ঢাকা, বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বোরো ধানে ব্লাস্ট, মৌলভীবাজারে কৃষকের ঈদ আনন্দ ম্লান
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষীদের জীবন জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সম্ভল হাওরে উৎপাদিত এক ফসলি বোরো ধান। ওই ফসলের আয় দিয়েই তাদের পুরো বছরের সাংসারিক খরচ এবং ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াসহ সকল ব্যয় চলে। কৃষকরা ধার দেনাও মিটান ধান বিক্রির টাকা থেকে।

কিন্তু এবছর বোরো মৌসুমে দীর্ঘ মেয়াদী খরা, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ও পানি সেচের সুবিধা না থাকায় জেলার হওর গুলোতে কৃষকের রোপনকৃত ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে চিটা ধরায় চরম লোকসানে পড়েছেন হাওর পারের প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষীরা। সেই সাথে আসন্ন ঈদ-উল ফিতরের আনন্দ বিলিন হয়ে গেছে হাওর এলাকার দরিদ্র কৃষকদের। ঈদ আনন্দ উপভোগের চেয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মহাজনের দাদন, এনজিও কিস্তি ও ক্ষুদ্র ব্যাংক ঋণ পরিশোধ নিয়ে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার ৭শ ৫০ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ৫৭ হেক্টর। হাওর ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৮৯ হেক্টর জমি। তবে স্থানীয়রা বলছেন হাওরগুলোতে আবাদকৃত পুরো ব্রি-২৮ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যার পরিমাণ সরকারি তথ্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

জানা যায়, বোরো চাষের জন্য মাঘ মাসে স্থানীয় মহাজনরে কাছ থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ নিলে ঘরে ধান তোলার পর ওই ১ হাজার টাকায় সুদ হিসেবে দিতে হয় দেড় মণ ধান। এছাড়াও এনজিও এবং জেলা সমবায় অফিস থেকে নিবন্ধনকৃত সমিতি থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন কৃষকরা। এদিকে গত বছর হাওরের যে এলাকায় (মৌজায়) ব্রি-২৮ জাতীয় ধান প্রতি বিঘাতে ১৫ থেকে ২০ মন ধান পেয়েছেন কৃষকরা। এ বছর ওই এলাকায় (মৌজায়) ব্রি-২৮ ধান প্রতি বিঘাতে কৃষকরা পাচ্ছেন ৩ থেকে ৪ মন।শুধু ব্রি -২৮ নয় এ বছর ব্রি-২৯ জাতের ধানে ও চিটা দেখা দিয়েছে 

সরেজমিন হাওর কাউয়াদীঘি পূর্বাঞ্চলের হাওরের নিকটবর্তী “কান্দি” গ্রামে গিয়ে প্রান্তিক ও বর্গাচাষীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমাদের মাঝে এ বছর ঈদের কোন আনন্দ নেই। হাওরের রোরো ধান ব্লাস্ট রোগে  নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছি মহাজনের দাদন পরিশোধ নিয়ে। 

জেলার রাজনগর উপজেলার কান্দি গ্রামের বর্গাচাষী সামছুল মিয়া বলেন, আমরা দিনমজুর। দৈনন্দিন মজুরি দিয়ে কোনো রকম চলে আমাদের সংসার। সাংসারিক খরচ শেষে আমাদের কাছে কোন দিন অবশিষ্ট টাকা থাকেনা। তাই বাধ্য হয়ে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন এনে বোরো চাষাবাদ করি। বোরো ক্ষেত আমাদের প্রাণ। বোরো চাষাবাদ করতে আনন্দ পাই। ভালোভাবে ধান হলে অন্তত সারা বছর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ডাল ভাত খেতে পারতাম।

তিনি আরও বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে ২ বিঘা জমিতে ধান পেয়েছি ৮ মন। এই জমি আবাদ করতে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে গত পৌষ মাসে দাদনে ১০ হাজার টাকা এনে ছিলাম। দাদন হিসাবে বৈশাখ মাসে ১০ মণ ধান ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ১০ হাজার টাকা ফেরত দেয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু এবার ধান পেয়েছি মাত্র ৮ মন। এর মধ্য থেকে জমির মালিককে খাজনা হিসেবে দিতে হবে ৪ মন। মহাজনের দেনা পরিশোধ ও পুরো বছর ছেলে মেয়েদের নিয়ে কিভাবে সংসার চালাই এই চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে। ঈদ আনন্দতো অনেক দূরে।

হাকালুকি হাওরের কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ২ বিঘা জমিতে ব্রি ২৮ ধান চাষ করেছিলাম। পুরো দুই বিঘা জমির ফসলে চিটা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কৃষি বিভাগ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাননি। কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক রিয়াজুর রহমান বলেন, কৃষি বিভাগ কাগুজে কলমে ফলন বাড়িয়ে দেখাতে ব্যস্ত। কৃষকের সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসেনি।

কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সাহেদ আহমদ বলেন, ৮০ শতাংশ ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ধান কাটতে চাচ্ছেন না কৃষকরা। আমিও সোমবার কিছু ধান কেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কৃষক রিয়াজুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ওষুধ এবং স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের উদাসিনতায় এমনটি হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এতো বড় বিপর্যয় হতো না। বাদে ভুকশিমইল গ্রামের আরিফুর রহমান বলেন, ইউনিয়ন পর্যএকজন কৃষি উপসহকারী আছেন এটা আমিসহ অনেক কৃষকই জানেন না। কৃষকের সংকট কিংবা দূরদিনে তাদের কাছে পায়নি।

মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, আবহাওয়ার কারণে ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছু কিছু এলাকায় ধান নষ্ট হয়েছে । রাতে ঠান্ডা-দিনে গরম এই পরিস্তিতি ব্রি-২৮ জাতের ধানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমরা কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে আসছি ব্রি- ২৮ জাতের ধান রোপণ না করতে। কিন্তু তার পরেও কৃষকরা ব্রি- ২৮ জাতের ধান রোপণ থেকে সরে আসছেন না। এখন পর্যন্ত পোর ক্ষেত নষ্ট হয়েছে এমন ৬২৩ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের  নামের তালিকা করা হয়েছে। 

বিডি প্রতিদিন/এএ



এই পাতার আরো খবর