ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কুকিং ডেমোনস্ট্রেশন; নিজেদের বাগানের ফলনে আনন্দ আয়োজন
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম লক্ষ্যে ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নত পুষ্টিমান, সকল বয়সী মানুষের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ; জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সে অনুসারে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত ২য় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা ২০১৬-২০২৫ এর অধীনে পুষ্টি বিষয়ক কর্মসূচি বাস্তবায়নে রংপুর ও নীলফামারী জেলায় সরকারকে সহয়তা করছে জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম বা জানো প্রকল্প। 

পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের সহ-অর্থায়নে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কনসোর্টিয়াম গঠনের মাধ্যমে যৌথভাবে কাজ করছে কেয়ার বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও ইকো স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। বাংলাদেশের রংপুর এবং নীলফামারী জেলার সাতটি উপজেলার ৩৩১টি বিদ্যালয়ের ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৪ লক্ষ ২১ হাজার ৪২৫ জন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে এই প্রকল্পটি কাজ করছে।

প্রকল্পের অধীনে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও তাদের খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাতে নেয়া হয়েছে পুষ্টি বাগান কার্যক্রম। এই কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কৃষি শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষকের সহায়তায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাতে-কলমে পুষ্টি উপাদান ভিত্তিক বাগান তৈরির শিক্ষা দেয়া হয়। এই কার্যক্রমকে আরো বেশি কার্যকর করতে এবং এখান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগের লক্ষ্য নিয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে রান্না কর্মসূচি বা কুকিং ডেমোনস্ট্রেশন। 

এই কর্মসূচির আওতায় প্রতি বছর রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ ৩ টি মৌসুমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুষ্টি বাগানে উৎপাদিত সবজি দিয়ে বনভোজনের আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থীদের থেকে তোলা স্বল্প চাঁদা, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সহায়তা ও বাগানে উৎপাদিত সবজির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে মজার মজার পুষ্টিকর রান্না শেখানোর পাশাপাশি খাদ্য ও খাদ্যের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে জানানোই এই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। এই কর্মসূচিতে রান্নার গতানুগতিক ধারণায় নিয়ে আসা হয়েছে পরিবর্তন। রান্নার কাজগুলোতে মেয়েদের সাথে সাথে সমান ভাবে একত্রে কাজ করছে ছেলেরা। ছেলে-মেয়েরা রান্নার পাশাপাশি খাদ্যের পুষ্টিমান নিয়ে সচেতন হচ্ছে এবং তাদের এই অভিজ্ঞতা নিজেদের বাড়িতেও পৌঁছে দিচ্ছে।

এই বনভোজন ও রান্না কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রান্না বিষয়ক রেসিপি বুক অনুযায়ী সৃজনশীল রান্না শেখানো হয়। একই ধরণের সবজি দিয়ে যে বিভিন্ন রকম মজাদার খাবার তৈরি করা যায় তা শিক্ষার্থীদের বাস্তবে করে দেখানো হয় এই ডেমোনস্ট্রেশনগুলোতে। এর ভেতর অন্যতম হলো মিষ্টি কুমড়ার চপ, সবজি পাকোড়া, সজনে শাকের পাকোড়া ইত্যাদি। খাদ্যের পুষ্টিমান ঠিক রেখে কীভাবে সুস্বাদু রান্না করা যায়, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তা দেখানো হয় এই ডেমোনস্ট্রেশনে  এবং সে ধরণের খাদ্য তৈরি করে দেখানো হয় শিক্ষার্থীদেরকে। 

জানো প্রকল্পের একজন স্কুল ভলেন্টিয়ার ও বিদ্যালয়ের কৃষি শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষকের সমন্বয়ে এসব ডেমোনস্ট্রেশন পরিচালিত হয়। এ ধরণের কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। আনন্দের ভেতর দিয়ে তারা খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে, আবার রান্নার কাজটি যে শুধুমাত্র মেয়েদের নয়, তাও বুঝতে পারছে।  “বিদ্যালয়ে নিজের হাতে তৈরি করা বাগানের সবজি তুলে, নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ার অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদেরকে আনন্দিত করে তুলে। এছাড়া পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে এখান থেকে যে শিক্ষা পাচ্ছে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কাজের সুযোগও পাচ্ছে। আবার এখান থেকেই নিজেদের উৎপাদিত সবজি দিয়ে পুষ্টিকর খাবার তৈরিও শিখে যাচ্ছে”, জানো প্রকল্পের অধীনে এই পুষ্টি বাগান ও রান্না কর্মসূচি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা এভাবেই বলছিলেন তারাগঞ্জ ওয়াকফ এস্টেট বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. সফিকুল ইসলাম। 

বিভিন্ন বিদ্যালয়ে জানো প্রকল্পের এই কুকিং ডেমোনস্ট্রেশন কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ এবং বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞান প্রদানের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় পুষ্টিকর খাবারসমূহের রান্নার ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা নিজেদের বাড়িতে প্রয়োগ করছে। হলদী বাড়ি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম এই কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন, “কুকিং ডেমোনস্ট্রেশন শুধু পুষ্টি বা রান্নার কথা বলছে না, এই কর্মসূচির মাধ্যমে পুরনো ধ্যান ধারণা পরিবর্তনের কথাও বলা হচ্ছে। কোন কাজই যে নারী বা পুরুষের একার নয়, তা অনুধাবন করতে শেখাচ্ছে। যার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে জেন্ডার বৈষম্য কমছে”। 

এই দুই জেলার উপজেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝে ভিন্ন ধারার পরিবর্তন নিয়ে এসেছে পুষ্টিবাগান ও রান্না কর্মসূচি।  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে দেখা মিলছে ছেলেরা রান্না, বাগান তৈরি ও বাড়ির কাজে হাত লাগাচ্ছে, আর মুদ্রার অপর পিঠের মতো মেয়েরা অংশগ্রহণ করছে কারাতে বা ফুটবলের মতো খেলায়।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর