ঢাকা, রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

চট্টগ্রামে বন্যায় মানবিক বিপর্যয়
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

কোথাও মানুষ বন্দি পানিতে। কোথাও বাড়ি ঘর তলিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনেই। কোথাও প্রাণ নিয়ে ঘরবাড়ি ফেলে চলে যাচ্ছে। কোথাও গৃহপালিত পশু পানিতে ভেসে যাচ্ছে। কোথাও শিশুর কান্নায় আকাশ ভারী হচ্ছে। কোথাও চলছে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার আহাজারি। এভাবে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। গত দুই দিনের বন্যায় চট্টগ্রামের অন্তত আটটি উপজেলা পানির নিচে তলিয়ে যায়।

চট্টগ্রামের হালদা ও মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে নদীর পানি প্রবেশ করে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান, কর্ণফুলী ও হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব উপজেলার অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে মারা গেছেন একজন, নিখোঁজ আছে তিনজন।

চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার ছাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলায় কমবেশি পানিতে প্লাবিত হয়। এদের উদ্ধারে কাজ চলছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসন থেকে শুকনো খাবারসহ নানাভাবে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

নিহত ২ ও নিখোঁজ ৩

চট্টগ্রামের বন্যায় একজনের মৃত্যু এবং ৩ জন নিখোঁজ হয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলায় পানির স্রোতে নিখোঁজের একদিন পর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সামি (১২) নামে এক শিশুর। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সামি নিখোঁজ হয়। সামি দাঁতমারা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড সাদিনগরের ভাড়াটিয়া হামিদের পুত্র। তাছাড়া, ফটিকছড়িতে ছেলেকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিখোঁজ হন বাবা রজি আহমদের। পরে ছেলেকে পাওয়া গেলেও বাবার খোঁজ মিলেনি। রজি আহমদ ভূজপুরের ৭ নং ওয়ার্ডের সুলতান আহমদের ছেলে। অন্যদিকে, নারায়ণহাট ইউনিয়নের মির্জারহাটের হালদারকূলে বন্যায় আটকে পড়াদের বাঁচাতে গিয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া ইমরানের খোঁজ মিলেনি। ইমরান ইদিলপুর এলাকার তাজুল ইসলামের ছেলে।   

এদিকে, রাঙ্গুনিয়ার নিখোঁজ হওয়া মো. রনি (১৭) নামে এক কিশোরের এখনও সন্ধান মিলেনি। বৃহস্পতিবার বিকালে উপজেলা দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড ফুলবাগিচা গাবতল এলাকায় তিনি পানি দেখতে গিয়ে নিখোঁজ হন। রনি স্থানীয় আবু বক্করের ছেলে, পেশায় সিএনজি চালক।  

মিরসরাই

চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মিরসরাইয়ে ১২টি ইউনিয়নের সব কটি প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন ১২ হাজার পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্ধলাখ মানুষ। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা আমলীঘাট, করেরহাট, হিঙ্গুলী, বারইয়ারহাট পৌরসভা, মিরসরাই পৌরসভার নিম্নাঞ্চল, জোরারগঞ্জ, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, খৈয়াছড়া, ওসমানপুর, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন বলেন, মিরসরাইয়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। গ্রামীণ পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইতোমধ্যে ১৭০০ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের উদ্ধারে স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ৩০ টার অধিক স্পিড বোট আটকে পড়াদের উদ্ধারে কাজ করছে।

ফটিকছড়ি

ফটিকছড়িতে বাড়ি-ঘর ডুবে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের সবগুলোই প্লাবিত। পানিতে ডুবেছে উপজেলার মাইজভান্ডার-রাউজান সড়ক। হালদা নদী, সর্তা খাল, ধুরুং খাল, ফটিকছড়ি খাল, মন্দাকিনী খাল, গজারিয়া খাল, তেলপারি খাল, কুতুবছড়ি খাল, লেলাং খালসহ বিভিন্ন খালের বাঁধ ভেঙে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। ফটিকছড়ি পৌরসভা, নাজিরহাট পৌরসভা, সুন্দরপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, দাঁতমারা, বাগানবাজার, নারায়ণহাট, ভুজপুর, লেলাং, সমিতিরহাট, রোসাংগিরী, জাফতনগর, বক্তপুর, নানুপুরসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন।  

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ফটিকছড়ি দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী ও বেশকিছু খালের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি। ১৮টি ইউনিয়নের জন্য ১৮ জন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয় দিতে ৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সীতাকুন্ড

সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া এলাকায় শিকদার খালের মুখে বাঁধের প্রায় ১২ মিটার অংশ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৬ ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম। উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নে ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার জন পানিবন্দি আছে।

বাঁশখালী

বাঁশখালী উপজেলার ৮ ইউনিয়নের অনেক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় পানিবন্দি আছে ১ হাজার ৭৫০ পরিবারের ৮ হাজার ৭৫০ জন মানুষ। উপজেলায় গঠন করা হয়েছে ১৫টি মেডিকেল টিম।

রাউজান

রাউজান উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের বাসিন্দারা পানিবন্দি। পশ্চিম নোয়াপাড়া, মোকামীপাড়া, সাম মাহালদারপাড়া, ছামিদর কোয়াং, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া, উরকিরচর, মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা ও বৈইজ্জাখালি, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা, গহিরা, নোয়াজিশপুর, চিকদাইর, ডাবুয়াসহ কয়েকটি গ্রামে ৩২০ পরিবারের ১৬০০ মানুষ পানিবন্দি।

হাটহাজারী

হাটহাজারী উপজেলায় বন্যায় প্লাবিত হয়েছে বুড়িশ্চর, শিকারপুর, গড়দোয়ারা, দক্ষিণ মাদার্শা, উত্তর মাদার্শা, মেখল, পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ড, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী।

হাটহাজারীর ইউএনও এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, উপজেলার প্রায় ৮টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী রয়েছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ।

পটিয়া, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী

পটিয়া, বোয়ালখালী এবং কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন জায়গা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পটিয়া উপজেলার ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড মিলিয়ে ১৮ স্থানে ৬৯৪৬ পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বোয়ালখালী উপজেলায় ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড মিলিয়ে ৩ জায়গায় ১০০ পরিবারের প্রায় ৭০০ মানুষ পানিবন্দি আছে। কর্ণফুলী উপজেলায় ১০০ পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।

বিডি প্রতিদিন/এএ



এই পাতার আরো খবর