ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মজয়ন্তী উদযাপনে প্রস্তুত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:
ছবি- বাংলাদেশ প্রতিদিন।

দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, নোবেল বিজয়ী ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে আজ রবিবার থেকে তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় এবং জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এবার জাতীয় পর্যায়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান উদযাপন হচ্ছে কবির স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে। 

রবিবার দুপুরে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তিন দি ব্যাপী জাতীয় পর্যায়ের মূল এ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আবুল মনসুর। স্মারক বক্তব্য রাখবেন প্রফেসর সনৎ কুমার সাহা। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম সিমিন হোসেন রিমি এমপি। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। 

আলোচনা অনুষ্ঠানের পরেই রয়েছে ঢাকা এবং কুষ্টিয়ার স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জানা গেছে, শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পাশাপাশি একই সাথে রাজধানী ঢাকা, শাহজাদপুর, পতিসর, দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগ-এ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হচ্ছে। এদিকে জাতীয় পর্যায়ে মূল এ অনুষ্ঠান আয়োজনকে ঘিরে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীকে। কুঠিবাড়ীর গোটা আঙিনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নসহ মূল ভবন রঙ করা হয়েছে। শিলাইদহ কুঠিবাড়ী প্রবেশের রাস্তায় তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। কুঠিবাড়ী প্রাঙ্গনের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। অতিথিদের আসন গ্রহণের জন্য বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। 

শনিবার (৭ মে) বিকেল ৫ টার দিকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম সরেজমিনে শিলাইদহ কুঠিবাড়ী পরিদর্শন করেন এবং অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। 

পরিদর্শন শেষে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এ অনুষ্ঠানকে সাফল্য মন্ডিত করে তোলার জন্য এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলায় গড়ে তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে অতিথিদের আমন্ত্রণ পত্র পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের সার্বক্ষণিক মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনাসহ আমন্ত্রণপত্র সঙ্গে করে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। 

কুঠিবাড়ীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম বলেন, কুষ্টিয়ার প্রায় ৩০টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা এখানে অংশগ্রহণ করবেন। উদ্বোধনী দিনে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীসহ স্থানীয় শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। 

জানা গেছে, এশীয়দের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বসভায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ১৮৬১ খ্রিঃ ৭ই মে (২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ভাবনা ও অনন্য সাহিত্য কর্ম সৃষ্টিতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ীর রয়েছে বিশেষ অবদান ও পটভূমিকা। ঠাকুর পরিবারের জমিদারী পরিচালনার জন্য এখানে এসে তিনি ভালোবেসে ছিলেন ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লী শিলাইদহকে। এছাড়া আকৃষ্ট হয়েছিলেন এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য এবং প্রমত্তা পদ্মা নদী ও পদ্মার বুক থেকে বেরিয়ে আসা গড়াই নদীর প্রতি। ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লীর এই কুঠিবাড়ী এবং পদ্মা ও গড়াই নদীর বুকে রচিত হয়েছে কবির সাহিত্য কর্মের শ্রেষ্ঠাংশ। 

১৮৯১ সালে কবিগুরু জমিদারী পরিচালনার জন্য শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে আসেন। এই কুঠিবাড়ী থেকে তিনি পতিসর ও শাহজাদপুরের জমিদারী দেখাশুনা করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পদ্মা নদীর তীরে মস্তবড় বড় নীলকুঠি তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময় নীলের ব্যবসা ছেড়ে সাহেবরা চলে গেলে নীলকুঠির নীচতলা জমিদারীর কাচারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে নদীর ভাঙ্গনে ওই নীলকুঠি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে ১৮৯২ সালে পদ্মার তীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শিলাইদহ গ্রামে ৩২ বিঘা জায়গা নিয়ে তিন তলার বর্তমান এই কুঠিবাড়ীটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনার জন্য কবি শিলাইদহ গ্রামে থেকেছেন। 

পদ্মা-গড়াইয়ের মধ্যবর্তী স্থান ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারী এস্টেট। এই গ্রামের ছায়াঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে পদ্মা-গড়াই নদীর বুকে কবি বিমুগ্ধ চিত্তে সাহিত্যের অনন্য সব রচনা করেছেন। এখানকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কবি অগণিত প্রবন্ধ, কবিতা ও গল্প রচনা করে গেছেন। তাঁর এসব লেখনীর মধ্যে সোনার তরী, মানসসুন্দরী, উর্বশী, চিত্রা, ক্ষণিকা, গীতাঞ্জলিসহ অনেক গান ও কবিতা নিভৃত এই পল্লীর পরিবেশেই রচিত হয়েছিল। ৩২ বিঘা জায়গা ঘিরে পৌনে চার বিঘা জমির উপর ঢেউ আকৃতির প্রচার বেষ্টিত শিলাইদহের কুঠিবাড়ী প্রতিষ্ঠিত। তিনতলা এই কুঠিবাড়ীর কামড়ার সংখ্যা ১৮টি। এর নীচতলায় ৯টি, দোতলায় ৭টি ও তিনতলায় দুটি কামড়া রয়েছে। 

প্রাচীন ঐতিহ্য ও জমিদারী নিদর্শনের অবয়বে গড়ে তোলা কুঠিবাড়ী অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম। এই কুঠিবাড়ীর পশ্চিমদিকে অবস্থিত পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো বকুলতলার ঘাট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ফুলের সুগন্ধ ও পাখির কলরবে কবি গান ও কবিতা লিখতেন। কুঠিবড়ীতে কবির ব্যবহার্য জিনিষ-পত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৮০টিরও অধিক বিভিন্ন দুর্লভ ছবি ও কবির ব্যবহৃত খাট, ইজি চেয়ার, লেখার টেবিল, স্পিড বোট, দুই বেহারার পালকি, ঘাস কাটা মেশিন, গদি চেয়ার, নৌকাসহ অন্যান্য ব্যবহার্য্য জিনিষ-পত্র রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কুঠিবাড়ী সংরক্ষণ ও দেখাশুনার কাজ করছে।

এব্যাপারে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান মুখলেছুর রহমান ভুইয়া জানান, বিশ্বকবির ১৬১তম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং জেলা প্রশানের উদ্যোগে জানা মতে দ্বিতীয়বারের মতো শিলাইদহ কুঠি-বাড়িতে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। এই বিষয়টা সামনে রেখে শিলাইদহ কুঠি-বাড়ির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ যে সকল কাজ আছে সেগুলো শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই সকল কাজ শেষ হয়ে যাবে।

কুমারখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলার বাহিনী তাদের সকল প্রস্তুতি শেষ করেছে। অনুষ্ঠান এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠান এলাকায় ডিবি টিম থাকবে ও সাদা পোশাকে পুলিশ থাকবে, এছাড়াও পোশাকি পুলিশও থাকবে অনুষ্ঠানে আসা অতিথি ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, গত দুই বছর কোভিট আক্রান্ত ছিলো সারাবিশ্ব এই সময়ে অফিশিয়াল কোনো আয়োজনই হয়নি। এবার কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহে জাতীয়ভাবে বিশ্বকবির ১৬১তম জন্ম জয়ন্তী উদযাপন করা হবে। বৈশাখ মাস এই মাসে ঝর কালবৈশাখীর সম্ভাবনা থাকে তবে আমরা সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছি।

তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। প্রত্যেক দিনের সিডিউল অনুযায়ী অতিথিদের দাওয়াত কার্ড পৌঁছে দিয়েছি। যেহেতু দুই বছর পর এবারের অনুষ্ঠান সে জন্য অনুষ্ঠান সফল করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর