ঢাকা, সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

জনজীবনে মেঘনার তীব্র ভাঙনের প্রভাব
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
নদীভাঙা পরিবারের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস।

মেঘনার তীব্র ভাঙনের প্রভাব পড়েছে লক্ষ্মীপুর উপকূলীয় অঞ্চলে। নদীর অব্যাহত ভাঙনে এখানকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এখন গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ আর বিভিন্ন সড়কের দু’পাশে ভাঙা ঝুপড়ি ঘরে এখন বাস করছেন তারা।

কারো ঘরে ফাটা টিন, কারো প্লাস্টিকের পলিথিনের ছাউনিতে জরাজীর্ণ লক্কর-ঝক্কর ঘরে দুর্ভোগে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। একটু আশ্রয় পেতে আকুতি এসব অসহায় মানুষের। সরকারি-বেসরকারি সীমিত বরাদ্দে নদী ভাঙা এসব পরিবারের শান্তনা যেন মিলছেই না।

জেলা প্রশাসক বলছেন, নদী ভাঙাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঘর দেওয়া হচ্ছে। কোনো গৃহহীন থাকবে না বলে আশ্বাস দেন তিনি।

কিছুদিন আগেও লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরের মতিরহাট ও চর লরেন্স এলাকার নদী তীরে স্থানে বাস করতো শতাধিক পরিবার। ছিল ঘরবাড়ি, পুকুর ও ফসলি জমিসহ সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা। কিন্তু নদী গর্ভে এসব বিলীন হয়ে এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে। জেলায় মেঘনার অব্যাহত ভাঙন প্রায় ৩০ বছর ধরে চলে আসছে বলে জানান স্থানীয়রা।

বর্ষায় ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। ভাঙনের প্রভাব পড়েছে লক্ষ্মীপুরের সদর, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী এলাকায়। বিশেষ করে ভাঙনের তীব্রতা ছিল রামগতি ও কমলনগরে ব্যাপক। এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বহু মানুষের ভিটেবাড়ি ও ফসলি জমি। সর্বস্ব হারিয়ে এখানকার মানুষ বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। বিত্তবানরা বিভিন্ন জেলায় চলে গেলেও বেশির ভাগ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। তারা বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন সড়কের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন।

স্থানীয় তথ্যমতে বর্তমানে নদী ভাঙা এমন পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। বিশেষ করে সদরের মজু চৌধুরীর হাট থেকে মতিরহাট পর্যন্ত সরকারি বেড়িবাঁধের দু’পাশে, রামগতি সড়কের মিয়ার বেড়ি থেকে তোরাবগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে, তোরাবগঞ্জ থেকে মতির হাট সড়কের বিস্তীর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এসব মানুষ কেউ কেউ কাটাচাটা টিন, প্লাস্টিকের পলিথিন আর হোগলা পাতার ছাউনিতে জরাজীর্ণ ঘর তৈরি করে বাস করছেন। খোলা আকাশের নিচেও বাস করছেন কেউ কেউ।

তবে নদীকূল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহে সবাই কর্মব্যস্ত। এদের কেউ বুনছেন জাল, কেউবা পালন করছেন পশু-পাখি, কেউবা ধরছেন মাছ, আবার কৃষিসহ হাতের কাজে উপার্জন করছেন অনেকে। সবাই জীবন সংগ্রামে লড়লেও এদের বাসস্থানে এসে হতাশা ও দুর্ভোগে মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র ভেসে ওঠে। নদী ভাঙা এমন এক পরিবারের সন্ধান মিলে সদরের মজু চৌধুরীর হাট বেড়িবাঁধ এলাকায়। তারা ৩০ বছর ধরে বাস করছেন এ এলাকায়।

নুরু মিস্ত্রী ও তার স্ত্রী সাজু বেগম দু’জনই এখন বয়োবৃদ্ধ। তবুও থেমে নেই তাদের পথ চলা। রবিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী সাজু জাল বুনছেন, আর তার স্বামী সুতা ঠিক করে দিচ্ছেন তাকে। কথা বলে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে ১০০০-১২০০ টাকা আয় করে সংসার চলে তাদের। কিন্তু তাদের বসত ঘরের একবারেই বেহাল অবস্থা। এক চালা টিনের ঘর, উপরে কাটাচাটা টিন। তবুও ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন তারা। রোদে বৃষ্টিতে ভিজে দিনযাপন করছেন।   জানতে চাইলে নুর মিস্ত্রী নদী ভাঙার কথা শুনিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক সময় সবই ছিল তার। কিন্তু এখন তিনি সর্বহারা। বসবাসের জন্য সুন্দর একটি স্থান চান তিনি। তবে অর্থের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সরকারের কাছে একটি ঘর পাওয়ার আক্ষেপ তার।

এমন পরিবারেরর সংখ্যা কম নয়, আশপাশের জুলেখা বেগম, কুলছুমা আক্তার, বিবি কুলসুমসহ তাদের মতো অসংখ্য পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এখন বেড়ির পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের সবার ঘরের একই অবস্থা। খোলা আকাশের নিচেও থাকছেন কেউ কেউ। এখন তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন, নিঃস্ব বলে জানান। তারা বলছেন, গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছে সরকার, কিন্তু তারাতো পাচ্ছেন না। সরকারি বরাদ্দের ঘর প্রাপ্তির দাবি জানান সকলে।

এদিকে, যে বেড়িদে আশ্রয় নিয়েছেন সেটিও এখন বিধ্বস্ত। এতে করে দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় উৎকণ্ঠা আরো বেড়েছে নদী ভাঙা এসব মানুষসহ নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের। যদিও সরকার সম্প্রতি নদী তীর রক্ষা বাঁধের জন্য ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলে নদী ভাঙন সমস্যা থাকবে না। দুর্ভোগও কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে জেলা এনজিও ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, এসব বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা রয়েছে। দীর্ঘ বছরের নদী ভাঙা পরিবারের সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজার। সরকারি-বেসরকারিভাবে ঘর বরাদ্দ আসে দুই হাজার পরিবারের। এতে করে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। তবে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করছেন এনজিও ফোরামের এ নেতা। 

জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সম্প্রতি নদী তীর রক্ষা বাঁধের জন্য সরকার ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলে নদী ভাঙা রোধ সমস্যা থাকবে না। এছাড়া মুজিবশত বর্ষে ১৭৭৬টি ঘর বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। এর বেশীর ভাগ ঘর পেয়েছেন নদী ভাঙ্গা পরিবার। তবে আরো ৩ হাজার ঘরের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবেনা বলে জানান তিনি।

বিডি প্রতিদিন/এমআই



এই পাতার আরো খবর