ঢাকা, বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কোটি টাকার খেজুরের গুড় উৎপাদনের টার্গেট নাটোরে
নাটোর প্রতিনিধি

চলছে হেমন্তকাল। শীত মৌসুম আসতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি। এরইমধ্যে নাটোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে শীতের আমেজ। রাতে ঠান্ডা-হিমেল বায়ু আর সকালের শিশির ভেজা ঘাস-পাতাই জানান দিচ্ছে শীতের আগমনি বার্তা।

সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে গাছিদের খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্ততি। পাশাপাশি চলছে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিকারী গাছীদের নিয়ে কর্মশালাও। আর গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক মধু বৃক্ষ খেজুর গাছ পরিচর্যা-পরিস্কারসহ রস সংগ্রহের উপযোগী করতে প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরাও।

আর মাত্র কয়েকদিন পরেই পাওয়া যাবে মিষ্টি মধু সেই কাংখিত খেজুরের রস। যার ঘ্রাণে মৌ মৌ হয়ে উঠবে পুরো এলাকার বাতাস। গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হবে খেজুরের মিষ্টি রসকে ঘিরে। পুরো শীত মৌসুম জুড়ে চলবে সু-স্বাদে ভরা বিভিন্ন ধরনের পিঠা উৎসব।

এছাড়া পায়েস-পুলিসহ নানা রকম খাওয়ার আয়োজনতো রয়েছেই। শীতের মৌসুমে খেজুরের রস ও গুড়সহ পিঠা খেতে শহর থেকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসেন অনেকেই। শীতের সকালের রৌদ্রে খেজুরের রস ও মুড়ি খাওয়ার আসর বসে বাড়ির আঙ্গিনায়। শীত মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশে খেজুরের গুড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। সেই প্রতিক্ষায় আছেন গ্রামের মানুষ।

নাটোর জেলার সব উপজেলাতেই খেজুর গাছ থাকলেও লালপুর উপজেলায় তুলনামুলক খেজুরের গাছের সংখ্যা ও গুড় উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। এরপরেই রয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলা। তবে বড়াইগ্রাম উপজেলায় খেজুরের গাছ ও গুড় উৎপাদনের পরিসংখ্যান নেই।

এরপরও বড়াইগ্রামে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিকারী অর্ধশতাধিক গাছীদের নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

এদিকে লালপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দশটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা অঞ্চলে সড়ক ও রেললাইনের দুই পাশে, জমির আইল, বাড়ির আঙ্গিনায় ছড়িয়ে আছে প্রায় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ খেজুরের গাছ। এসব গাছ থেকে গুড় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন। খেজুর গাছের রস সংগ্রহর উপর প্রায় ৩ হাজার পরিবার নির্ভরশীল।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় মোট খেজুর গাছ রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৯০টি। এরমধ্যে রস সংগ্রহের উপযোগী গাছ রয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি। শীত মৌসুমে ৭৫ দিনে প্রতিটি গাছ থেকে ১৭৪ কেজি রস পাওয়া যায়। আর প্রতিটি গাছের রসে গুড় উৎপাদন হয় ১৭ দশমিক ৪০ কেজি। জেলায় প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ৯ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন (৯৬ লাখ ২৩ হাজার ৮৬২ কেজি) খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছর নাটোর জেলায় ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। গত মৌসুমে প্রায় শত কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন হয়েছে।

অন্যদিকে উপজেলা পর্যায়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জেলার লালপুর উপজেলায় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি খেজুর গাছে প্রতি বছর গুড় উৎপাদন হয় প্রায় ৫ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রাম উপজেলায় ১ লাখ ৬ হাজার গাছে গুড় উৎপাদন হয় ১ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৭৫ হাজার ৯৪০ খেজুর গাছে গুড় উৎপাদন হয় ১ হাজার ৩২ মেট্রিক টন, সদর উপজেলায় ৪৪ হাজার গাছে  ৫৯৮ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৬ হাজার গাছে ৯১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন, সিংড়া উপজেলায় ৬০ হাজার গাছে ৭৬৫ মেট্রিন টন ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ২১ হাজার ৩৫০টি গাছে গুড় উৎপাদন হয় ৩৪৪ মেট্রিক টন। জেলায় অন্তত ১০ হাজার মানুষ খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, কেবল শীতকাল আসলেই অযত্নে ও অবহেলায় বেড়ে উঠা এই খেজুর গাছের কদর বাড়ে। খেজুরের গাছ অন্য কোন ফসলের ক্ষতি করে না। এই গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ গুনতে হয় না। ঝোপ জঙ্গলে কোনো প্রকার যত্ন ছাড়াই বেড়ে উঠে খেজুর গাছ। শুধুমাত্র শীত মৌসুম আসলে নিয়মিত পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করতে হয়। খেজুর গাছ মিষ্টি রস দেয়।

প্রতিদিন একজন গাছি প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে থাকেন। একজন গাছি শীত মৌসুমে ৭০ থেকে ৭৫ দিনে একটি খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন। এছাড়া খেজুরের পাতা দিয়ে মাদুর তৈরিসহ খেজুরের গাছ কেটে ঘর তীর তৈরি করা হয়।

এ বিষয়ে নলডাঙ্গার বুড়ির ভাগ গ্রামের আহাদ আলী জানান, প্রতি বছর তিনি অন্তত ৭০ থেকে ৮০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতেই গুড় তৈরী করে বাজারে বিক্রি করেন। কোনো কোনো সময় বাড়ি থেকেও গুড় বিক্রি হয়। হলুদঘর গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, প্রতি বছর প্রায় ১০০টির মত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। গত বছরের তুলনায় এবার আরো ২০টি গাছ বেশি প্রস্তত করছেন। তিনি বলেন, খেজুরের গুড় তৈরী ও বিক্রি করে তার সংসার ভালোই চলে।

লালপুর, বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে গাছিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, খেজুরের গুড় ও রসের চাহিদা যেমন আছে। পাশাপাশি দামও ভালো পাওয়া যায়। তবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাত করা গেলে এই গুড় শুধু দেশে নয়, বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এজন্য সরকারি ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার বলেন, আমরা কৃষকদের খেজুরের গাছ লাগানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। যা কৃষকদের রস ও গুড়ের চাহিদা মিটাবে। এছাড়া খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে সংসারের আর্থিক সচ্ছলতা বয়ে আনবে।

একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বলেন, এক সময় খেজুরের গাছের পরিমান বেশি ছিল এবং গুড়ও উৎপাদন বেশি হতো। আর খেজুরের গুড়ের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। কেননা এই গুড়ের স্বাদ একটু ভিন্ন ও মজাদার। পিঠা-পায়েস থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই খেজুরের গুড়ের ব্যবহার বেশি হয়। এছাড়া খেজুরের রস দিয়ে সকালে মুড়ি খাওয়া, রস জ্বাল দিয়ে ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। এজন্য খেজুরের রস ও গুড় আমাদের একটা ঐতিহ্যও বটে।

কিন্তু কালের বিবর্তনে গাছের সংখ্যা অনেকটা কমে গেছে। তবে কৃষি বিভাগ থেকে খেজুর গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাঙ্গালীর এই ঐতিহ্য ধরে রাখা সহ অর্থনৈতিক সম্ভার ফিরিয়ে আনতে সকলকে খেজুর গাছ লাগানোর প্রতি নজর দেয়া উচিত। সেই বিবেচনায় কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের পাশাপাশি এই বিষয়টির প্রতি কৃষি বিভাগ থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বলে জানান তিনি।  

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, খেজুরের রস ও গুড় দু’টোই মানুষের কাছে খুব প্রিয় জিনিস। খেজুরের রস ও গুড়কে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার মানুষ খেজুরের রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে নিরাপদ গুড় উৎপাদন, সঠিক ভাবে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এ খাত লাভজনক পর্যায়ে পৌছে যাবে। এজন্য ভোক্তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে, খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনে গাছিদের সঠিক ধারণা দিতে হবে। 

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ সজাগ আছে এবং খেজুর গাছ রোপনে মানুষকে উৎসাহিত করতে সর্বচ্চো চেষ্টা চালানো হবে।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর