ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কিশোর-কিশোরী ক্লাব: সুরক্ষিত আগামী যাদের লক্ষ্য
অনলাইন ডেস্ক

পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, এর মধ্যেই নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার পাঙ্গা মটুকপুর ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের একটি কক্ষে জড়ো হয়েছে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। নিজেদের ভেতর তারা কথা বলছে বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা, পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো বিষয়ে। সপ্তাহের ছয়দিনই এমন দৃশ্যের দেখা মেলে রংপুর ও নীলফামারী জেলার ৭টি উপজেলার ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের কিশোর-কিশোরী ক্লাবগুলোতে। 

ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সাম্য ও সমতা বিধান, বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন, কৈশোরকালীন পুষ্টি, খাদ্য ও পুষ্টির গুরুত্ব, শ্রম বিভাজন, মাসিক ব্যবস্থাপনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য, স্বপ্নদোষ, ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, নারী ও কিশোর কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা ও এইসব সহিংসতা থেকে উত্তরণের উপায়,  ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এই ক্লাবগুলো কাজ করছে। 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি ফর এডলসেন্ট হেলথ ২০১৭-২০৩০-এ কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি, এইচআইভি/এইডস ও অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ প্রদানের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রজনন স্বাস্থ্য, কিশোর-কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা, মাসিককালীন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কুসংস্কার দূর করার লক্ষ্যে কিশোর-কিশোরী ক্লাবকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। 

দেশের কিশোর-কিশোরীদের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম বা জানো প্রকল্প। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়। এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে, সহ-অর্থায়নে আছে অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন। প্রকল্প বাস্তবায়নে যৌথভাবে কাজ করছে কেয়ার বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও ইকো স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। বাংলাদেশের রংপুর এবং নীলফামারী জেলার  ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৪ লক্ষ ২১ হাজার ৪২৫ জন কিশোর-কিশোরী প্রকল্পটির আওতাধীন রয়েছে।

জানো প্রকল্পের সহায়তায় গড়ে ওঠা এসব কিশোর-কিশোরী ক্লাবগুলোতে গেলে দেখা মেলে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের মধ্যে বই পড়ছে, স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে। ৫০ থেকে ৬০ জন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে রুটিনমাফিক চলে এই ক্লাবগুলোর কার্যক্রম। 

শুধুমাত্র বই পড়া এবং বয়োঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনই নয়, সেই সাথে এই ক্লাবগুলোতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে সদস্যদের ফলিকএসিড, মেয়েদের আয়রন ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়, পাশাপাশি ক্লাবগুলোতে স্যানিটারী ন্যাপকিন ও অন্যান্য সামগ্রী রাখা হয়। জানো প্রকল্পের পক্ষ থেকে একজন স্কুল ভলান্টিয়ার এলাকাভিত্তিক এই ক্লাবগুলোর দায়িত্বে থাকেন। 

নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পাঙ্গা মটুকপুর ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর হিসেবে কাজ করেন আনোয়ারা বেগম। তিনি মনে করেন, ‘‘আগে কিশোর কিশোরীরা তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ভয় পেলেও এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কিশোর-কিশোরীরা নিজ উদ্যোগেই ক্লাবে এসে সেবা নিচ্ছে’’। 

তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকার ও জানো প্রকল্পের সমন্বয়ের ফলেই এই কার্যক্রমের প্রসারতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে জনসচেতনতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে’’।

বর্তমানে সরকার ও জানো প্রকল্পের সমন্বয়ের ফলে রংপুর ও নীলফামারীর কিশোর-কিশোরী ক্লাবগুলো কিশোর-কিশোরীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদেরও সচেতন  করে তুলছে। মটুকপুরের  ১০ম শ্রেণির ছাত্রী অর্নি চার মাস আগে এমন একটি ক্লাবে আসা শুরু করেন। প্রথমে ক্লাবের পক্ষ থেকেই তাদেরকে ক্লাবে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল, এখন তিনি নিয়মিত এখানে আসেন। তিনি বলেন, “এই ক্লাবে আসার ফলে বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যার কথাগুলো জানতে পারছি, এসব বিষয়ে সচেতন হচ্ছি। বাল্যবিবাহের কুফল, জেন্ডার বৈষম্য ও কীভাবে তা দূর করা যায় সে সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছি। এখান থেকে পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে নিজেরা আলোচনার পাশাপাশি নিজ এলাকার বন্ধু-বান্ধবের সাথেও আলোচনা করি”। একই এলাকার কিশোর তৌকির বলেন “এই ক্লাবে আসার ফলে আমরা আমাদের স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারছি। আগে এসব বিষয় নিয়ে ভয় পেলেও এখানে আসার পর আমাদের সে ভয় দূর হয়েছে”।

কিশোর-কিশোরী ক্লাবগুলো মূলত কাজ করছে বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে, একইসাথে স্কুল শিক্ষার্থীরাও এখানে আসছে। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রমিজ আলমের মতে ‘‘জানো প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহীত এই কার্যক্রমগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ ও সুরক্ষিতভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করবে।’’

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর