ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দুই দশক পরিত্যক্ত মিন্টো রোডের ‘লাল বাড়ি’
শফিকুল ইসলাম সোহাগ

বিরোধীদলীয় নেতার বাড়ি হিসেবে বরাদ্দ ২৯ মিন্টো রোডের লাল বাড়িটি ২৭ বছরের মধ্যে দুই দশকের বেশি প্রায় ২২ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ২৯ মিন্টো রোডের বাড়িতে বসবাসের জন্য ওঠেন। ১৯৯৬ সালের পর কোনো বিরোধীদলীয় নেতা ওই বাড়িতে থাকেননি। 

১৯৯৬-২০০১ সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মিন্টো রোডের বাড়িতে ওঠেননি। তবে তিনি কিছু সময় বিএনপির সান্ধ্যকালীন দলীয় কার্যালয় হিসেবে বাড়িটি ব্যবহার করেন। প্রতিবার সরকার বদলের পরপর বিরোধীদলীয় নেতা উঠতে পারেন এই সম্ভাবনায় বাড়িটি মেরামত ও সংস্কার করা হয়। কিন্তু একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ এ বাড়িতে ওঠেননি। 

রমনা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিরোধীদলীয় নেতা থাকলে তাকে দেখভাল করার জন্য যে সেটআপ থাকে তাদের কয়েকজন এখনো মিন্টো রোডের এই বাড়িতে বসবাস করছেন। বাড়িটি পাহারা দিয়ে রাখছেন। তারা সবাই গণপূর্ত বিভাগের স্টাফ। দশম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বর্তমান সরকারের প্রায় সাড়ে চার বছরেও ওঠেননি মিন্টো রোডের বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িতে। গুলশানের ৬৭ নম্বর রোডের নিজ বাড়িতেই থাকছেন তিনি। তাই অব্যবহূতই থাকছে ২৯ মিন্টো রোডের লাল বাড়িটি। 

রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ফকরুল ইমাম এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ওই বাড়িটির পরিবেশ ভালো নয়। তাই বিরোধীদলীয় নেতা ওই বাড়ি নেবেন না। গণপূর্ত অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, বিরোধীদলীয় নেতা ২৯ মিন্টো রোডের বাড়িতে উঠবেন এমন নির্দেশনা তাদের কাছে নেই। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির প্রবেশমুখে ছোট্ট একটি গেট। চাইলে যে কেউ অনায়াসে আসা-যাওয়া করতে পারেন। বাড়ির গায়েও নেই কোনো চিহ্ন। নেমপ্লেটের পরিবর্তে দেয়ালে হাতে লেখা ‘২৯’। বাড়িটির সামনের দিকটার খোলা জায়গায় কয়েকটি মেহগনি গাছ। ঘাস ও জঞ্জালগুলো বলে দিচ্ছে অনেক দিন কারও হাতের ছোঁয়া পড়েনি। লাল দালানটির লাল রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কার্নিসের কোথাও কোথাও শ্যাওলা জমেছে। দরজা-জানালায়ও ধরেছে জং। বিশাল খোলামেলা জায়গায় দোতলা বাড়িটির একেবারেই বেহাল দশা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় না এটি কোনো ভিআইপির বাড়ি। আশপাশে জিজ্ঞাসা না করলে এটি বিরোধীদলীয় নেতার বাড়ি বলে বোঝার কোনো উপায় নেই। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে অপরিচ্ছন্ন সিকিউরিটি বক্স। এটি পরিণত হয়েছে আবর্জনায়। ভিতরে ধুলাবালিতে জন্মেছে গাছপালা। বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়ির আঙিনা ও এর আশপাশের পরিবেশ নোংরা। কুকুরের দৌড়াদৌড়ি। একপাশে কোনায় সবজি চাষ হচ্ছে। খেত-খামার করে খায় বসবাসরত কেয়ারটেকার, মালী ও সুইপার পরিবার। 

এখানকার মালী, সুইপাররা সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের দাবি করলেও বাড়িটির চেহারা ভিন্ন। বাড়ির কোনায় বাসা বেঁধেছে পশুপাখি। দরজায় সাধারণ তালা ঝোলানো। সন্ধ্যা হলেই বাড়িটিতে নেমে আসে ভুতুড়ে পরিবেশ। 

জানা গেছে, এ বাসভবনটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহূত না হওয়ায় অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। বিরোধী দলের নেতার জন্য বরাদ্দ এ বিশাল বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গণপূর্ত বিভাগ থেকে নিয়ম অনুযায়ী একজন মালী ও একজন সুইপার থাকার কথা। কিন্তু চিত্র এর বিপরীত। মালী, সুইপার ছাড়া এখানে কেউ থাকার কথা না থাকলেও পাঁচ-ছয়টি পরিবার বসবাস করছে। তবে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এসব অবৈধ বসবাসরত পরিবার বিরোধী দলের নেতার বাড়ি থেকে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছে। 

জানা যায়, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মিন্টো রোডের এ বাড়িতে ওঠেন। টানা পাঁচ বছর সেখানে থাকেন তিনি। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হলে তিনি এ বাড়িটিতে থাকেননি। বাড়িটিকে তিনি তার সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া থাকেন এরশাদের দেওয়া ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল রোডের বাড়িতে। আর বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা মিন্টো রোডের এ বাড়িতে না উঠে থাকেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সুধাসদনে। 

ক্ষমতার পালাবদলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া হন বিরোধীদলীয় নেতা। এরপর খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের সরকারি বাসভবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে ওঠেন প্রয়াত ছোট ভাই সাঈদ এস্কান্দারের গুলশানের বাসায়। বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবন হিসেবে মিন্টো রোডের এ বাড়িটি বরাদ্দ থাকলেও কার্যত ২০০১ সালের পর থেকে আর কেউই এটি ব্যবহার না করায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। 

বিশাল আয়তনের বাড়িটির বর্তমান বাসিন্দাদের একজন গাড়িচালক আনোয়ারের দাবি, পরিচ্ছন্নতার জন্য নিয়োজিত কর্মী সরস্বতী নিয়মিত প্রতিটি ঘর পরিষ্কার করেন। সরস্বতীও পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতেই কর্মচারীদের কোয়ার্টারে থাকছেন দীর্ঘদিন। মালী লাল মিয়া জানান, গাছগাছালিগুলো দেখাশোনা করা, আগাছা পরিষ্কারসহ নানা কাজ করেন তিনি।

বিডি প্রতিদিন/ই-জাহান



এই পাতার আরো খবর