ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বড় দানাবিশিষ্ট উচ্চ ফলনশীল সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন
খায়রুল ইসলাম, গাজীপুর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) কর্তৃক ‘বিইউ সয়াবিন-৫’ নামে সম্প্রতি সয়াবিনের একটি জলাবদ্ধতাসহনশীল, স্বল্পজীবনকাল ও দেশের সবচেয়ে বড় দানাবিশিষ্ট উচ্চফলনশীল সয়াবিনের একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। 

বশেমুরকৃবি সূত্রে জানা গেছে, তাইওয়ানের এশিয়ান ভেজিটেবল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং দেশের নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর এলাকা থেকে প্রায় ২০০ জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে ২০০৬ সাল থেকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে সয়াবিন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বশেমুরকৃবি এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগ। এ পর্যন্ত সয়াবিন উৎপাদনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ছয়জন পিএইচ.ডি ও আঠারজন ছাত্র-ছাত্রী এম.এস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায়শই সয়াবিনের পরিপক্বতার প্রারম্ভেই সাইক্লোনের জন্য আকষ্মিক অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়। ফলে পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় এবং সয়াবিনের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। সে জন্যই উপকূলীয় অঞ্চলের সয়াবিন চাষীদের দীর্ঘদিন যাবত স্বল্পজীবনকাল ও জলাবদ্ধতাসহনশীল জাতের চাহিদা ছিল। সে লক্ষেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবত নিবিড় গবেষনা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, AVRDC থেকে সংগৃহীত BD2334 জার্মপ্লাজমটি উচ্চ ফলনের পাশাপাশি সাতদিন যাবত জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। 

জাতটি উদ্ভাবন টিমের প্রধান প্রফেসর ড. আব্দুল করিম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষকপর্যায়ে এর সঠিকতা যাচাই করার জন্য নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জাতটির মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সম্পৃক্ত করে রবি ও খরিপ দুই মৌসুমেই চাষ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদী এ গবেষণায় আর্থিক সহযোগিতা করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বশেমুরকৃবি'র গবেষণা উইং। কৃষকের মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় বিভিন্ন আঙ্গিকে সহযোগিতা করেছে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া নামে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ। সংশ্লিষ্ট কৃষক ও গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে ইউ২৩৩৪ জার্মপ্লাজমটি বিইউ সয়াবিন-৫ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগে নিবন্ধন করা হয়। বিভিন্ন উপজেলায় জাতটির ফলন পাওয়া গিয়েছে ৩.৫ মে: টন। 

দেশের অন্যান্য জাতের জীবনকাল যেখানে ১০০-১১০ দিন সেখানে বিইউ সয়াবিন-৫ মৌসুম ভেদে ৭৫-৮৫ দিনেই পরিপক্ব হয়। ফলে সয়াবিনের ফল পাকার প্রাক্কালে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে আকষ্মিক জলাবদ্ধতা থেকে জাতটি রক্ষা পাবে। বিইউ সয়াবিন-৫ এর ১০০০-বীজের ওজন ২৮৫ গ্রাম, যা বাংলাদেশের বিদ্যমান যে কোন জাতের চেয়ে বেশী। জাতটির প্রোটিনের পরিমাণ ৩৮% এবং তেল ২০%। বাংলাদেশে এখনও পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবেই মূলত: সয়াবিন ব্যবহৃত হয়। তবে ইদানিং বিভিন্ন স্ন্যাকস, সয়ামিট বল ও সয়ামিল্ক হিসেবে এর ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সয়াবিনকে meat of the field বা meat without bone বলা হয়। কারণ সয়াবিনে প্রোটিন বা আমিষের পরিমান (৩০-৫৫%), যা অন্যান্য যে কোন ফসল, যেমন ডাল, তেল কিংবা দানাদার শস্যের তুলনায় অনেক বেশী। তাছাড়া সয়াবিনে ১৮-২০% তেল, ভিটামিন এ, বি, সি ও কে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ পদার্থ থাকে। এতে বিদ্যমান ভিটামিন ‘কে’ হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ উপযোগী। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য সয়াবিনের ব্যবহার বৃদ্ধি একান্ত আবশ্যক। 

উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে বশেমুরকৃবি এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগ থেকে বিইউ সয়াবিন-১ নামে খর্বাকৃতি ও অপেক্ষাকৃত কম সময়ে পরিপক্ব উচ্চ ফলনশীল এবং ২০২০ সালে বিইউ সয়াবিন-২ নামে উচ্চ ফলনশীল খরা সহিষ্ণু, ২০২৩ সালে বিইউ সয়াবিন-৩ এবং বিইউ সয়াবিন-৪ নামে ২টি লবণ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে- যা কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। 

সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় জানা গেছে, বশেমুরকৃবি কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী সয়াবিনের জাতসমূহ প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। তাছাড়া জাতগুলোর বীজের আকার দেশের প্রচলিত জাতের তুলনায় অনেক বড় হওয়ায় এবং জীবনকাল কম ও প্রোটিনের পরিমান উল্লেখযোগ্য হওয়ায় দেশের পশু ও মাছের খাবারের উপকরণ হিসাবেও জাতগুলোর ব্যাপক চাহিদা আছে। উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোনের কারণে হঠাৎ জলাবদ্ধ সৃষ্ট জমিতে সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন জাত বিইউ সয়াবিন-৫ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর