কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের অন্ধবিশ্বাসের বিষয়টি নতুন নয়। বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় বিভিন্ন আবিষ্কার আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার এই অন্ধবিশ্বাস কমাতে সহায়তা করলেও এখনও গ্রাম বাংলায় রয়েছে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপক প্রচলন। তেমনি এক অন্ধবিশ্বাস হলো বটবৃক্ষের তলে আঁচল বিছিয়ে সন্তান লাভের আশায় ভিখ!
ভিখ মানে ভিক্ষা। ভক্তদের বিশ্বাস নিঃসন্তান বন্ধ্যা মহিলারা আশ্রমের অক্ষয় তলা নামক স্থানে বটগাছের নিচে ভেজা কাপড়ে বসে আঁচল বিছিয়ে সন্তান লাভের জন্য ভিখ মাগবেন। তাদের বিশ্বাস, যদি গাছের ফল বা পাতা আঁচলের ওপর পড়ে তাহলে নিঃসন্তান নারী সন্তান লাভ করবে। নাটোরের লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের গোঁসাইজীর আশ্রমে এই দৃশ্য চলছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় ওই বটগাছের নিচে চারজন নারী ভক্তি ভরে চাদর বিছিয়ে গাছ থেকে পাতা পড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আর তাদের কর্মকাণ্ড পেছনে ও পাশ থেকে দেখছেন অনেক নারী-পুরুষ। আশ্রমের এক নারী বৈষ্ণব তাদের দেখভাল করছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরোজমিনে গেলে উপজেলার পানসিপাড়া শ্রী শ্রী ফকির চাঁদ্র বৈঞ্চব গোসাইয়ের আশ্রমে ৩২৬তম নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অক্ষয় বটবৃক্ষের তলে আঁচল পেতে সন্তান লাভের আশায় বসে থাকতে দেখা যায় নারীদের।
বাঘা উপজেলার আলাইপুর গ্রামের মর্জিনা বেগম জানান, লোক মুখে শুনেছি এই বট বৃক্ষের নিচে স্নান করে বসলে সন্তান সম্ভাবনা লাভ করা যায় সেই আশায় আমার মেয়ে স্বপ্নাকে নিয়ে এসেছি। একই উপজেলার পান্নাপাড়া এলাকার শ্রীমতি নামে এক নারী জানান, আমার ছেলের বউয়ের দীর্ঘ ৬ বছর যাবৎ কোন সন্তান না হওয়ায় গোসাইজির আশ্রমে পুকুরে স্নান করে অক্ষয় বটবৃক্ষের তলে বউমাকে আচল পেতে সন্তান লাভের আশায় গোসাইজির ধ্যানে বসিয়ে রেখেছি, যদি তার আঁচলে বৃক্ষের পাতা পড়ে তাহলে অবশ্যই সন্তান লাভ করবে।
লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌরসভার সীবেন দাস জানান, ৯ বছর ধরে কোন সন্তান না হওয়ায় বিভিন্ন মানুষের মুখে শুনে গত বছর এই দিনে আমার স্ত্রীকে নিয়ে সামনের পুকুরে স্নান শেষে এই অক্ষয় বটবৃক্ষের নিচে বসিয়ে দিয়েছিলাম। তার আঁচলে একটি অক্ষয় বট বৃক্ষের পাতা পড়লে সেই পাতা বেটে খাওয়ার পর সন্তান লাভ করে। সীবেন দাসের স্ত্রী সূবর্ণা রানী জানান, ৯ বছর পর একটি কন্যা সন্তান হওয়ায় আমার পরিবারের সকলের মাঝে আনন্দ ফিরে এসে তাই এ বছর সাধু বাবার আশ্রমে আমার কন্যা সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি। এমনিভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সন্তান লাভের আশায় নিঃসন্তান নারী-পুরুষরা আসেন উপজেলার পানসিপাড়া শ্রী ফকির চন্দ্র গোসাইয়ের আশ্রমে নবান্ন উৎসবে।
আশ্রমের প্রধান সেবাইত পরমানন্দ সাধু জানান বাংলা ১২১৭ সালে উপজেলা প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দূড়দুড়িয়া ইউনিয়নের পানসি পাড়া গ্রামে গহীন অরণ্যের একটি বটবৃক্ষের নিচে আস্তানা করেন শ্রী ফকির চন্দ্র বৈষ্ণব। এখান থেকে সাধু ধ্যান তাপস্য ও বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার শুরু করেন। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমা গঙ্গাস্নান ও নবান্ন উৎসব উপলক্ষে হাজারো ভক্তবৃন্দ, দর্শনার্থী ও সাধকরা উপস্থিত হন। তিনি আরো জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে নিঃসন্তান নারীরা পুকুরে স্নান শেষে সন্তান লাভের আশায় অক্ষয় বটবৃক্ষের তলে আঁচল পেতে বসে থাকেন। যাদের আঁচলে বৃক্ষের পাতা পড়ে তারা কন্য সন্তান ও ফল পড়লে পুত্র সন্তান লাভ করেন। তবে এ ব্যাপারে নাটোর সিভিল সার্জন ডাক্তার মশিউর জানান, এভাবে সন্তান অসম্ভব। এমন প্রার্থনা হচ্ছে কুসংস্কার। আর সেটাই গ্রামের কিছু মানুষের অন্ধবিশ্বাস। বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর কোনও ভিত্তি নেই।