ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দুদকের গণশুনানি
জমির ক্ষতিপূরণ চেয়ে ৪০ বছর ধরে দুই সংস্থার দ্বারে দ্বারে
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে হল ভর্তি উৎসুক মানুষ। তিল ঠাঁই আর নাহিরে অবস্থা। পুরো হল মানুষে টইটম্বুর। শুনানি চলছে অভিযোগের। এমন সময় জায়গার ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হওয়া বন্দর এলাকার মিজানুর রহমান নিজের অভিযোগ বর্ণনা করতে লাগলেন। তার বর্ণনা শুনে পুরো হলে মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। মঞ্চে বসা শীর্ষ কর্মকর্তারাও অপলক চোখে থাকিয়ে আছেন তার দিকে।    

মিজান উচ্চকিত আওয়াজে কেঁদে কেঁদে পাশে বসা বৃদ্ধা মায়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এই বৃদ্ধা মহিলার কী অপরাধ ছিল। আজ ৪০ বছর ধরে তিনি বন্দর ও জেলা প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তিনি এখন মৃত্যুমুখে। অথচ যারা এই ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করেছে, বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের জামাই আদরে ভূমি দিয়ে পুনর্বাসন করেছে। আমাকে মায়ের গর্ভে রেখে মারা যান আমার বাবা। জন্মের পর থেকেই আমার মা ক্ষতিপূরণের আশায় জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে।’ অভিযোগের বর্ণনা প্রদানকালে ফুফিয়ে কেঁদে উঠেন তিনি। তখন মাকে জড়িয়ে ধরে মা-ছেলের কান্নায় পুরো হলের পরিবেশও ভারী হয়ে ওঠে।    

মিজানের মায়ের নাম নুর চেহের বেগম (৮৭)। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯৮০ সালে রেখে যাওয়া শেষ সম্বল ৩৬ শতক জমি অধিগ্রহণ করে বন্দর। নিজের বৈধ জমি হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসনের ভুলে ক্ষতিপূরণের টাকা পায় অন্যরা। সেখানে  বন্দর অন্যদের পুনর্বাসন করে বলেও অভিযোগ করেন মিজান। এরপর গত ৪০ বছর ধরেই নিজের ন্যায্য পাওনা বুঝে পেতে দিনের পর দিন ধরনা দেন সরকারি দুই দফতরে। এত বছর পরও এমন অভিযোগের নিষ্পত্তি না হওয়ায় হতবাক দুদক কমিশনারও।

আজ বুধবার সকালে চট্টগ্রামের সরকারি দপ্তরগুলো নিয়ে শুনানির আয়োজন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুনানি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক খান। শুনানিতে সরকারি ২২ সংস্থার বিষয়ে প্রায় ২০০ অভিযোগ জমা পড়ে। গতকাল ৪৭টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) একেএম সোহেল। উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয়  কার্যালয়ের পরিচালক মো. মাহমুদ হাসান ও চট্টগ্রাম মহানগর দুর্নীতি প্রতিরোধ  কমিটির সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী।          

অভিযোগ প্রসঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বলেন, বিষয়টি শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সম্পন্ন করে জেলা প্রশাসন। তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা ভুয়া কাগজ দেখিয়ে অন্যরা আত্মসাৎ করেছে। এ নিয়ে ৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও আছে, যা আদালতে বিচারাধীন। আইনগতভাবে বন্দরের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও মানবিক দিক বিবেচনা করে নূর চেহের বেগমের এক সন্তানকে বন্দরে চাকরি দেয়া হয়েছে।    

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর এ বৃদ্ধা আমার কাছে একাধিকবার এসেছিলেন। তাকে কিছু করার আশ্বাস দিয়েছি। মামলাটি বিচারাধীন হওয়ায় আমাদের কিছুই করার নেই। বিষয়টি আইনি নয়, মানবিক দিক বিবেচনা করতে হবে। তাই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা নুর চেহের বেগমকে দিতে পারি।’  

শুনানি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, দুদকে দায়ের করা ৭০ শতাংশ মামলায় অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। দুদক শুধু চুনোপুঁটি নয়, অনেক ক্ষমতাবানদেরও গ্রেফতার করেছে। যারা এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় শান্তি  ভোগ করছেন। একবার দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলে জীবদ্দশায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। 

তিনি বলেন, কেউ যেন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে নিজের অধিকারের অতিরিক্ত ভোগ করতে না পারে। দুর্নীতি যেই করুক না কেন তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে কোনো বাধা আসলেও পিছপা হবে না দুদক। দুদকের করা প্রায় সবগুলো মামলায় অপরাধীদের শাস্তি হয়। কারণ আমাদের আইনজীবীরা সঠিক তথ্য উপাত্ত আদালত উপস্থাপন করেন। আমরা এই ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা  করছি।

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর



এই পাতার আরো খবর