ঢাকা, সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

নানা সমস্যায় জর্জরিত ফেনী জেনারেল হাসপাতাল
ফেনী প্রতিনিধি

নানা সমস্যা জর্জরিত ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেবা নিতে আসা রোগীরা যেমন দুর্ভোগে পড়ছেন তেমনি চিকিৎসকেরা সেবা দিতে হিমশিমে পড়ছেন। ইনডোর, আউটডোর ও ইমারজেন্সিতে সেবা নিতে আসা রোগীরা তাদের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, পুরো হাসপাতালটি অপরিচ্ছন্ন। দুর্গন্ধের জন্য রোগীদের নাকে হাত দিয়ে থাকতে হয় মাঝেমধ্যে। বাথরুমগুলোর সামনে গেলেই বমি আসে। জানা যায়, হাসপাতালটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থ খুবই দুর্বল হওয়ায় নিত্য সেখানে টাকা-পয়সা ও মোবাইল চুরির ঘটনা ঘটে। বেশ কয়েকজন রোগী অভিযোগ করেন তাদের হাসপাতাল থেকে কোন ওষুধ দেয়া হয়নি। যে সকল ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেয়ার কথা সেগুলোও তারা পাচ্ছেন না। এক্সরে মেশিনসহ ল্যাবে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি না থাকায় রোগীরা কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।   

হাসপাতালটিতে বর্তমানে ডাক্তারের সংখ্যা রয়েছে ৬৫ জন যা চাহিদার অর্ধেকের চেয়েও কম। সেবিকা ও তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছে চাদিহার এক তৃতীয়াংশ। হাসপাতালটির ডায়ালাইসি সেন্টারে তিন সিফটে নেগেটিভ ৭ জন করে রোগীর ডায়ালাইসিস করা যায়। প্রজেটিভ হলে আর ২-৩ জন বেশি রোগীর ডায়ালাইসিস করার সুযোগ রয়েছে। অথচ কিডনি ডায়ালাইসি রোগীর সংখ্য ফেনীতে দৈনিক অনেকগুণ বেশি।  হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা কাটা সেলাইয়ের কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রোগীদের জিম্মি করে টাকা নেয়ার রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হাসপাতালটির খাবার মান নিয়ে। রোগীরা জানান, বেডের বাহিরে থাকা ভর্তি রোগীদের খাবার দেয়া হয় না। আর যাদের খাবার দেয়া হয় তা মুখে দেয়ার মতো নয়। এ ব্যাপারে অনেক বার অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা হয়নি।  হাসপাতালটিতে দালাল ও অ্যাম্বুলেন্স চালকদের দৌরাত্ম চোখে পড়ার মতো।  সরেজমিনে দেখা যায়, ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ শহীদ উল্যাহ রোগীদের ভিড়ে যথারীতি হিমশিম খাচ্ছেন। ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসারের রুমের দরজার সামনে রোগীদের দীর্ঘ লাইন, রুমের ভিতরেও সেবা নিতে আসা রোগীদের ভিড়। ডেঙ্গু ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকযীম মোহাম্মদ জানান, সার্বক্ষণিক আমরা ডেঙ্গু রোগীদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছি। এছাড়াও আমরা সীমিত সম্পদের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

হাসপাতালটির আইসিইউ স্বাস্থ্যসেবা খুবই রুগ্ন। কোনমতে টেনেটুনে চলছে এ সেবাটি। সংকটাপন্ন রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সকালবেলা সেবায় গতি থাকলেও বিকেল ও রাতে ফুটে উঠে নিরবতা। পর্যাপ্ত জনবল আর লজিস্টিক সেটআপ থাকলে এটি হতো ফেনীর সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যসেবা। ১০ বেডের মধ্যে ৩টি থাকে অব্যবহৃত। 

২০২০ সালের ১৭ মে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ১০ বেডের আইসিইউ সেবাটি চালু হয়। কিন্তু এই ইউনিটটিতে গত চার বছরেও নিয়োগ দেয়া হয়নি পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সার্পোট। এখানে সার্বক্ষণিক ৭ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ১ জন মেডিকেল অফিসার ও একজন কনসালটেন্ট। ১৫ জন সেবিকা থাকার কথা থাকলেও আছেন ৬ জন। এছাড়াও পোর্টাবেল এক্স-রে মেশিন, ইমার্জেন্সি ডায়ালাইসিস সুবিধা, বেড সাইড ইকোকার্ডিওগ্রাম, আল্ট্রাসাউন্ড ও পর্দা না থাকায় সঠিক সেবা না পাবার অভিযোগ সংকটাপন্ন রোগীর স্বজনদের। দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে আছে হাসপাতালের একমাত্র লিফটটি।

বিবি আমেনা রোজির নামের এক মহিলার বাবা বিছানায় শোয়া। তার তেমন সাড়া শব্দ নেই। এমন সংকটাপন্ন রোগীর সেবা দিতে আইসিইউতেই থাকতে হচ্ছে বিবি আমেনা রোজিকে। রোগীকে সেবা দিতে সেফটিমূলক যে পর্দা থাকার কথা সেটি নেই। ফলে তার বাবাকে সেবাদিতে অনেকখানি সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। তিনি জানান, আয়া ও ওয়ার্ড বয় না থাকায় কি যে কষ্ট তা বুঝানো সম্ভব নয়। বিকেল এর পর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেখা মিলে না। তিনি জানান, এসব বিষয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দেয়া দরাকার। নজরুল তার মুমুর্ষূ বাবাকে নিয়ে আসেন হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি ডাক্তার তাকে আইসিইউতে ভর্তি দেন। কিন্তু লিপটি অকেজ কিংবা বন্ধ থাকায় উপরে তুলতেই রোগীর অবস্থা খারাপই। তিনি জানান, শুধু আইসিইউ থাকলে তো হবে না। সেবা পাবার সহযোগী হেন্ডসতো লাগবে। জামাল উদ্দিন মজুমদার ফুলগাজী থেকে কিডনি রোগের সমস্যা নিয়ে তার মাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় নিয়ে আসেন সদর হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি ডাক্তার রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করান। যে নার্স বা ডাক্তাররা আছেন তারা বেশ ভালো সেবা দিচ্ছেন। কিন্তু এখানে আইসিইউ বেডের সাথে ইমার্জেন্সি ডায়ালাইসিস না থাকায় রোগীকে নিয়ে পুরো ফেনীতে ডায়ালাইসিস ম্যানেজ করতে না পেরে তিনি হতাশ। তিনি বলেন, মনে হয় রোগীকে বুঝি আর বাঁচানো গেলো না।

সোনাগাজী থেকে মো. সাহাবুদ্দিন নামের এক রোগীকে নিয়ে আসেন তার ভাই কামাল উদ্দিন। তিনি জানান, এক্সরে করাতে রাতের বেলায় বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অবস্থা খারাপ। এখানে যদি এক্সরে থাকতো তবে রোগীকে আরো সেবা দিয়ে ভালো করা যেত। ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ১০ শয্যা আইসিইউ এর কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফুর রহমান জানান, পোর্টাবেল এক্স-রে মেশিন, ইমার্জেন্সি ডায়ালাইসিস সুবিধা, বেড সাইড ইকোকার্ডিওগ্রাম, বে সাইড আল্ট্রাসাউন্ড ও পর্দা না থাকা, ডাক্তার, সবকিউরিটি, পর্যাপ্ত নার্স, সাপোর্টিং স্টাফ না থাকায় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যাচ্ছে না।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আসিফ ইকবাল জানান, ফেনীর মত জেলা সদর হাসপাতালে স্কানো, আইসিইউমত আধুনিক বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে আধুনিক বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তার ও নার্সরা। জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সরবারাহ পেলে আমরা কাঙ্খিত সেবা দিয়ে যেতে পারবো। খাবার মানের ব্যাপারে তিনি বলেন এটা ঠিকাদারের ব্যাপার।  এ ব্যাপারে জানতে তত্ত্বাবধায়ককে বারবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেন নি। তিনি হাসপাতালটিতে টানা তিন বছর কর্মরত রয়েছেন বলে জানা যায়। 

বিডি প্রতিদিন/এএ 



এই পাতার আরো খবর