৯০% জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা দরকার।

কিন্তু প্রতিষেধক ব্যতিরেকে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এতো ব্যাপক ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করার চেষ্টা, বিশেষ করে কোভিড-১৯ করোনার মতো মারাত্মক রোগের ক্ষেত্রে, অত্যন্ত ঝুঁকি এবং চড়া মাশুলের কারণ হতে পারে। যদিও কোভিড-১৯ করোনা সুনামি ঠেকাতে অনেকেই হার্ড ইমিউনিটিকে প্রতিরোধী পন্থা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এটি সত্য যে, জলবসন্তের টিকা আবিস্কারের পূর্বে অনেকেই ইচ্ছাকৃত ভাবে এই রোগের সংস্পর্শে এসে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি করতো। জলবসন্তের মতো কিছু কম গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু কোভিড-১৯ করোনার পরিস্থিতি ভিন্ন। কোভিড-১৯ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মারাত্মক রোগ, যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে। প্রতিষেধক ছাড়া এসব চিন্তা তাই নিতান্তই বোকামি।

এক সময় হাম, মাম্পস, পোলিও, জলবসন্ত—এইসব রোগ সচরাচর দেখা যেতো। কিন্তু প্রতিষেধক প্রয়োগের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার ফলে এইসব রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক কম। মাম্পস প্রচণ্ড ছোঁয়াচে রোগ। এর রি-প্রোডাক্টিভ রেট ১০-১২, যাঁর অর্থ হলো একজন মাম্পস রোগী ১০-১২ জনের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে। মাম্পস রোগের জন্য হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে ৯২% জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা দরকার, যা প্রতিষেধক প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জন করা হয়।

অন্যদিকে মাম্পস থেকে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ-প্রবণতা কম, কিন্তু মৃত্যু-ঝুঁকি অনেক বেশি। এর রি-প্রোডাক্টিভ রেট ৩, যাঁর অর্থ একজন কোভিড-১৯ রোগী মোটামুটি ৩ জনকে সংক্রমিত করে। কোভিড-১৯ রোগের জন্য হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে ৭০% জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা দরকার। সুতরাং ৭০% জনসমষ্টিকে রোগাক্রান্ত করা হলে, তাঁকে আর যাই বলা হোক, ‘রোগ প্রতিরোধ’ বলা যায় না! চরম আশাবাদীরা যদি মনে করেন, শুধুমাত্র ‘অনেকটা নিরাপদ’ যুবক শ্রেণীদের সংক্রমিত করে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব, তাহলে তাঁদের চিন্তা করা দরকার, সেক্ষেত্রে দলে দলে রয়ে যাওয়া বয়স্ক এবং অপ্রাপ্ত-বয়স্কদের কী হবে, যাঁদের বিন্দুমাত্র ইমিনিউনিটি নেই!

প্রকৃত দৃশ্যপট আরও খারাপ। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুহার মোটামুটি ২%। যদি সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর ৭০% রোগাক্রান্ত হয়, তাহলে প্রতিটি দেশের সামষ্টিক মৃত্যুহার হবে প্রায় ১.৫%, যা নিঃসন্দেহে মারাত্মক বিপর্যয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হিসেব করলে, এখানে জনসংখ্যা আনুমানিক ১৮ কোটি। এর মধ্যে ৭০% কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর সংখ্যা হবে ১২ থেকে ১৩ কোটি। বর্তমান মৃত্যুহার অনুযায়ী মারা যাবে ২৫ লাখের বেশি। আর যদি ১০% রোগীকেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, তা হলে চিন্তা করুন, গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। মৃতের সংখ্যাও বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। তাই দুঃখজনক হলেও সত্য, হার্ড ইমিউনিটি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর বিরুদ্ধে সঠিক সমাধান নয়।

কিছু কিছু ভাইরাসের এন্টিবডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যোগান দেয়, যদিও বিষয়টি সার্বজনীন নয়। অন্যান্য করোনা ভাইরাসের উপর গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা হয়, সার্স-কোভ-২ এন্টিবডি কিছু সুরক্ষা দিতে পারে। অর্থাৎ একবার আক্রান্ত হলে পুনরায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম, কিংবা আক্রান্ত হলেও তেমন মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিবে না, কিংবা আদৌ আক্রান্ত হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের সম্যক ধারণা নেই, যেমন ধারণা নেই এই এন্টিবডি ঠিক কতদিন পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে! অন্যান্য ভাইরাস (যেমন ফ্লু) সময়ের সাথে সাথে মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তন ঘটায়। ফলে এসব ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, তা স্বল্পকালীন ইমিউনিটি দেয়—ফ্লু’র ক্ষেত্রে যা এক বছরের কম। যদি সার্স-কোভ-২ অন্যান্য করোনা ভাইরাসের মতো আচরণ করে, তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি, আক্রান্ত হবার পর এইসব ব্যক্তি মাস থেকে বছর পর্যন্ত ইমিউনিটি পেতে পারে, তবে সম্ভবতঃ সারা জীবনের জন্য নয়।

সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে—হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের লক্ষ্যে (কিংবা বিনা লক্ষ্যে) লকডাউন শিথিল করা। আর যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে কিংবা করোনা রোগ বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে চলাফেরা করা হয়, তাহলে ভাইরাসটি মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সংক্রমিত করতে পারে। ফলশ্রুতিতে হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের সঙ্কট দেখা দিবে, যা মৃত্যুহার অনেক বাড়িয়ে দিবে।

সবচেয়ে ভাল হয়, সংক্রমণের বর্তমান মাত্রা বজায় রাখা—এমন কী, সম্ভব হলে সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে ফেলা—অন্ততঃ যতদিন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক পাওয়া না যায়। এর জন্য দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যেখানে সকলে ফিজিক্যাল এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং অব্যাহত রাখবে কিছু সময়ের জন্য—হতে পারে তা এক বছর বা আরো বেশি সময়—যতক্ষণ না মানসম্পন্ন প্রতিষেধক সহজলভ্য হয়।

সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হচ্ছে এ দুটোর মাঝামাঝি, যেখানে সংক্রমণের হার সময়ের সাথে সাথে উঠা-নামা করে। অর্থাৎ যখন সংক্রমণের সংখ্যা কমে যায়, তখন লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব শিথিল করা, আর সংক্রমণ বেড়ে গেলে এসব ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত বড় রকমের মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রয়োজন সময় সাপেক্ষ প্রচেষ্টা। বৈশ্বিক মহামারীতে কোন কিছুর পূর্ভাবাস দেয়া কঠিন। পরিস্থিতি দিন দিন এতবেশি পরিবর্তিত হয় যে, গেলো সপ্তাহের ধারণা দিনশেষে মিথ্যে হয়ে যেতে পারে। ভাগ্যক্রমে, কোভিড-১৯ বিস্তার প্রতিরোধে কিছু পন্থা সকলের জানা আছে।

সুতরাং ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন এবং যতটা সম্ভব শারীরিক এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।

লেখক: গবেষক  ও সাবেক এমডি ইডিসিএল।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর